Home » রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ আলোচনা কর
রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ

রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ আলোচনা কর

by Susmi
0 comment

রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান হলো একটি বিকাশমান আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের শাখা, যেটি মূলত সমাজবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংমিশ্রণে গঠিত। ম্যাকিয়াভেলীর “The Princh’ গ্রন্থটি যেমন রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে আধুনিক করেছে তেমনি আধুনিক সমাজতত্ত্বের যাত্রা শুরু হয় Auguste Comte-এর হাত ধরে। তবে রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব ও বিকাশ একদিনে সম্ভব হয় নি। বিভিন্ন বিষয় এর উদ্ভব ও বিকাশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল। অধিকন্তু বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে এবং বিভিন্ন মনীষীদের প্রচেষ্টার ফসল হিসেবে এ বিজ্ঞানটি বর্তমান পর্যায়ে উপনীত হয়েছে।

রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান বলতে কি বুঝ | রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের সংজ্ঞা দাও

এ প্রেক্ষাপটে নিম্নে এর উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ পর্যায়ক্রমিকভাবে আলোচনা করা হলো-

প্রাচীন যুগ

রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের উৎপত্তি প্রসঙ্গে প্রাচীন যুগ বেশি আলোচিত। প্রাচীন যুগে Plato Aristotle এর চিন্তাধারায় রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তাঁরা রাষ্ট্র ও সমাজ সম্পর্কে যুক্তিসঙ্গত ও ফলপ্রসূ আলোচনা করেছেন। রাষ্ট্র, সমাজ ও সরকার সম্পকে যুক্তিনিষ্ঠ ধারণা ব্যক্ত করেছেন এবং রাষ্ট্রের সামাজিক ভিত্তির উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তাদের এ ধরনের চিন্তাধারা রাজনৈতিক সমাজচিন্তাকে ত্বরান্বিত করেছে।

মধ্যযুগ

মধ্যযুগে রাষ্ট্রব্যবস্থায় চার্চের প্রাধান্য ছিল। চার্চের প্রধান ছিল পোপ। আর এ সময় চার্চ ও পোপের কর্তৃত্বের প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। পোপের নির্দেশে সমাজব্যবস্থা পরিচালিত হতো। পোপের নির্দেশ অমান্য করার কোনো সুযোগ ছিল না। পোপের মতবাদ ও ধারণা সর্বজন স্বীকৃত ছিল। এক পর্যায়ে পোপের ক্ষমতার উৎস, মর্যাদা ও সামাজিক স্বীকৃতি সম্পর্কে চিন্তাধারা শুরু হয়, যা এর উত্তবে সহায়তা করে।

ফরাসি বিপ্লবের প্রভাব

১৭৮৯-১৭৯৯ সালের মধ্যে সংঘটিত ফরাসি বিপ্লব ছিল মানব ইতিহাসের প্রথম রাজনৈতিক বিপ্লব। মানবসমাজের মধ্যে প্রোথিত রাজনৈতিক চেতনার বিস্ফোরণ এ বিপ্লবের মাধ্যমে মানব ইতিহাসে প্রথম প্রকাশিত হয়। ‘সাম্য’, ‘মৈত্রী’ ও ‘স্বাধীনতার’ দাবিতে সাধারণ মানুষ এ বিপ্লবের মাধ্যমে প্রথম তাদের সামাজিক অধিকার আদায়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করে। ফলে রাজনৈতিক-সামাজিক চেতনা বিকাশে এ বিপ্লবের ভূমিকা অনেক।

শিল্পবিপ্লবের প্রভাব

১৭৬০ থেকে ১৮৫০ সালের মধ্যে সংঘটিত শিল্পবিপ্লব রাজনৈতিক চিন্তাধারাকে আরো শাণিত করেছে। শিল্পবিপ্লবের পরিণতি হিসেবে কতকগুলো বিষয়ের অবসান ঘটে এবং কালক্রমে সামাজিক বিজ্ঞানের উপর সামাজিক বিপ্লবের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। এ সময় শিল্পবিপ্লব সামাজিক বিপ্লবে রূপ নেয়। ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন সূচিত হয়। বিভিন্ন সামাজিক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। তার ফলে সুনির্দিষ্ট সামাজিক বিষয়াদি সম্পর্কে আলোচনার প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে প্রতিপন্ন হয়। এ ধরনের প্রচেষ্টার পরিপ্রেক্ষিতে একটি গবেষণালব্ধ ও অভিজ্ঞতালব্ধ সামাজিক বিজ্ঞান হিসেবে রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে।

