জাতীয়তার উপাদান সমূহ
জাতীয়তা বলতে আমরা সেই জনসমাজকে বুঝি, যারা দেশ, ভাষা ও সাহিত্য, রীতি-নীতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ। এই ঐক্যসূত্রগুলোই জাতীয়তার উপাদান। রাষ্ট্রদার্শনিকরা জাতীয়তার একাধিক উপাদান বা বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন। জাতীয়তার এ উপাদানগুলো নিচে আলোচনা করা হলো-
১. ভৌগোলিক ঐক্য
ভৌগোলিক ঐক্য জাতীয়তার প্রথম ও প্রধান উপাদান। জাতি গঠন করতে হলে একটি জনসমষ্টিকে কোনো নির্দিষ্ট ও সংলগ্ন ভূখণ্ডে বসবাস করতে হয়। জাতীয়তার অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও ভৌগোলিক ঐক্যের অভাবে একটি ভবঘুরে জনসমষ্টি জাতি বলে বিবেচিত হবে না। আবার ভৌগোলিক ঐক্য থাকলেই যে জাতি গঠিত হবে তা নয়। বস্তুত বিভিন্ন দেশে বসবাস করেও জনগণ একই জাতীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ থাকতে পারে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, ইহুদিরা প্যালেস্টাইন অঞ্চলে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করলেও একটি জাতীয় জনসমাজ হিসেবে পরিগণিত হতো।
জাতি ও জাতীয়তার মধ্যে পার্থক্য কি কি? |
২. বংশগত ঐক্য
বংশগত ঐক্যও জাতীয়তা গঠনে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। বংশগত ঐক্য তথা রক্তের সম্পর্ক মানুষের মধ্যে এমন এক সুদৃঢ় ঐক্যভাব গড়ে তোলে, যা জাতি গঠনে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করে। তবে বর্তমান যুগের নৃতত্ত্ববিদরা জাতি গঠনের ক্ষেত্রে এ উপাদানটিকে অপরিহার্য বলে মনে করেন না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, জার্মান ও ইংরেজ জাতি একই প্রাচীন বংশ থেকে উদ্ভূত হলেও একই জাতীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারেনি। পক্ষান্তরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বহু বংশের লোকের বসবাস সত্ত্বেও তারা একই জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ।
৩. ধর্মীয় ঐক্য
জাতীয়তার অপর একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান হচ্ছে ধর্মীয় ঐক্য। জাতীয়তার ধারণার সৃষ্টি এবং তা জোরদার করার ক্ষেত্রে ধর্মীয় ঐক্য একটি শক্তিশালী উপাদান হিসেবে কাজ করে। এটি জাতীয়তাবোধ সৃষ্টির এক গুরুত্বপূর্ণ উৎস। এক ধর্মাবলম্বী ব্যক্তিবর্গের মধ্যে সহজেই এক ঐক্যভাব জাগ্রত হয়। আবার, ধর্মীয় ঐক্যের ওপর ভিত্তি করে বিশ্বের বিভিন্ন অংশে বহু জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেছে। যেমন- ইচুদিরা ধর্মের প্রভাবে জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠন করে, অবিভক্ত ভারতের মুসলমানরাও ধর্মের নামে জাতীয় ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয় এবং পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। তথাপি বলা প্রয়োজন, বর্তমানে ধর্মের ক্ষেত্রে উদারনীতি গৃহীত হওয়ায় এবং ধর্মনিরপেক্ষতার ভাব জাগ্রত হওয়ায় বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেও জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, মালয়েশিয়ার মতো জাতিগত বৈচিত্রপূর্ণ বহু দেশ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
৪. ভাষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ঐক্য
