জাতীয়তাবাদ কি বা কাকে বলে?
জাতীয়তাবাদ হলো স্বজাতির প্রতি ভালোবাসা। দেশের মানুষকে আপন করে নেবার মানসিকতা। জাতীয় ঐক্য সাধনের ক্ষেত্রে জাতীয়বাদের কোনো বিকল্প নেই। যখন কোনো জনসমষ্টি বংশ, ভাষা, ধর্ম প্রভৃতি কারণে ঐক্যবন্ধ হয় তখন তাদের বলা হয় জনসমাজ। যখন এই জনসমাজের মাঝে রাজনৈতিক চেতনা জাগে, তখন তাদের বলা হয় জাতীয় জনসমাজ। জাতীয় জনসমাজের মানুষেরা প্রত্যেকে অপরের সুখ-দুঃখে সমান অংশীদার বলে মনে করে। অন্য সমাজ থেকে নিজেদের পৃথক বলে ভাবতে শেখে। প্রত্যেকে নিজের ভাষা, ধর্ম, সাহিত্য ইত্যাদির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়। এগুলিকে সংরক্ষণ করার জন্য তাদের মধ্যে পৃথক রাষ্ট্র গঠনের ইচ্ছা জাগে। জাতির প্রতি তাদের এই ভালোবাসা ও একত্ববোধের নাম হলো জাতীয়তাবাদ। তাই বার্টন রাসেল বলেছেন- ‘জাতীয়তাবাদ হলো ঐক্যের অনুভূতি’।
জাতীয়তার উপাদান কি কি? |
জাতীয়তাবাদের স্বয়ংসম্পূর্ণ বা চূড়ান্ত সংজ্ঞা আজও পাওয়া যায়নি। তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এর সংজ্ঞা নিরূপণের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ প্রক্রিয়ায় তারা বিভিন্ন বিষয় ও ধারণার অবতারণা করেছেন। নিচে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রদত্ত জাতীয়তাবাদের কয়েকটি সংজ্ঞা উপস্থাপন করা হলো:
অধ্যাপক প্যাডেল ফোর্ড ও লিংকন (Padelford and Lincoln) তাদের ‘Dynamics of International Politics গ্রন্থে বলেন- জাতীয়তাবাদ দুটি উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত ‘১. জাতীয়তাবাদ হলো জাতীয়তার ধারণা সম্পর্কিত কোনো আদর্শবাদ এবং ২. জাতীয় রাষ্ট্রের ভেতর ঐ আদর্শবাদকে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে রূপদান।’
আমেরিকান ইতিহাসবিদ এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানী James MacGregor Burns-এর মতে, ‘প্রত্যেক মানবগোষ্ঠীর মধ্যে কিছু বিশেষ গুণ আছে যা তাদের স্বার্থ ও কল্যাণের জন্য সংরক্ষণ করা উচিত। আর এটি করতে গিয়ে যে মনোভাবের জন্ম হয় সেটাই হলো জাতীয়তাবাদ।’
আমেরিকান ইতিহাসবিদ অধ্যাপক কার্লটন জে এইচ হায়েস (Carlton J. H. Hayes)-এর মতে, ‘জাতীয়তাবাদ হলো জাতীয়তা ও দেশপ্রেমের মত আধুনিক আবেগের সাংবিধানিক ও অতিরঞ্জিত দুটি প্রাচীন প্রত্যয়।’
আমেরিকান দার্শনিক এবং ইতিহাসবিদ হ্যান্স কোন (Hans Kohn)-এর মতে, ‘জাতীয়তাবাদ হচ্ছে এক ধরনের মানসিক অবস্থা এবং সচেতন কর্মপ্রক্রিয়া।’
বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী আপেক্ষিকতা তত্ত্বের জনক অ্যালবার্ট আইনস্টাইন (Albert Einstein) জাতীয়তাবাদকে খুব নেতিবাচকভাবে দেখেছেন। তিনি এর সংজ্ঞায় বলেছেন, ‘Nationalism is an infantile disease. It is the measles of mankind.”
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক অরগ্যানস্কির (Abramo Fimo kenneth Organski) ভাষায়, ‘জাতীয়তাবাদ হলো এক ধরনের অতি শক্তিমান অনুভূতি; আর এ অনুভূতি কোনো জাতি ও তার জীবনযাত্রার ভিত্তিরূপে পরিগণিত যৌথ মানবগোষ্ঠী, তার অবস্থান এবং আচার-আচরণের সাথে কোনো ব্যক্তির শনাক্তকরণের পথ রচনা করে।’
ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকস-এর আন্তর্জাতিক ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আরনল্ড জোসেফ টয়নবি (Arnold Joseph Toynbee) বলেছেন, ‘জাতীয়তাবাদ কোনোরূপ বস্তুগত বা যান্ত্রিক অনুভূতি নয়, বরং এক প্রকার আত্মিক ও মানসিক অনুভূতি।’
জাতি ও জাতীয়তার মধ্যে পার্থক্য কি কি? |
যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলাইনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক লয়েড ক্র্যামারের (Loyd Kramer) মতে, ‘জাতীয়তাবাদকে ধর্ম হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। কেননা এর উৎস মানুষের গভীরতম প্রবৃত্তির মধ্যে নিহিত।’ আমেরিকান ইতিহাসবিদ বার্টন রাসেলের (Jeffrey Burton Russell) মতে, ‘জাতীয়তাবাদ হলো একটি সাদৃশ্য ও ঐক্যের অনুভূতি, যা পরস্পরকে ভালোবাসতে শেখায়।’
সুতরাং আমরা বলতে পারি, জাতীয়তাবাদ একটি মানসিক ধারণা, এক প্রকার মানসিক প্রবৃত্তি এবং ভাবপ্রবণতা। এটি এমন এক মানসিক অনুভূতি যা কোনো নির্দিষ্ট মানবগোষ্ঠীকে নিজেদের সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, ঐতিহ্য, ভাষা, সাহিত্য ইত্যাদি বিষয়ে সচেতন করে এবং অন্যদের থেকে পৃথক ভাবতে শিক্ষাদান করে। জাতীয়তাবাদ কোনো একটি জনসমাজের মানসিক ও আত্মিক ঐক্যের সাথে স্বাধীন রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন আদর্শ। মানুষের চেতনাগত ঐক্য জাতীয়বাদের ভিত্তি।
জাতীয়তাবাদের জনক কে?
ইতালি রাষ্ট্র দার্শনিক নিকোলা ম্যাকিয়াভেলীকে আধুনিক জাতীয়তাবাদের জনক বলা হয়।
ভারতের জাতীয়তাবাদের জনক কাকে বলা হয়?
ভারতের জাতীয়তাবাদের জনক বলা হয় রাজা রামমোহন রায়কে।