Home » আমলাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য গুলো কি কি?
আমলাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য গুলো কি কি, আমলাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য,

আমলাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য গুলো কি কি?

by Susmi
0 comment

আমলাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য সমূহ

জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার (Max Weber) প্রথম আদর্শ আমলাতন্ত্রের ধারণা দেন। তিনি আদর্শ-নমুনার আমলাতন্ত্রকে আধুনিক প্রশাসন ব্যবস্থা পরিচালনা ও কার্যকর করার অন্যতম শর্ত হিসেবে চিহ্নিত করেন। তার মতে, আদর্শ আমলাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য গুলো হলো:

১. আমলারা সরকারের নীতিসমূহ বাস্তবায়ন করে থাকেন।

২. আমলারা সরকারের স্থায়ী কর্মকর্তা।

৩. আমলারা মেধার ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন।

৪. আমলাতন্ত্র একটি পদসোপানভিত্তিক সংগঠন।

৫. আমলাতন্ত্রের সদস্যরা বিশেষ গুণের অধিকারী হবেন।

৬. আমলারা কঠোর নিয়মানুবর্তিতা মেনে চলবেন।

৭. আমলাদের প্রশাসনিক জীবনে ব্যক্তিজীবনের কোনো প্রভাব থাকবে না।

৮. আমলাতন্ত্রের সদস্যরা সংগঠনের মালিকানার অংশ হবেন না।

৯. এ সংগঠনের সদস্যরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হবেন।

১০. আমলারা পেশাদার হবেন।

আমলাতন্ত্র কি | আমলাতন্ত্র কাকে বলে | আমলাতন্ত্রের সংজ্ঞা দাও

উল্লেখ্য যে, ওয়েবার যদিও আদর্শ-নমুনার আমলাতন্ত্রের কথা বলেছেন, কিন্তু বাস্তবে এ ধরনের আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার খোঁজ পাওয়া অত্যন্ত দুরূহ। বাস্তবিকপক্ষে আধুনিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে আমলাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য গুলো নিচে উল্লেখ করা হলো:

১. স্থায়িত্ব

স্থায়িত্ব আমলাতন্ত্রের প্রথম ও প্রধান বৈশিষ্ট্য। আমলাতন্ত্র একটি স্থায়ী প্রশাসনিক ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় যারা কর্মরত থাকেন তারা সরকারের স্থায়ী ও বেতনভুক্ত কর্মচারী। তারা একটি নির্দিষ্ট বয়সসীমা পর্যন্ত স্থায়ীভাবে পদে আসীন থাকেন।

২. পদসোপান

আমলাতন্ত্রের একটি বিশেষ দিক হলো পদসোপান। এ ব্যবস্থায় পদসোপান নীতি অত্যাবশ্যক। পদসোপানের ভিত্তিতেই প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। এ ব্যবস্থায় অধস্তন কর্মচারী-কর্মকর্তারা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আদেশ নির্দেশ মেনে চলে।

বাংলাদেশে আমলাতন্ত্রের প্রশাসনিক পদসোপানটি হলো-

আমলাতন্ত্রের পদসোপান

৩. নিরপেক্ষতা

আমলাতন্ত্র একটি নিরপেক্ষ প্রশাসন ব্যবস্থা। নিরপেক্ষতা এ ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। আমলাদের পদ রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত নয়। দলীয় রাজনীতির সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক থাকে না। অধ্যাপক লাঙ্কি বলেছেন, ‘আমলারা দল ও রাজনীতির উর্ধ্বে উঠে দেশের সেবা করেন, সরকারের নয়।’

৪. কর্মপরিধি

কর্মপরিধি আমলাতন্ত্রের একটি বিশেষ দিক। আমলাতন্ত্রের একটি নির্দিষ্ট কর্মপরিধি থাকে। কর্মপরিধি অনুসারে প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক কর্মচারী স্ব-স্ব দায়িত্ব পালন করেন। আর এ কর্মপরিধি সরকারি বিধি-বিধানের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়।

