রাজনৈতিক উন্নয়ন
রাজনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কিত ধারণা প্রসঙ্গে চিন্তাবিদদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। সাধারণভাবে বলা যায় যে, রাজনৈতিক জীবন কাঠামো, কার্যাবলি ও প্রক্রিয়ার পরিবর্তনই হলো রাজনৈতিক উন্নয়ন । পরিবর্তন উন্নয়নের একটি ধাপ। প্রত্যেক পরিবর্তন উন্নয়ন হিসাবে বিবেচিত হয় না। রাজনৈতিক উন্নয়ন হলো এক গতিশীল প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি অবস্থা থেকে আর একটি অবস্থায় উপনীত হওয়া যায়। অনেকের মতানুসারে রাজনৈতিক উন্নয়ন হলো সরকার প্রভাবিত বাঞ্ছিত ও পরিকল্পিত পরিবর্তনের কার্যক্রম। রাজনৈতিক উন্নয়ন বলতে যে পরিবর্তনকে বুঝায়, যা সাধারণত বিশেষ একটি পথে ও আনুপাতিক হারে সংঘটিত হয়। রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে অনেকে রাজনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক নির্ধায়ককেই গুরুত্ব প্রদানের পক্ষপাতী। বাস্তবে এক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণগুলোও বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। সাধারণভাবে উন্নয়ন বলতে সামগ্রিক পরিবর্তন ও উন্নয়নের প্রক্রিয়াকে বুঝায়। রাজনৈতিক উন্নয়ন বলতেও উন্নয়নমূলক পরিবর্তনের প্রক্রিয়াকে বুঝায়। এ হলো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রকৃতি ও সাংগঠনিক ক্ষেত্রে উন্নয়নমূলক পরিবর্তনের প্রক্রিয়া।
রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ কি? রাজনৈতিক আধুনিকীকরণের বৈশিষ্ট্য |
রাজনৈতিক উন্নয়নের সংজ্ঞা
রস্ট্রো ও পাই (Rostow & Pye) এর অভিমত অনুসারে জাতীয় রাজনৈতিক ঐক্য এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণের বিস্তারই হলো রাজনৈতিক উন্নয়নের উদ্দেশ্য। তাঁদের কথায়, “Political development seeks national unity and broading of the base of political participation.” এডওয়ার্ড শিলস (Edward Shils) ও তাঁর ‘On the Comparative Study of New States’ শীর্ষক গ্রন্থে এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, রাজনৈতিক বিষয়ে ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ হলো রাজনৈতিক উন্নয়নের একটি বিশেষ লক্ষণ। রস্ট্রোর মতানুসারে শিল্পোন্নত দেশগুলো অন্যান্য দেশের সামনে রাজনৈতিক উন্নয়নের মান স্থাপন করে। এই সমস্ত দেশের রাজনৈতিক উন্নয়নের ভিত্তি রচিত হয় শিল্পোন্নত দেশসমূহ উদ্ভাবিত রাজনৈতিক আচরণ ও প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম-নীতির মাধ্যমে।
এ প্রসঙ্গে কার্ল ডয়েটস (Karl Deutsch) ও অনুরূপ অভিমত পোষণ করেন। ‘Social Mobilization and Political Development’ শীর্ষক গ্রন্থে তিনি মন্তব্য করেছেন যে, “সমকালীন রাজনৈতিক ব্যবস্থার উন্নয়নের উপায় বলতে পশ্চিমা শিল্পোন্নত দেশসমূহের রীতিনীতি ও পন্থা-পদ্ধতিকে বুঝায়।” তিনি সকল সমাজের রাজনৈতিক বিকাশ বা উন্নয়নের উদাহরণ হিসাবে পাশ্চাত্যের শিল্পসম্পদের আধুনিক প্রতিষ্ঠানসমূহের কথা বলেছেন।