জাতীয়তার অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো ভাষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ঐক্য। ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির মাধ্যমে ভাবের আদান-প্রদান হয়। অভিন্ন ভাষায় ভাবের আদান-প্রদান জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার অন্যতম উপায়। তবে বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যেও জাতীয়তাবোধ গড়ে উঠতে দেখা যায়। বেলজিয়াম, চীন, সুইজারল্যান্ড ইত্যাদি দেশের জনগণ বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে, তবু তারা একই জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ। আবার ইংরেজ ও আমেরিকানরা একই ভাষা ব্যবহার করা সত্ত্বেও তারা দুটি ভিন্ন জাতি। বিভিন্ন আরব রাষ্ট্রসমূহেও একই আরবি ভাষা প্রচলিত, তথাপি সেখানে বহু জাতি বিদ্যমান।
৫. অর্থনৈতিক ঐক্য
অর্থনৈতিক ঐক্যও মানুষকে জাতীয়তাবোধে অনুপ্রাণিত করে। যখন কোনো জনগোষ্ঠীর মধ্যে অর্থনৈতিক দিক থেকে সমতা বিরাজ করে, তখন তারা একত্রে বসবাস করার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়। জনগণের অর্থনৈতিক স্বার্থ এক ও অভিন্ন হলে তাদের মধ্যে সুদৃঢ় জাতীয়তার বন্ধন গড়ে ওঠে।
৬. ভাবগত ঐক্য
ভাবগত ঐক্য জাতীয়তার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ফরাসি রাষ্ট্র দার্শনিক রেনানের মতে, ‘জাতীয়তাবোধ একটি মানসিক সভা, এক প্রকার সজীব মানসিকতা’। জাতি গঠনের অপরাপর উপাদানগুলো ভাবগত ঐক্যের তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ। কারণ উক্ত উপাদানগুলো ছাড়াও একটি জাতি গড়ে উঠতে পারে যদি জাতি গঠনে উদ্বুদ্ধ একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঐতিহ্যগত বা ভাবগত ঐক্য বিদ্যমান থাকে। জাতীয় ঐক্য মূলত ভাবগত। অধ্যাপক স্পেংলার (Spengler) তাই বলেছেন, ‘জাতীয়তার উপাদান বংশগত বা ভাষাগত ঐক্য নয়, বরং এটি ভাবগত ঐক্য।’ অধ্যাপক লাস্কি বলেন- ‘জাতীয়তা ধারণাটি অপরিহার্যভাবেই একটি আত্মিক ব্যাপার’।
জাতীয়তা কি | জাতীয়তা বলতে কি বুঝায় | জাতীয়তা কাকে বলে |
৭. ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ঐক্য
প্রচলিত রীতি-নীতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যগত ঐক্য জাতি গঠনে বড় ধরনের সহায়ক ভূমিকা পালন করে। দীর্ঘদিন ধরে এক ভূখণ্ডে বসবাসকারী একটি জনসমাজের মধ্যে ইতিহাস ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সমন্বয়ের মাধ্যমে ঐতিহ্যগত ঐক্য গড়ে ওঠে। তবে র্যামজে ম্যুর (Ramsay Muir) এবং জে এস মিল (JS Mill) ঐতিহ্যগত উপাদানকে জাতি গঠনের জন্য অনাবশ্যক বলে মনে করেন।
৮. রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষার ঐক্য
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষার ঐক্য জাতি গঠনের অন্যতম প্রধান উপাদান। রাজনৈতিকভাবে সুসংগঠিত ও অভিন্ন অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষা পোষণকারী জনসমষ্টির মধ্যে একাত্মাতা গড়ে ওঠে। একই ধরনের রাজনৈতিক চেতনা মানুষের মধ্যে একাত্মতাবোধের সৃষ্টি করে। যেমন- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার প্রাক্কালে বিদ্যমান ১৩টি উপনিবেশ তাদের অতীতের জার্মান, ইংরেজ, পোলিশ ইত্যাদি পরিচিতি হারিয়ে একসময় আমেরিকান জাতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এর পেছনে তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষার মিল চালিকাশক্তির কাজ করেছে।
৯. সমস্বার্থ
সমস্বার্থও জাতি গঠনে অন্যতম সহায়ক উপাদান হিসেবে কাজ করে। কারণ একই স্বার্থ জনগণের মধ্যে ঐক্যবোধ গড়ে তোলে। সুতরাং সমস্বার্থ (Common interest) জাতি গঠনের অন্যতম উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়। উপরের আলোচনা শেষে বলা যায়, কোন উপাদানই এককভাবে জাতি গঠনের জন্য অপরিহার্য নয়। তবে ভাবগত ঐক্য জাতি গঠনের জন্য একান্ত প্রয়োজন।