৫. পদোন্নতিভিত্তিক

আমলাতন্ত্র একটি পদোন্নতিভিত্তিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা। সরকারি কর্মচারীরা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ পান। নিয়োগের পর দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তাদের পদোন্নতি দেওয়া হয়। পদোন্নতির ক্ষেত্রে সাধারণত জ্যেষ্ঠতা অনুসরণ করা হয়। তবে অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতাও মূল্যায়ন করা হয়।

৬. নিয়মানুবর্তিতা

আমলাতন্ত্র একটি নিয়মানুবর্তি সংগঠন। আমলারা সাধারণত নিয়ম নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে থাকেন। সুনির্দিষ্ট নিয়মের ভিত্তিতেই তাদের কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। বস্তুত নিয়মানুবর্তিতা ছাড়া প্রশাসনিক ক্ষেত্রে গতিশীলতা আসে না। আর প্রশাসনিক গতিশীলতা ছাড়া রাষ্ট্রের উন্নয়ন অসম্ভব।

৭. পরিবর্তনশীল

আমলাতন্ত্র একটি পরিবর্তনশীল ব্যবস্থা। সরকারের পরিবর্তন হলে আমলাদের পদচ্যুতি না ঘটলেও পরিবর্তিত সরকারের সঙ্গে তাদের তাল মিলিয়ে চলতে হয়। অর্থাৎ সরকারের পরিবর্তন ঘটলে তাদের কৌশল পরিবর্তন করে ক্ষমতাসীন দলের নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে শাসনকাজ পরিচালনা করতে হয়।

৮. নিরবচ্ছিন্নতা

আমলাতন্ত্র শাসনব্যবস্থার নিরবচ্ছিন্নতা বজায় রাখে। বিশেষ করে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আমলারা এ দায়িত্ব গুরুত্বের সঙ্গে পালন করেন। এ ব্যবস্থায় সংসদ বিলুপ্ত হয়ে গেলে বা সরকার ভেঙে গেলে পুনরায় নতুন সরকার নির্বাচিত হওয়া পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে আমলারা প্রশাসনিক নিরবচ্ছিন্নতা বজায় রাখেন।

৯. দায়িত্বশীলতা

দায়িত্বশীলতা আমলাতন্ত্রের একটি বিশেষ দিক। সাধারণত দেখা যায়, আমলারা তাদের কাজের জন্য সর্বদা দায়িত্বশীল থাকেন। অধস্তন কর্মচারীরা যেমন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে দায়ী থাকেন, তেমনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আবার মন্ত্রিপরিষদের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। ১০. পরিচয় অজ্ঞাত থাকা: এটি আমলাতন্ত্রের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। আমলাদের পরিচয় সাধারণত অজ্ঞাত থাকে। বস্তুত তারা অজ্ঞাতনামা অবস্থায় দায়িত্ব পালন করেন। সরকারের সফলতা ও ব্যর্থতা তাদের ব্যক্তিগতভাবে স্পর্শ করতে পারে না। আমলারা লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে কাজ করতে পছন্দ করেন। প্রশাসনিক সফলতা ও ব্যর্থতার দায়ভার মূলত মন্ত্রীদেরই বহন করতে হয়।

১১. শৃঙ্খলা

আমলাতন্ত্র একটি সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় শৃঙ্খলাবোধ ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়। আমলারা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য সুশৃঙ্খলভাবে সম্পাদন করে থাকেন।

১২. টেকনিক্যাল দক্ষতা

আমলাতন্ত্রে টেকনিক্যাল দক্ষতা পরিলক্ষিত হয়। সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা টেকনিক্যাল বিষয়ে বেশ দক্ষ হন। তারা শিক্ষা-দীক্ষায় অনেক বেশি অগ্রগামী হওয়াতে তাদের টেকনিক্যাল জ্ঞানও বেশি পরিলক্ষিত হয়। সে কারণে তারা প্রশাসনের অনেক জটিল বিষয় টেকনিক্যালি সহজে সমাধান করে ফেলেন।

