Home » জাতীয় সংসদের গঠন ক্ষমতা ও কার্যাবলী আলোচনা কর
জাতীয় সংসদের গঠন ক্ষমতা ও কার্যাবলী,

জাতীয় সংসদের গঠন ক্ষমতা ও কার্যাবলী আলোচনা কর

by Susmi
0 comment

পৃথিবীর প্রতিটি রাষ্ট্রের সংবিধানেই দেশের জন্য আইনসভার ব্যবস্থা সম্পর্কে উল্লেখ থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ভারতের ন্যায় বাংলাদেশের সংবিধানেও আইনসভার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সংবিধানের ৬৫নং অনুচ্ছেদে বলা হয়, আইনানুযায়ী বাংলাদেশের জন্য এককক্ষবিশিষ্ট একটি আইন পরিষদ থাকবে যার নাম জাতীয় সংসদ (House of the Nation)। প্রজাতন্ত্রের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের ওপর ন্যস্ত। রাজধানী ঢাকায় সংসদ ভবন অবস্থিত। আজকের ব্লগে আলোচনা করবো, জাতীয় সংসদের গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলী সম্পর্কে।

জাতীয় সংসদের গঠন

জাতীয় সংসদ ৩০০ জন নির্বাচিত এবং ৫০ জন সংরক্ষিত মহিলা সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পূর্বে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ছিল ৪৫টি। এ সংরক্ষিত আসন জাতীয় সংসদের নির্বাচিত সদস্যদের ভোটের মাধ্যমে পূরণ করা হতো। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংরক্ষিত মহিলা আসন ৫০-এ উন্নীত করা হয় এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত আসনের আনুপাতিক। হারে উক্ত ৫০টি আসন বণ্টন করা হয়। সংসদের কার্যকাল ৫ বছর অর্থাৎ প্রতি ৫ বছর অন্তর নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জাতীয় সংসদ গঠিত এবং পরিচালিত হবে। তবে সংবিধিবদ্ধ কারণে নির্দিষ্ট মেয়াদপূর্তির পূর্বেই রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দিতে পারেন।

বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ানের ইতিহাস আলোচনা কর

সদস্যপদের যোগ্যতা

বাংলাদেশের সংবিধান জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার জন্য প্রার্থীর ক্ষেত্রে কতিপয় শর্তারোপ করেছেন-

ক. তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে।

খ. ন্যূনতম ২৫ বছর বয়স্ক হতে হবে।

তবে উল্লেখ্য, আদালত কর্তৃক ঘোষিত কোনো অপ্রকৃতিস্থ ব্যক্তি, দেউলিয়া, কোনো গুরুতর সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি (মুক্তি লাভের পর ৫ বছর অতিক্রান্ত হলে তিনি সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন), বিদেশি অথবা কোনো বাংলাদেশি অন্য রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করলে এবং কোনো ব্যক্তি প্রজাতন্ত্রের কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকা অবস্থায় নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না।

জাতীয় সংসদের ক্ষমতা ও কার্যাবলি

বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের সংবিধানে সংসদীয় শাসন পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়েছিল। ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতি শাসিত ব্যবস্থা প্রবর্তন করায় জাতীয় সংসদের গুরুত্ব হ্রাস পায়। কিন্তু সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী (১৯৯১) আইনের মাধ্যমে বাংলাদেশে সংসদীয় সরকার পুনঃপ্রবর্তিত হয়। ফলে জাতীয় সংসদের গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পায়। জাতীয় সংসদের ক্ষমতা ও কার্যাবলিকে সাত ভাগে বিভক্ত করে আলোচনা করা হলো। যথা-

