রচনা: বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প
ভূমিকা
মানবজীবন বৈচিত্রের প্রত্যাশী। যদিও মানুষ এক জায়গায় জন্মগ্রহণ করে, তবুও সে চিরদিন গতানুগতিক জীবন কাটাতে চায় না, একঘেয়ে জীবন নিয়ে এক জায়গায় পড়ে থাকতে চায় না। অজানাকে জানার, অচেনাকে চেনার আকাঙ্ক্ষায় মানুষের মন সদাই উন্মুক্ত। মুক্তবিহঙ্গের মতো সে ছুটে যেতে চায় সংসারের সংকীর্ণ সীমানা ছাড়িয়ে অবাধ মুক্তির মধ্যে। ক্ষুদ্র সীমানার মধ্যে বন্দী হয়ে থাকা মানুষের ধর্ম নয়। অজানা রহস্য সবসময় মানুষকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। তাই মানুষ সে ডাকে সাড়া দিয়ে একস্থান থেকে আরেক স্থানে, এক দেশ থেকে আরেক দেশে ছুটে যায়। গড়ে উঠে পর্যটন শিল্প । তাই পর্যটনের গুরুত্ব আজ সবদেশে স্বীকৃত।
পর্যটন কী
অজানাকে জানার, অচেনাকে চেনার, অদেখাকে দেখার আকাঙ্ক্ষায় একস্থান থেকে অন্যস্থানে, এক দেশ থেকে আরেক দেশে ভ্রমণ করাকে পর্যটন বলা হয়। বর্তমানে পর্যটন শিল্প হিসেবে স্বীকৃত। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পর্যটন শিল্প আজ নতুন রূপ পরিগ্রহ করেছে। আধুনিক বিশ্বের মানুষ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ ও পর্যটনকে গ্রহণ করেছে শিল্প হিসেবে। এর মধ্যে দিয়ে যোগসূত্র গড়ে উঠেছে একদেশের সাথে আরেক দেশের মানুষের। বিজ্ঞানের আশীর্বাদে পথের দূরত্ব আজ আর মানুষের কাছে কোনো সমস্যা নয়। তাই প্রসার ঘটছে পর্যটন শিল্পের। বাংলাদেশও আজ পর্যটন শিল্পে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে।
আরও পড়ুন:
বাংলাদেশের কৃষক রচনা [ Class 5, 6, 7, 8, 9, 10 ]
শিশু শ্রম রচনা (৬৫০ শব্দ) – ১০০% কমন সকল ক্লাস
যুগে যুগে পর্যটক
মানুষ চিরপথিক, পথ চলাতেই তার আনন্দ। দেশ দেশান্তরে ভ্রমণের মাধ্যমেই মানুষ চরিতার্থ করে তার মনের সৌন্দর্য পিপাসাকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পর্যটকের দল দুর্গম গিরি, কান্তার ময়ু, দুস্তর পারাবার পেরিয়ে পৌঁছেছে দেশ দেশান্তরে। প্রখ্যাত পর্যটক হিউয়েন সাঙ, ইবনে বতুতা, ফা-হিয়েন, মেগাস্থিনিস, ভাস্কো-দা-গামা, কলম্বাস, ক্যাপ্টেন কুক কিংবা আমাদের দেশের অতীশ দীপঙ্কর এমনভাবেই সভ্যতা সংস্কৃতির সম্যক জ্ঞান লাভের আশায় কিংবা অজানা ভূখণ্ডকে আবিষ্কারের আকাঙ্ক্ষায় ভয়কে তুচ্ছ করে দেশ পর্যটন করেছেন, পাড়ি জমিয়েছেন অজানার পথে। প্রাণকে তুচ্ছ করে অচেনা পথে পাড়ি জমিয়েছিলেন বলেই অনেক অজানা পাহাড় পর্বত, মরুভূমি, মেরুদেশ কিংবা অনেক ধ্বংসপ্রাপ্ত সভ্যতার স্মরণ হয়েছে আবিষ্কৃত, মানুষের জ্ঞানের ভাণ্ডার হয়েছে পূর্ণ, মানবসভ্যতা হয়েছে সমৃদ্ধ।
পর্যটন শিল্পের অর্থনৈতিক গুরুত্ব
পর্যটন শিল্প অনেক বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করতে পারে বলে বাংলাদেশে এর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। বাংলাদেশের সমুদ্র সৈকত, ঐতিহাসিক প্রাচীন নিদর্শন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ইত্যাদি উপভোগ করার জন্য প্রতিবছর বস্তু বিদেশি পর্যটক বাংলাদেশে আসেন বলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। পৃথিবীর প্রগতিশীল দেশগুলো এ শিল্পে অনেক বেশি অগ্রসর হয়ে