কার্ল মার্কসের অবদান

রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব ও সংগঠিত হওয়ার পেছনে জার্মান দার্শনিক ও মনীষী কার্ল মার্কসের অবদান অনস্বীকার্য। তিনিই সর্বপ্রথম রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের কথা বলেন। হেগেলীয় রাষ্ট্রদর্শনের মার্কসীয় সমালোচনা ইতিহাসের মার্কসীয় বস্তুবাদ এবং শ্রেণিসংগ্রাম ইত্যাদি বিষয়ে রাজনৈতিক সমাজতত্ত্বের ধারণার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। মার্কসের মতে, রাষ্ট্র কখনো সামাজিক ও অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বের উর্ধ্বে যেতে পারে না। কেননা সামাজিক, অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব থেকেই রাষ্ট্রের উৎপত্তি, যার উপর ভিত্তি করে তিনি মৌল কাঠামো ও উপরি কাঠামোর কথা বলেছেন এবং প্রদান। করেছেন শ্রেণিসংগ্রাম, উদ্বুদ্ধ মূল্য ও বিচ্ছিন্নতা বোধের ধারণা। আর এগুলোর মধ্যেই নিহিত রয়েছে রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের মূল।

ম্যাক্স ওয়েবার

রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব ও বিকাশের ক্ষেত্রে জার্মান সমাজবিজ্ঞানী মাক্স ওয়েবারের নাম। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থে যে সমস্ত ধারণা ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ প্রদান করেছেন তা রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানকে আরো সমৃদ্ধশালী করেছে। তিনি তাঁর “The Protestant Ethice and the Spirit of Capitalism’ নামক গ্রন্থে সমাজ ও রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত বিভিন্ন বিষয় ব্যাখ্যা করেছেন। অধিকন্তু তিনি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে রাষ্ট্রের সাথে সম্পৃক্ত ক্ষমতা ও রাজনীতি সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। তার মতে, ক্ষমতা রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত এবং ক্ষমতার সাথে যখন বৈধতাযুক্ত হয় তখন তা কর্তৃত্বে পরিণত হয়। এভাবে রাজনীতির ধারণা ওয়েবারের হাতে নতুন রূপ লাভ করে, যা সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

টক্ভিল

ফরাসি চিন্তাবিদ টক্ভিল ছিলেন কার্ল মার্কস ও ম্যাক্স ওয়েবারের একজন সমসাময়িক চিন্তাবিদ। তার দুটি বিখ্যাত গ্রন্থ হলো, ‘Democracy in America’ এবং ‘The Old Regime and the French Revolution’ যেগুলোতে সামাজিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়া ও প্রকৃতি সম্পর্কে নতুন ধ্যানধারণার আভাস পাওয়া যায়।

রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের প্রকৃতি আলোচনা কর

এলিট তত্ত্ব

রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব ও বিকাশের ক্ষেত্রে এলিটতত্ত্বের অপরিসীম অবদান রয়েছে। কেননা এই এলিটতত্ত্ব রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের পরিধিকে প্রসারিত করেছে। এক্ষেত্রে Vilfredo Pareto এবং Gaetno Mosca- এর অবদান গুরুত্বপূর্ণ। তারা এলিটের চক্রাকার আবর্তন তথা পালাবদলের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তনের বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন। তাদের মতে, এলিট শ্রেণির আবর্তন বা পালাবদলের প্রভাব প্রতিক্রিয়া হিসেবে বাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটে।

ওয়ালটার বেজহট

রাজনৈতিক ধারণার ক্ষেত্রে কার্ল মার্কসের সমকালীন এক চিন্তাবিদ হলেন ওয়ালটার বেজহট। ১৮৬৭ সালে প্রকাশিত তাঁর রচিত ‘English Constitution’ এবং ১৮৭২ সালে প্রকাশিত ‘Physics of Politics’ নামক গ্রন্থে তিনি ব্যক্তিবর্গের আচরণ ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে এবং সংস্কৃতি ও ব্যক্তিত্বের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণের ব্যাপারে যত্নবান হয়েছেন, যা রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছে।