১. আইন প্রণয়নমূলক,

২. অর্থবিষয়ক,

৩. নির্বাহী বিভাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ,

৪. নির্বাচনসংক্রান্ত,

৫. বিচারসংক্রান্ত,

৬. সংবিধান সংশোধন এবং

৭. বিবিধ।

নিচে এ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোকপাত করা হলো-

১. আইন প্রণয়নসংক্রান্ত কাজ

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে। ন্যস্ত করা হয়েছে। এ সম্পর্কে সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “জাতীয় সংসদ নামে বাংলাদেশে একটি সংসদ থাকবে এবং এ সংবিধানের বিধানাবলি সাপেক্ষে প্রজাতন্ত্রের আইন প্রণয়নে ক্ষমতা সংসদের ওপর ন্যস্ত হবে।” সংসদ আইনের দ্বারা যেকোনো ব্যক্তিকে বা কর্তৃপক্ষকে আদে বিধি, প্রতিবিধান বা উপ-আইন প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদান করতে পারবে। সরকারি বিজ্ঞপ্তি দ্বারা রাষ্ট্রপতি সংসদ আহ্বান, স্থগিত ও ভঙ্গ করবেন। দুটি অধিবেশনের মাঝে অন্যূন ৬০ দিন বিরতি থাকবে। আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্যে সংসদে আনীত প্রত্যেকটি প্রস্তাব বিল (Bill) আকারে উত্থাপিত হবে। সংসদ কর্তৃক কোনো বিল পাস হওয়ার পর তা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণ করা হবে। রাষ্ট্রপতি ১৫ দিনের মধ্যে তাতে সম্মতি দিবেন। অন্যথায় বিলটি পুনরায় সংসদে ফেরত পাঠাবেন। এছাড়া রাষ্ট্রপতির ফেরত পাঠানে কোনো বিল সংসদে পুনঃবিবেচনার পর আবার রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরিত হলে তিনি ৭ দিনের মধে। তাতে সম্মতি দিবেন। এতে ব্যর্থ হলে ৭ দিন পর তিনি বিলটিতে সম্মতি দিয়েছেন বলে ধরে নেওয়া হবে।

২. অর্থসংক্রান্ত কাজ

জাতীয় সংসদ অর্থের নিয়ন্ত্রক ও অভিভাবক। সংসদের মাধ্যমে করারোপ করা হয় এবং বার্ষিক ব্যয়ের অনুমোদনও জাতীয় সংসদের এখতিয়ারভুক্ত। সংবিধানের ৮৩ অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, সংসদের আইন বা এর কর্তৃত্ব ব্যতীত কোনো প্রকার করারোপ বা কর সংগ্রহ করা যাবে না। ৮৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “সরকারি অর্থের রক্ষণাবেক্ষণ ক্ষেত্রমত সংযুক্ত তহবিলে অর্থ প্রদান বা তা হতে অর্থ প্রত্যাহার কিংবা প্রজাতন্ত্রের সরকারি হিসেবে অর্থ প্রদান বা তা হতে অর্থ প্রত্যাহার এবং উপরিউক্ত বিষয়সমূহের সাথে সংশ্লিষ্ট বা আনুষঙ্গিক সকল বিষয়ে সংসদের আইনের দ্বারা এবং অন্যরূপ আইনের বিধান না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি কর্তৃক বিধিসমূহ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। প্রত্যেক অর্থবছরের জন্য সংসদে বার্ষিক বাজেট পেশ করা হবে। সংযুক্ত তহবিলের ওপর ধার্য ব্যয়সমূহ সংসদে আলোচিত হবে। কিন্তু তার ওপর ভোট গ্রহণ করা যাবে না। আর্থিক ব্যয়ের অন্যান্য অংশ মঞ্জুরি দাবি আকারে সংসদে উত্থাপিত হবে। রাষ্ট্রপতির সুপারিশ ব্যতীত কোনো মঞ্জুরি দাবি করা যাবে না।