গিয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ ভ্রমণের ব্যাপারে অধিকতর উৎসাহী হয়েছে। কোনো দেশের গৌরবময় ঐতিহাসিক নিদর্শন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং পৃথিবীর বিভিন্ন বিলাসবহুল নগরী, স্বাস্থ্যকর স্থান এগুলোই প্রধানত পর্যটনের মূল আকর্ষণ। সমুদ্র সৈকত, তাজমহল, পিরামিড, চীনের প্রাচীর, জলপ্রপাত, পার্বত্য এলাকা ইত্যাদিও সৌন্দর্য পিপাসু মানুষকে বিপুল পরিমাণে আকৃষ্ট করে থাকে। অর্থনৈতিক দিক ছাড়াও পর্যটনের মধ্য দিয়ে বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায় এবং মানুষে মানুষে গড়ে ওঠে আত্মীয়তার বন্ধন। কারণ এতে বিভিন্ন দেশের মানুষ পারস্পরিক জ্ঞান ও ভাবের আদান-প্রদানের মাধ্যমে রূপমভূকতা ও সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি দূর হয়, গড়ে ওঠে উদার মানসিকতা। এ যোগাযোগ ও সম্পর্কের ফলেও দেশে দেশে ব্যবসায়িক সম্পর্কের মাধ্যমে অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথ উন্মুক্ত হয়, কাজেই পর্যটন শিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম।
বাংলাদেশের পর্যটন স্পট
ভ্রমণের নেশা মানুষের স্বভাবগত। প্রকৃতি যে অন্তহীন সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে বসে আছে, একমাত্র দেশ ভ্রমণের ফলে তা পূর্ণভাবে উপভোগ করা সম্ভব হয়। আধুনিক বিজ্ঞান মানুষকে অবাধ চলার সুযোগ করে দিয়েছে বলেই মানুষ আজ সহজেই পারে প্রকৃতি জগতের আনন্দ লীলার বৈচিত্র্য উপভোগ করতে। সাধারণ পর্যটকগণ আকৃষ্ট হয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমুদ্র সৈকত ও ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোর প্রতি। সেদিক থেকে বাংলাদেশ পর্যটকদের জন্য পরম আকর্ষণীয় দেশ। বাংলাদেশের সবুজ শ্যামল প্রাকৃতিক শোভা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত।
পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত আছে বাংলাদেশের কক্সবাজারে। এখান থেকে সূর্যাস্তের দৃশ্য চমৎকারভাবে উপভোগ করা যায়। আবার সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দুটোই উপভোগ করা যায় কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত থেকে। ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে খ্যাত মহাস্থানগড়, রামসাগর, সোনারগাঁ, লালবাগ দুর্গ, কান্তজীর মন্দির প্রভৃতি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি হিসেবে খ্যাত রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, কাপ্তাই হ্রদ, মহেশখালী, সুন্দরবন, জাফলং প্রভৃতি স্থান।
পর্যটকদের সুযোগ-সুবিধা
বাংলাদেশ পর্যটন সংস্থার অধীনে কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, কুমিল্লা, কুয়াকাটা, রংপুর, সিলেট প্রভৃতি স্থানে ছোটবড় অভিজাতশ্রেণির হোটেল, রেস্তোরাঁ ও ক্রীড়াকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। পর্যটকদের সুবিধার জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসসহ নানা ধরনের যানবাহনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের নিরাপত্তার জন্য সৈকতে পুলিশের ব্যবস্থাও আছে। রাঙ্গামাটি ও কাপ্তাইয়ে হাউসবোট ও স্পীডবোটের ব্যবস্থা