একমালিকানা ব্যবসায়ের সুবিধা যেমন আছে তেমনি কিছু অসুবিধাও লক্ষ্য করা যায়। নিচে এগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
একমালিকানা ব্যবসায়ের সুবিধা
প্রাচীনকাল হতে আধুনিককাল পর্যন্ত সমান জনপ্রিয়তায় একমালিকানা ব্যবসায় টিকে আছে। তাই। এর বহুবিধ সুবিধা রয়েছে। নিচে এগুলো আলোচনা করা হলো-
১. সহজ গঠন
একমালিকানা ব্যবসায় গঠনে কোনো আইনগত বাধা-নিষেধ নেই। তাই যে কোনো ব্যক্তি প্রয়োজনীয় মূলধন সরবরাহ সাপেক্ষে এ ব্যবসায় গঠন করতে পারে। তবে অনুরূপ ব্যবসায়কে অবশ্যই প্রচলিত আইন অনুসারে বৈধ হতে হয়।
২. মুনাফার একক মালিক
এ ব্যবসায়ের মালিক এককভাবে অর্জিত মুনাফা ভোগ করেন। এজন্য মালিক সব সময় অধিক মুনাফা অর্জনের চেষ্টা করেন। ফলে ব্যবসায়ে সাফল্য আসে।
একমালিকানা ব্যবসায় কাকে বলে? একমালিকানা ব্যবসায়ের বৈশিষ্ট্য গুলো কি কি? |
৩. সহজ পরিচালনা
ক্ষুদ্র আয়তনের ব্যবসায় বিধায় এরূপ ব্যবসায় পরিচালনার জন্য মালিককে মোটেও বেগ পেতে হয় না। তাছাড়া ব্যবসায়ের প্রয়োজনে দুই একজন কর্মচারী নিয়োগ করলেও মালিক নিজেই তত্ত্বাবধান করতে পারেন।
৪. মিতব্যয়িতা
মালিক নিজেই সব ধরনের খরচ এবং কাজ-কর্মের তদারকি করায় এ কারবারে মিতব্যয়িতা অর্জন সম্ভব হয়।
৫. অসীম দায়ের পরোক্ষ ফল
এরূপ ব্যবসায়ে মালিকের দায় অসীম বিধায় মালিক বিশেষ সতর্কতা, মিতব্যয়িতা ও দক্ষতার সাথে ব্যবসায় পরিচালনায় নিজেকে নিয়োজিত রাখেন।
৬. গোপনীয়তা রক্ষা
অন্য যে কোনো প্রকার ব্যবসায় সংগঠনের চেয়ে একমালিকানা ব্যবসায় অধিক মাত্রায় গোপনীয়তা রক্ষা করা যায়।
৭. সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা
মালিক নিজেই ব্যবসায়ে সার্বিক ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণ করেন বলে ব্যবসায়ের ব্যবস্থাপনার কার্য সুশৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন করা যায়।
৮. অপচয় রোধ
মালিক সরাসরি সকল কাজের তদারকির দায়িত্বে থাকায় এ ব্যবসায়ের পণ্যদ্রব্যের অপচয় রোধ করা সম্ব হয়। ১. সরাসরি তত্ত্বাবধান: একমালিকানা ব্যবসায়ে মালিক সব কাজকর্ম সরাসরি সার্বক্ষণিকভাবে নিজেই তত্ত্বাবধান করে থাকেন। এর ফলে বহু ভুলত্রুটি ও ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব হয়।
১০. দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ
মালিক ভিন্ন অন্য কোনো ব্যক্তির মতামত নিতে হয় না বলে যে কোনো সিদ্ধান্ত অতি দ্রুত কার্যকর করা সম্ব হয়।
১১. মালিকের স্বাধীনতা
এ ব্যবসায়ে মালিক নিজেই নিজের কর্তা, তিনি অন্য কারও অধীনস্থ নন। তাই ব্যবসায়ের কাজকর্মের জন্য অন্য কারো কাছে জবাবদিহি করতে হয় না।
১২. স্বল্প মূলধনের ব্যবসায়
