আজকের লেখায় আমরা জনমত কি, জনমত কাকে বলে ও জনমতের সংজ্ঞা সম্পর্কে জানবো।
জনমত কি বা কাকে বলে
সাধারণ অর্থে ‘জনমত’ বলতে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মতামতকেই বোঝায়। কিন্তু পৌরনীতি ও সুশাসনে জনমতকে এক বিশেষ অর্থে ব্যবহার করা হয়। যেকোনো জাতীয় প্রশ্নে বিভিন্ন শ্রেণি বা স্বার্থকামী মহল বিভিন্ন মত পোষণ করতে পারে। এভাবে মতামত বিভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হওয়ার সময় কোনো কোনো মত অন্যগুলোর তুলনায় প্রবলতর হয়ে দাঁড়ায়। এই প্রবলতর অভিমতগুলোকে জনমত হিসেবে আখ্যা দেওয়া যায়। জনমত সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী, যুক্তিযুক্ত ও কল্যাণকর। আবার শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত জনমত বলে স্বীকৃত হবে এ কথাও বলা যায় না। সংখ্যার চেয়ে আস্থার দৃঢ়তা জনমত গঠনে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
ক্ষমতার ভারসাম্য নীতি কি? – ব্যাখ্যা কর |
জনমতের সংজ্ঞা
এল. ডব্লিউ, ডুব (L.W. Doob)-এর মতে, ‘একই সামাজিক সংগঠনের সদস্য হিসেবে কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে জনগণের মতামতই জনমত।’ (Public opinion refers to people’s attitudes on an issue when they are members of the same social groups.)
জনমত সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ভিওকি (V. O. Key) মন্তব্য করেছেন, ‘লোকের সেই মতামতকেই জনমত বলা যেতে পারে যা সরকার অগ্রাহ্য করা সমীচীন মনে করে না।’
অধ্যাপক গেটেল (Gettel) জনমতের ক্ষেত্রে দৃঢ়তার বিষয়টির ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তার মতে, ‘কতজন ব্যক্তি একটি বিষয়ে মত পোষণ করেছে তা বড় কথা নয়- তার চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ হলো সেই মতের দৃঢ়তা।’
অস্টিন রেনি (Austin Ranney) জনমত সম্পর্কে অনেক বেশি কার্যকর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘জনমত হলো বিভিন্ন ব্যক্তির মতামতের সমষ্টি যার সম্পর্কে সরকারি কর্মীবৃন্দ সজাগ থাকে এবং সরকারি দায়িত্ব পালনের জন্য মনোযোগী হয়।’
কিম্বল ইয়ং (Kimball Young) বলেছেন, ‘একটি নির্দিষ্ট সময়ে জনগণ যে মতামত পোষণ করে তাই জনমত।’ (Public opinion consists of the opinion held by a public at a certain time.)
অধ্যাপক লাওয়েল (Prof. Lawell) যথার্থই বলেছেন, ‘জনমতের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠতাই যথেষ্ট নয় এবং সকল বিষয়ে ঐকমত্যেরও প্রয়োজন নেই।’ অধ্যাপক ই এম সুইট (Prof. E M Suit) বলেছেন, ‘জনমত বলতে আমরা কী বুঝি সে সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করা উচিত নয়। দীর্ঘকালের প্রতিষ্ঠিত রীতিনীতি অনুসারে আমরা জনমত বলতে এটাই বুঝি যে, সমগ্র সম্প্রদায়ের মতামত জনগণের মতামত’। (There should be no questions about what we mean by calling public opinion. We mean, in the light of long established usage, that is the opinion of the community, the opinion of the people.)
জনমতের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে লর্ড ব্রাইস (Lord Bryce) বলেছিলেন, ‘সমাজ বা রাষ্ট্র সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং দৃঢ় অভিমতই হলো জনমত। সামগ্রিক কল্যাণ সাধন করে বলে অধিকাংশ ব্যক্তি এটিকে স্বীকার করে নেয়।’ (The term Public opinion is commonly used to denote the aggregate of the views men hold regarding matters that affect or interest the community.)
সমাজবিজ্ঞানী মরিস জিন্সবার্গ (Morris Ginsberg) বলেন, ‘জনমত হচ্ছে সমাজে বসবাসকারী মানুষের ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার ফল।’
জনমতের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো |
জনমতের ধারণার ক্ষেত্রে দেখা যায়, তাত্ত্বিকগণ এ সম্পর্কে একমত হতে পারেননি। এসব সমস্যার ফলে আধুনিক জনমততাত্ত্বিকগণ মনে করেন, জনমত হতে হলে সংখ্যাগরিষ্ঠের মত হতে হয় না। কোনো একটি মত প্রাধান্য বিস্তার করলে বা সবাই মেনে নিলে সেই মতকে জনমত বলে। গ্রাহ্য বা গণ্য হবে এ ধারণাও সঠিক নয়। যেকোনো একটি মতও জনমত হতে পারে যদি মতটি রাজনীতির ক্ষেত্রে সক্রিয় হয়। জনমত যদি রাজনীতির ক্ষেত্রে সক্রিয় না হয় তবে জনমত কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। নব্বই-এর দশকে বাংলাদেশে স্বৈরাচার বিরোধী জনমত গঠিত হতে থাকে এবং সংসদীয় সরকার গঠনের ক্ষেত্রে জনমত গঠিত হয়। এ জনমত কার্যকর করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আন্দোলন। ব্যাপকভাবে পরিচালিত হয়। এর ফলে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি হয় এবং স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটে।
পাশাপাশি সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়। জনমত যে শুধু রাজনৈতিক ইস্যুতেই গঠিত হবে এমন কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য ইস্যুতেও জনমত গঠিত হতে পারে। যেমন- দুর্নীতি, এইডস, পরিবেশ সচেতনতা ইত্যাদি।
পরিশেষে বলা যায়, জাতীয় কোনো প্রশ্নে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতই যে সর্বদা জনমত বলে স্বীকৃত হবে তা ঠিক নয়; কখনও কখনও সংখ্যালঘিষ্ঠের মতামতও জনমত হতে পারে যদি তা যুক্তিযুক্ত ও কল্যাণমূলক হয়।