রয়েছে। পর্যটকদের সুবিধার জন্য পর্যটন সংস্থা তৈরি করেছে ট্যুরিস্ট গাইড। সুবিধা যেমন আছে, তেমনি অসুবিধাও কম নয়। পর্যটনকে একটি শক্তিশালী আকর্ষণের মাধ্যম হিসেবে গড়ে তুলতে হলে যে বিষয়টিকে প্রথমে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে তাহল পর্যটকদের একদৃষ্টে আকর্ষণ করা। বিশ্বের নানা দেশের পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য আমাদের দেশের দর্শনীয় এবং ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোকে পরিচিত করে তুলতে হবে বিশ্ববাসীর কাছে। বিদেশি পর্যটকদের নিরাপত্তা করতে হবে নিশ্চিত। দর্শনীয় ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোকে সংস্কারের মাধ্যমে আকর্ষণীয় করে গড়ে তুলতে হবে। আকর্ষণীয় ও দর্শনীয় স্থানগুলোর সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করতে হবে। এ সমস্ত অসুবিধা দূর হলে বিদেশি পর্যটকদের আগমন বেড়ে যাবে এবং সুগম হবে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের পথ।
আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যটন শিল্পের গুরুত্ব
সমগ্র বিশ্বের প্রায় ১১ কোটি মানুষ পর্যটন শিল্পের সাথে জড়িত। বিশ্ববাণিজ্যের শতকরা ৫ ভাগ, বিশ্বের মোট উৎপাদনের শতকরা ১ ভাগ এবং প্রতি বছর এ খাতে বিশ্বের ১০০ মিলিয়ন ডলার আয় হয়। বিশ্ব অর্থনীতির পাশাপাশি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে পর্যটন শিল্প। পর্যটন নীতিমালায় পর্যটনকে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে ১৯৯১ সালে। তবুও পর্যটন শিল্প আশানুরূপ উৎকর্ষ লাভ করতে পারে নি। অথচ অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশের জন্য এ শিল্পের গুরুত্ব অনেক। আন্তর্জাতিক যোগাযোগ স্থাপন, দেশের বেকারত্ব হ্রাস, জাতীয় আয় বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, বাণিজ্যিক ভারসাম্য রক্ষা, সরকারি রাজস্ব আয় বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক সম্পদ উন্নয়ন, বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি, অপ্রচলিত পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক সম্প্রীতি সৃষ্টি, ভূমি
উন্নয়নে সহায়তা ইত্যাদি ক্ষেত্রে পর্যটনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাই বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের আরও অনেক বিকাশ এবং সম্প্রসারণ প্রয়োজন। এজন্য সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোক্তারা এগিয়ে এলে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের আরও অনেক অগ্রগতি আসতে পারে।
উপসংহার
পর্যটন শিল্পকে ব্যাপক ও জনপ্রিয় করে তোলার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকার যে সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, তার মধ্যে পর্যটন সংস্থার গঠন একটি অন্যতম পদক্ষেপ। বাস্তবিকপক্ষে আমাদের দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রয়োজন অনেক বেশি এবং তা সফল করতে হলে পর্যটন শিল্পের আরও প্রসার ঘটাতে হবে। পর্যটন শিল্পের প্রসার ঘটলে এবং আকর্ষণ বৃদ্ধি পেলে বিদেশি পর্যটকের আগমন বাড়বে, আর তাতে অর্জিত হবে বৈদেশিক মুদ্রা।