বঙ্গভঙ্গ রদের কারণ কি?
১৯০৫ সালে ব্রিটিশ সরকার প্রশাসনিক সুবিধার্থে ও রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য যে বঙ্গভঙ্গ করেছিল তা বিভিন্ন কারণে রদ করতে বাধ্য হয়। নিচে বঙ্গভঙ্গ রদের কারণ গুলো আলোচনা করা হলো-
১. হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলন
জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হিন্দু সমাজ বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করে মন্তব্য করেন, বাঙালিরা একটি স্বতন্ত্র জাতি এবং বঙ্গভঙ্গ অযৌক্তিক ও অন্যায়। কলকাতা বুদ্ধিজীবী মহলের নেতৃস্থানীয় স্যার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, বিপিন চন্দ্র পাল, অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখ এ পরিকল্পনাকে বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদ, অযৌক্তিক, অন্যায় ও অহেতুক বলে মন্তব্য করেন। ফলে এর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে।
২. স্বদেশী আন্দোলন
বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধবাদীরা বিলেতি পণ্য বর্জনের মাধ্যমে স্বদেশী আন্দোলন শুরু করে। বিলেতি পণ্য বর্জনের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ কারখানা মালিকদের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করা হয়। ফলে সমস্ত কলকারখানা, শিল্প প্রতিষ্ঠানে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়।
বঙ্গভঙ্গের কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর |
৩. সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড
বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আন্দোলন শুরু হয় হত্যাযজ্ঞের মতো সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। বাংলার গভর্নরকে হত্যার চেষ্টা করা হয় এবং লর্ড মিন্টোর রাজনৈতিক সচিব লন্ডনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। এরূপ অবস্থায় ব্রিটিশ সরকার আতঙ্কিত হয়ে বঙ্গভঙ্গ রদ করেন।
৪. ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলন
ক্রমান্বয়ে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় চরম উত্তেজনাকর খবর ছাপা হতে থাকে এবং শেষ পর্যায়ে তা ‘ব্রিটিশ খেদাও’ আন্দোলনে রূপ নেয়।
৫. বিদ্বেষ পোষণ
উগ্র হিন্দু সম্প্রদায় বঙ্গভঙ্গের কারণে নিজেদের স্বার্থ, মর্যাদা ও আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে ভেবে মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতে থাকে। ফলে বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। উল্লিখিত কারণে ব্রিটিশ সরকার ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর বহুল প্রত্যাশিত বঙ্গভঙ্গকে রদ ঘোষণা করেন।
এগুলোই ছিলো বঙ্গভঙ্গ রদের কারণ ।
ফলে হিন্দু সম্প্রদায় আনন্দ উল্লাস করে আর বিপরীতে মুসলমানগণ হতাশার সাগরে নিমজ্জিত হয়। সুতরাং বলা যায় যে, ব্রিটিশ সরকার নিজেদের প্রয়োজনে এবং পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের স্বার্থরক্ষার জন্য যে ঐতিহাসিক বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা করে তা অঙ্কুরেই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করে আবার বাংলায় গভর্নর জেনারেলের শাসন কায়েম করা হয়। ফলে ব্রিটিশ সরকার মুসলমানদের কাছে বিশ্বাসঘাতক হিসেবেই প্রতিপন্ন হয়।
বঙ্গভঙ্গ রদের ফলাফল
বঙ্গভঙ্গের ফলে মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য সরকারি চাকরি লাভ, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং সর্বোপরি পূর্ব বাংলার সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এক নব দিগন্তের উন্মোচন হয়। কিন্তু বঙ্গভঙ্গ রদ করার ফলে মুসলমানগণ দারুণভাবে ভেঙে পড়ে এবং তারা ব্রিটিশদের প্রতি আনুগত্যের পরিবর্তে বিরাগভাজন হয়ে ওঠে। বঙ্গভঙ্গের সুফল ভোগের পূর্বেই তা রদ করায় ভারতের রাজনীতিতে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় তা নিম্নরূপ-
১. মুসলমানদের হতাশা
বঙ্গভঙ্গের ফলে ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ প্রদেশের রাজধানী ঢাকাকে কেন্দ্র করে উন্নয়নের যে জোয়ার সৃষ্টি হয় তা মুসলমানদের মধ্যে নব উদ্দীপনার সঞ্চার করে। তাদের মধ্যে নব কর্মসাধনা আর সর্বক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধার দ্বার উন্মোচিত হয়। কিন্তু হিন্দুদের তীব্র আন্দোলনের মুখে ব্রিটিশ সরকার যখন বাধ্য হয়ে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণা করেন তখন মুসলমানদের উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ আকাশে কালো মেঘের পাহাড় সৃষ্টি হয়। তারা সার্বিক দিকে হতবিহ্বল হয়ে দুমড়ে মুচড়ে পড়ে।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পটভূমি এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য |
২. ব্রিটিশ সরকারের প্রতি বিরাগভাজন
বঙ্গভঙ্গের ফলে এবং মুসলমানদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সংগঠন মুসলিম লীগ সৃষ্টির মাধ্যমে মুসলমানগণ ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আনুগত্যের নীতি গ্রহণ করে। কিন্তু বঙ্গভঙ্গ রদ করার ফলে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি মুসলমানরা বিরাগভাজন হয় এবং ব্রিটিশ সরকারকে বিশ্বাসঘাতক বলে চিহ্নিত করে।
৩. সাম্প্রদায়িকতার জন্ম
বঙ্গভঙ্গ একদিকে হিন্দুদের ক্ষুব্ধ করে তোলে। অপরদিকে, মুসলমানদের স্বার্থসিদ্ধি ঘটে। কিন্তু ১৯১১ সালে যখন বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয় তখন হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কে চিড় ধরে এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-ফ্যাসাদ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
৪. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা
বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনাকে রদ করার ফলে পূর্ব বাংলার জনগণের মধ্যে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি অনীহা, বীতশ্রদ্ধভাব পরিলক্ষিত হয়। ফলে পূর্ব বাংলার জনগণকে খুশি করার জন্য ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়।
বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনাকে রদ করার ফলে মুসলমানগণ দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। যদিও ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ১৯০৯ সালে মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইনে সর্বপ্রথম মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তবে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখা দেয়। অবশ্য বিংশ শতাব্দীতে এসে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে হিন্দু- মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বঙ্গভঙ্গ রদের ফলস্বরূপ ১৯২১ সালে ব্রিটিশ সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে।
আশাকরি, উপরের আলোচনা থেকে আপনারা বঙ্গভঙ্গ রদের কারণ ও ফলাফল সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছেন। এরকম আরও তথ্যপূর্ণ লেখা পেতে ব্লগটি নিয়মিত পড়ুন।