১৩. নিয়ন্ত্রিত সংগঠন

আমলাতন্ত্র একটি নিয়ন্ত্রিত সংগঠন। এ সংগঠনকে বিভিন্ন পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে থাকে। আমলাতন্ত্র নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিগুলো হলো প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ, আইনসভা কর্তৃক নিয়ন্ত্রণ, বিচার বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণ ও নাগরিক নিয়ন্ত্রণ।

১৪. প্রশিক্ষণ

প্রশিক্ষণ আমলাতন্ত্রের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক। নিয়োগদানের পর সরকারি কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় এবং সব প্রশিক্ষণ তারা সফলভাবে সম্পাদন করেন। টেকনিক্যাল প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা তাদের চাকরির অন্যতম শর্ত রূপে গণ্য হয়।

১৫. লালফিতার দৌরাত্ম্য

লালফিতার দৌরাত্ম্য আমলাতন্ত্রের একটি বিশেষ দিক। বর্তমানে গতানুগতিক আমলাতন্ত্র মারাত্মকভাবে লালফিতার দৌরাত্ম্যে আবদ্ধ। আর এ লালফিতার দৌরাত্ম্যের কারণে প্রশাসনিক কার্যক্রম বছরের পর বছর ফাইল বন্দি অবস্থায় পড়ে থাকে। এরূপ অবস্থায় প্রশাসনিক জটিলতার সৃষ্টি হয়। ফলে জনকল্যাণ ব্যাহত হয়। তাই অনেক সময় বলা হয় ‘এ ঘটনাও ফাইলের নিচে চাপা পড়ে যাবে।’

১৬. নির্ধারিত বেতনকাঠামো

আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো এ ব্যবস্থায় নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগ্যতা অনুসারে নির্ধারিত হারে বেতন দেওয়া হয়। বেতনের সাথে নানা রকম ভাতা ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধাও জড়িত।

১৭. নৈর্ব্যক্তিক আদেশ

আমলাতন্ত্রের একটি উল্লেখযোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এর নৈর্ব্যক্তিক আদেশ। বস্তুতপক্ষে এ আদেশ বলেই একজন ঊর্ধ্বতন প্রশাসনিক কর্মকর্তা তার অধীন কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে আদেশ প্রদান করে থাকেন এবং তার আনুগত্য লাভ করেন।

১৮. জনকল্যাণ

উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকারের বিপুল পরিমাণ জনকল্যাণকর কাজ সম্পাদনের দায়িত্ব আমলাদের ওপর ন্যস্ত থাকে। তাই স্বাভাবিকভাবেই আমলারাও জনকল্যাণ সাধনকেই তাদের প্রধান কাজ হিসেবে গ্রহণ করেন। তাছাড়া রাষ্ট্রব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে তারা কাজ করেন।

রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রকারভেদ আলোচনা কর

ম্যাক্সওয়েবার আমলাতন্ত্রকে আদর্শ সংগঠন হিসেবে অভিহিত করেছেন। দলীয় সরকারের নীতি ও কর্মসূচি নিরপেক্ষভাবে ও নিষ্ঠার সাথে বাস্তবায়ন করাই আমলাদের মূল দায়িত্ব। তাদের ব্যক্তিগত জীবন আর প্রশাসনিক জীবন সম্পূর্ণ ভিন্ন। পদসোপান নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত আমলাতন্ত্রের কর্মকর্তারা দক্ষতা, যোগ্যতা ও সাফল্যের মাপকাঠিতে পদোন্নতি প্রাপ্ত হন।

আশাকরি, উপরের আলোচনা থেকে আমলাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য গুলো সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা লাভ করেছেন। লেখাটির মাধ্যমে উপকৃত হলে অন্যদের সাথেও শেয়ার করার অনুরোধ রইলো।

Related Posts