স্বল্প মূলধন নিয়ে যে কোনো স্থানে একমালিকানা ব্যবসায় গড়ে তোলা সম্ব। এতে যে কেউ অতি সহজেই এ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠা করতে পারেন।
১৩. নমনীয়তা
এ ব্যবসায়ের মালিক ক্রেতার রুচি ও চাহিদা মোতাবেক ব্যবসায় পরিচালনার নীতি ও পদ্ধতি সহজেই পরিবর্তন করে দ্রুত সাফল্য অর্জন করতে পারেন।
১৪. অধিক ঋণের সুযোগ
এরূপ ব্যবসায়ের দায় অসীম এবং মালিকের ব্যক্তিগত সম্পত্তি এ ঋণের জন্য দায়ী থাকে বদে ব্যবসায়ের পক্ষে ঋণ গ্রহণ সহজ হয়।
১৫. হিসাবরক্ষণের সুবিধা
হিসাবরক্ষণের ক্ষেত্রে আইনগত কোনো বাধ্যবাধকতা নেই বলে মালিক তার সুবিধামতো যে কোনো হিসাব সংরক্ষণ করতে পারেন।
১৬. করের সুবিধা
এক্ষেত্রে মালিক ও ব্যবসায়কে অভিন্ন সত্তা বিবেচনা করা হয়। ফলে করযোগ্য আয় হলে মাসিক কর প্রদান করলেই চলে, ব্যবসায়কে আলাদা কর দিতে হয় না।
১৭. ভোক্তাদের সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ
পণ্য বণ্টন প্রণালির সর্বশেষ ধাপ হলো খুচরা ব্যবসায়। এই ব্যবসায় মালিক এবং ক্রেতার মধ্যে প্রত্যক্ষ যোগাযোগের মাধ্যমে তাদের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায়।
১৮. সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত
গঠন ও পরিচালনায় একমালিকানা ব্যবসায়কে কোনো নির্দিষ্ট আইন অনুসরণ করতে হয় না বলে এটি সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত।
১৯. সামাজিক কল্যাণসাধন
এ জাতীয় ব্যবসায় দেশের শহর বা প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের জনগণের চাহিদা মোতাবেক পণ্যদ্রব্য তাদের হাতে পৌঁছে দিয়ে মানুষের কল্যাণসাধন করে থাকে।
২০. সহজ বিলোপসাধন
একমালিকানা ব্যবসায়ের বিলোপসাধন অত্যন্ত সহজ। কোনো রকম আইনগত আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই মালিক নিজ প্রয়োজন ও ইচ্ছানুসারে এর বিলোপ ঘটাতে পারেন।
পরিশেষে বলা যায়, আলোচিত সুবিধাবলির কারণেই আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত একমালিকানা ব্যবসায় অত্যন্ত জনপ্রিয়তার সাথে সংগঠিত ও পরিচালিত হয়ে আসছে।
একমালিকানা ব্যবসায়ের অসুবিধা
একমালিকানা ব্যবসায়ের অত্যধিক আর্থ-সামাজিক গুরুত্ব ও সুবিধাদি থাকা সত্ত্বেও এর নিম্নোক্ত অসুবিধাগুলো লক্ষ করা যায়:
১. ‘অসীম দায়
একমালিকানা ব্যবসায়ের দায় অসীম, তাই প্রয়োজনবোধে ব্যবসায়ের দায় দেনা পরিশোধের জন্য ব্যক্তিগত সম্পত্তি খোয়াতে হয়।
২. সীমিত পুঁজি
এক ব্যক্তির সরবরাহকৃত পুঁজির দ্বারাই এ ব্যবসায় সংগঠিত হয়। এক ব্যক্তির পুঁজি সরবরাহের ক্ষমতাও থাকে সীমিত। এতে ব্যবসায়ের সম্প্রসারণ বিঘ্নিত হয় এবং অর্জিত মুনাফার পরিমাণ কম হয়।
৩. পৃথক ব্যক্তিসত্তার অভাব
একমালিকানা কারবারে পৃথক ব্যক্তিসত্তা নেই। কারণ অনুরূপ প্রতিষ্ঠান আইনসৃষ্ট নয়। এর জন্য মামলা মোকদ্দমা মালিকের নামেই হয়ে থাকে।