পশ্চিমা চিন্তাবিদদের অবদান

রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব ও বিকাশের ক্ষেত্রে পশ্চিমা চিন্তাবিদদের অবদানও অপরিসীম। তারা ছিলেন অধিকতর বাস্তববাদী এবং এই শ্রেণির দার্শনিকরা বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয়াদি সম্পর্কে অভিজ্ঞতাবাদী গবেষণা কার্যে উদ্যোগী হন। এ ধরনের গবেষণায় সমাজতাত্ত্বিক ধ্যানধারণা এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক আচরণ সম্পর্কে নতুন নতুন দিক উন্মোচিত হয়। আর এই সমস্ত গবেষণা প্রসূত বিষয় বা উপাদান রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের আলোচনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়।

রবার্ট মিশেলস

রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের পরিপূর্ণতার ক্ষেত্রে ইতালীয় সমাজবিজ্ঞানী রবার্ট মিশেলস-এর অবদান অনস্বীকার্য। কেননা তিনি তার প্রজ্ঞা ও মননশীলতার দ্বারা রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের সামনে নতুন দিগন্তের দ্বার খুলে দেন। তিনি তাঁর ‘First Lecture in Political Sociology’ তে ক্ষমতা রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তার মতে রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা কতিপয় ব্যক্তির হাতে সীমাবদ্ধ থাকে এবং প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের মধ্যেই এই প্রবণতা বিদ্যমান থাকে।

রুশ বিপ্লবের প্রভাব

মানব ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিপ্লব হলো রুশ বিপ্লব। ১৯১৭ সালে সংঘটিত এ বিপ্লবের মাধ্যমে মানব সভ্যতার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান অধ্যয়নের জন্য নতুন উপাদান খুঁজে পায়, এ বিপ্লব রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব ও বিকাশের পথে নতুন বাঁক নিয়ে আসে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী

এই পর্বের সমাজবিজ্ঞানীরা রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হন। তথা চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী, সামাজিক সংগঠন, সামাজিক কার্য প্রক্রিয়া, ব্যক্তিত্ব ও রাজনৈতিক আচরণ, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক সংস্কৃতি, রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ প্রভৃতি, যা রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানকে পরিপূর্ণতা দান করে। এক্ষেত্রে লিপসেট, নিউম্যান, আর্থার ব্যান্টলি, চার্লস মেরিয়াম, হ্যানস গার্থ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অভাবনীয় অগ্রগতি ঘটে। বৌদ্ধিক জগতের উপর উন্নত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ইতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এই সময় পশ্চিমা দার্শনিকরা তাত্ত্বিক পরিমণ্ডলের বাইরে এসে বৈজ্ঞানিক ও অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রাজনৈতিক বাস্তবতার বিষয়ে আলোচনার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠেন। ফলে চিন্তাবিদদের মধ্যে সমাজতাত্ত্বিক গবেষণা ও ব্যাখ্যার প্রতি বিশেষ আগ্রহ দেখা দেয়। এর ফল শ্রুতিতে বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের বিস্তার লাভ ঘটে।

এছাড়াও ওয়াল্টার লিপম্যান, হ্যারল্ড ডি.ল্যাসওয়েল, ডেভিড ইস্টন, হ্যানা অ্যারিদিভ, নিমুর মার্টিন লিপসেট, সিগমন্ড ফ্রয়েড প্রমুখ দার্শনিক ও চিন্তাবিদ এর উদ্ভব ও বিকাশের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন।

সুতরাং উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, সামাজিক বিজ্ঞান মাত্রই গতিশীল যা রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আর এ বিজ্ঞানটি হলো একটি দ্রুত বিকাশমান বিষয়। সময়ের প্রেক্ষাপটে এটি নানাভাবে সমাজবিজ্ঞানীদের গবেষণার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করছে, যার ফলশ্রুতিতে এর কলেবর দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

Related Posts