ড্যানিয়েল লার্নার (Deniel Larner) তাঁর ‘The Passing of the Traditional Societies’ শীর্ষক গ্রন্থে এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, “পাশ্চাত্যের উন্নয়ন সম্পর্কিত মডেলটি হলো সর্বজনীন।” পাশ্চাত্যের এই মডেলের মাধ্যমে উন্নয়নের কতকগুলো লক্ষণ সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়। সকল সমাজ সম্পর্কেই এই সমস্ত লক্ষণ প্রযোজ্য। অনেকে আবার সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ার পর্যালোচনার পক্ষপাতী।
হেগান (Hagan)-এর মতানুসারে, রাজনৈতিক উন্নয়ন বা বিকাশ হলো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বা প্রক্রিয়ার বিকাশ, যার ফলে বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা সমকালীন মৌলিক সমস্যাদির সঙ্গে অধিকতর সক্রিয়ভাবে মোকাবিলা করতে পারে এবং দীর্ঘকালীন বিচারে রাজনৈতিক যামানা জনসাধারণের চাহিদার প্রতি সুবিচার করতে পারে।
অ্যালফ্রেড ডায়ামন্ট (Alfred Diamont)-এর অভিমত অনুসারে রাজনৈতিক উন্নয়ন্ হলো এমন এক প্রক্রিয়া, যা ক্রমবর্ধমান সামাজিক সমস্যাসমূহের সমাধানের স্বার্থে প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক পরিকাঠামো গড়ে তোলে। আইসেন্টস্টাড (Eisentstadt)ও অনুরূপভাবে মনে করেন যে, সব রকম নতুন ধরনের রাজনৈতিক চাহিদা ও সংগঠনের সঙ্গে সামঞ্জস্য সাধনের ব্যাপারে রাজনৈতিক ব্যবস্থার সক্ষমতাই হলো রাজনৈতিক বিকাশ বা রাজনৈতিক উন্নয়ন।
রাজনৈতিক সামাজিকীকরণের মাধ্যম সমূহ আলোচনা কর |
এ প্রসঙ্গে অ্যালমন্ড (G. A. Almond)-এর অভিমত হলো, “Political development is the acquision of new capability, in the sense of a specialised role, structure and differentiated orientation which together give a political system the range of problems.” উন্নয়নের লক্ষণ হিসাবে তিনি ব্যক্তিবর্গের বিশ্বাস বা মনোভাব, সামর্থ্য, পরিবেশ প্রভৃতির কথা বলেছেন।
রাজনৈতিক উন্নয়নের ধারণাটিকে সহজ, সরল ও সাধারণভাবে বিচার বিশ্লেষণ করা যায়। ঈঙ্গ-মার্কিন মডেলের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়নের সঙ্গে রাজনৈতিক উন্নয়নের ধারণা সম্পর্কযুক্ত। এদিক থেকে বিচার বিবেচনা করলে রাজনৈতিক উন্নয়ন্ হলো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার যাবতীয় বৈশিষ্ট্য বা উপাদানের প্রতিষ্ঠা ও স্থায়িত্ব সম্পাদন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার এই সমস্ত বিষয়াদির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: রাজনৈতিক স্থায়িত্ব, সুষ্ঠু ও স্বাধীন নির্বাচন ব্যবস্থা, শান্তিপূর্ণ পরিবর্তনের সুযোগ- সুবিধা, আদালত ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, আইনের অনুশাসন, দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় গণ অংশগ্রহণ প্রভৃতি। রাজনৈতিক উন্নয়নের বিপরীত প্রক্রিয়া হলো রাজনৈতিক অবক্ষয়। রাজনৈতিক অবক্ষয়ের ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবক্ষয় ঘটে। মোটকথা রাজনৈতিক জীবন, কাঠামো কার্যাবলি ও প্রক্রিয়ার পরিবর্তন রাজনৈতিক উন্নয়ন হিসাবে বিবেচিত হয়।