৪. আইনগত অস্তিত্বের অভাব
কোনো আইনের আওতায় এ ব্যবসায় সংগঠিত হয় না। তাই এর কোনো আইনগত অস্তিত্ব নেই।
৫. সীমিত আয়তন
এ ব্যবসায়ের মালিকের পুঁজি, কর্মদক্ষতা, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি সবই সীমিত। তাই এ ধরনের ব্যবসায়ের আয়তন সাধারণত ছোট হয় এবং প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে না।
৬. সম্প্রসারণের সীমিত সুযোগ
একমালিকানা ব্যবসায়ের পুঁজি, মালিকের দক্ষতা, কর্মী সংখ্যা ইত্যাদি কম হওয়ায় সম্প্রসারণের সুযোগ খুব কম।
৭. স্থায়ীত্বের অভাব
এ জাতীয় ব্যবসায়ের স্থায়ীত্বের কোনো নিশ্চয়তা নেই। মালিকের মৃত্যু, শারীরিক অসুস্থতা, দেউলিয়াত্ব, ইত্যাদি কারণে যে কোনো সময় এটির অবসান ঘটতে পারে।
৮. মালিকের একক ঝুঁকি বহন
এ ব্যবসায়ের যাবতীয় ঝুঁকি এককভাবে মালিককেই বহন করতে হয়। সঠিকভাবে ব্যবসায় পরিচালনায় ব্যর্থ হলে মালিককেই সব ক্ষতিপূরণ করতে হয়।
ব্যবসায়ের সামাজিক দায়িত্ব বলতে কি বুঝায়? এ দায়িত্ব সমূহ কি কি? |
৯. কর্মীদের সীমিত সুযোগ-সুবিধা
ছোট আকারের এ ব্যবসায়ের কর্মীদের সুযোগ-সুবিধার পরিমাণ অনেক কম থাকে। তাদের পদোন্নতি, বেতন ভাতা বৃদ্ধি ইত্যাদির সম্ভাবনা কম থাকে।
১০. সীমিত ক্ষেত্র
একমালিকানা ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা আছে। কম পুঁজি এবং মালিকের সীমিত দক্ষতা ও পরিচালন ক্ষমতার আওতার মধ্যেই এ ধরনের ব্যবসায় সংগঠনের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকে।
১১. বৃহদায়তন ব্যবসায়ের সুযোগ-সুবিধার অভাব
একমালিকানা ব্যবসায় বৃহদায়তন ব্যবসায়ের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারে। না। ফলে উৎপাদন বা আনুষঙ্গিক ব্যয় বৃদ্ধি পায় ও লাভের হার কম হয়।
১২. কর ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা
এর ধরনের ব্যবসায়ের আয়ের জন্য ব্যক্তিগতভাবে মালিককেই কর দিতে হয়। তাই কম পরিমাণ কর পরিশোধের জন্য এর মালিক সবসময় সচেষ্ট থাকে।
১৩. কম সামাজিক মর্যাদা
আইন স্বীকৃত অস্তিত্ব না থাকার কারণে অংশীদারি ব্যবসায়, যৌথ মূলধনী ব্যবসায়, সমবায় ব্যবসায় ইত্যাদির ন্যায় এর ব্যবসায়ের সামাজিক মর্যাদা কম।
১৪. মালিকের খামখেয়ালিপনা
একমালিকানা ব্যবসায়ের মালিকের খামখেয়ালিপনার জন্য ব্যবসায়ের কর্মচারী, ক্রেতা, সরবরাহকারী সকলেরই ক্ষতি হয়।
পরিশেষে বলা যায় যে, সুবিধার তুলনায় এ ব্যবসায়ের অসুবিধাগুলো তেমন কোনো গুরুত্বই বহন করে না। মালিক নিজ দক্ষতা, ব্যক্তিত্ব, প্রচেষ্টা, বুদ্ধিমত্তা ও বিশেষত্ব, পরামর্শের দ্বারা সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার মাধ্যমে সহজেই পূর্বোক্ত অসুবিধাগুলো দূর করতে পারেন।’