৩. শাসন বিভাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ শাসন বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। বাংলাদেশে বর্তমানে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে। এ ব্যবস্থায় সংসদ মন্ত্রিসভাকে নিয়ন্ত্রণ করে। মন্ত্রিসভা একক ও যৌথভাবে আইনসভার কাছে দায়ী থাকে। সংসদের আস্থা হারালে মন্ত্রিসভার পতন ঘটে। সংসদ সদস্যগণ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা, মুলতবি প্রস্তাব, সিদ্ধান্ত প্রস্তাব, নিন্দা প্রস্তাব উত্থাপনের মাধ্যমে সরকারের সমালোচনা করে থাকেন। সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থা হারালে মন্ত্রিসভাকে পদত্যাগ করতে হয়। তবে সংসদে সরকারি দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে সংসদের পরিবর্তে মন্ত্রিসভাই সংসদকে নিয়ন্ত্রণ করে।

৪. নির্বাচনসংক্রান্ত কাজ

জাতীয় সংসদ নির্বাচনসংক্রান্ত দায়িত্বও পালন করে থাকে। সংসদের স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার এবং সংসদের বিভিন্ন কমিটি সংসদ সদস্যগণের দ্বারা নির্বাচিত হয়। বর্তমান ব্যবস্থাধীনে রাষ্ট্রপতি জাতীয় সংসদ সদস্যদের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হবেন।

১৯৭২ সালের সংবিধানের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর

৫. বিচার বিভাগীয় কাজ

প্রজাতন্ত্রের বিচারসংক্রান্ত কাজ যদিও সুপ্রিম কোর্ট ও অধস্তন আদালতের ওপর ন্যস্ত তথাপিও জাতীয় সংসদ কিছু কিছু বিচারসংক্রান্ত কাজ সম্পাদন করে থাকে। যেমন- সংবিধানের কোনো ধারা লঙ্ঘন, গুরুতর অপরাধ বা অসদাচরণের জন্য অথবা দৈহিক ও মানসিক অক্ষমতার কারণে জাতীয় সংসদ রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন (Impeachment)-এর মাধ্যমে অপসারিত করতে পারেন সংসদের দু-তৃতীয়াংশের সমর্থনে। আবার সংসদ ন্যায়পালকেও অনুরূপ অভিযোগের কারণে অপসারণ করতে পারে।

৬. সংবিধান সংশোধন

সংবিধানের বিধান সাপেক্ষে জাতীয় সংসদ সংবিধানের কোনো বিধান বা ধারা সংশোধন করতে পারবে। তবে এরূপ সংশোধনী প্রস্তাব পাসের জন্য মোট সদস্যের দু-তৃতীয়াংশের ভোট প্রয়োজন হয়। ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণীত হওয়ার পর থেকে আজ অবধি সর্বমোট ১৭টি সংশোধনী আনীত ও গৃহীত হয়েছে।

৭. বিবিধ

জাতীয় সংসদ সুপ্রিম কোর্ট ব্যতীত অন্যান্য আদালত প্রতিষ্ঠার জন্য আইন করতে পারে। এছাড়া সরকারি কর্মচারীদের বিচারের জন্য প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল গঠনের ক্ষমতা সংসদ আইনের দ্বারা নির্ধারিত হয়। যুদ্ধ ঘোষণা ও জননিরাপত্তা সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সংসদের ওপর ন্যস্ত। আন্তর্জাতিক চুক্তি ও সন্ধি জাতীয় সংসদ অনুমোদন করবে।

বাংলাদেশে সংসদীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ায় জাতীয় সংসদ সার্বভৌম সংস্থায় পরিণত হয়েছে। দেশের প্রয়োজন ও নাগরিক অধিকারের সাথে সামঞ্জস্য বিধান করে সংসদ আইন প্রণয়ন করে। সংসদ প্রণীত আইন সমগ্র দেশে প্রযোজ্য। সংসদ জাতীয় কর্মকাণ্ডের মূল কেন্দ্রবিন্দু। এ সংসদকে গতিশীল করার জন্য সংসদ সদস্যদের আরও দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন।

আশাকরি, উপরোক্ত আলোচনা থেকে আপনারা জাতীয় সংসদের গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পেয়েছেন।

Related Posts