বিচার বিভাগের ক্ষমতা ও কার্যাবলী সম্পর্কে জানেত চাচ্ছেন? তাহলে সঠিক ব্লগে এসেছেন। এই ব্লগের লেখা থেক আপনি জানতে পারবেন বিচার বিভাগের কি কি ক্ষমতা রয়েছে এবং এর কার্যাবলী গুলো কি কি? তো কথা না বাড়িয়ে চলুন জেনে নিই বিচার বিভাগের ক্ষমতা ও কার্যাবলী সম্পর্কে-
১. আইন অনুযায়ী বিচার করা
বিচার বিভাগের মুখ্য দায়িত্ব হলো দেশের প্রচলিত আইন লঙ্ঘনকারীদের আইনানুসারে বিচার এবং অপরাধীদের শান্তি বিধান। অর্থাৎ আইনের ব্যাখ্যা এবং প্রয়োগ করাই হলো বিচার বিভাগের প্রধান কাজ। এক্ষেত্রে ‘আইন’ শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। আইন বলতে আইনসভা কর্তৃক প্রণীত আইন ছাড়াও শাসনতান্ত্রিক আইন, প্রচলিত প্রথা, রীতিনীতি, লোকাচার সব কিছুকেই বোঝায়।
২. আইনের ব্যাখ্যা প্রদান
প্রচলিত আইনের সাহায্যে আদালতের সম্মুখে উপস্থিত সব মামলার মীমাংসা করা অনেক ক্ষেত্রে বিচারকদের পক্ষে সম্ভবপর হয় না। অনেক সময় দেখা যায়, কোনো বিশেষ বিবাদের ব্যাপারে কোনো সূত্র বা স্পষ্ট নির্দেশ প্রচলিত আইনের মধ্যে নেই। এসব ক্ষেত্রে বিচারকগণ ব্যক্তিগত বিবেক বৃদ্ধি, স্বাভাবিক ন্যায়নীতি, সুবিচার প্রভৃতির ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং বিচারকার্য সম্পাদন করেন। তাছাড়া আইন যেখানে সুস্পষ্ট নয়, সেখানে বিচারকগণের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমেই বিবাদের বিচার হয়। এভাবে বিচারকগণ নতুন আইন সৃষ্টি করেন।
বিচার বিভাগ কি, গঠন ও বিচারক নিয়োগ পদ্ধতি |
৩. যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় বিরোধ মীমাংসা
যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় সর্বোচ্চ আদালতের এক বিশেষ ভূমিকা আছে। এ আদালতই হলো যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার অভিভাবক ও চূড়ান্ত ব্যাখ্যাকর্তা। কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রীয় কোনো বিষয়ে বিরোধ দেখা দিলে সংবিধানের ব্যাখ্যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত তার মীমাংসা করে।
৪. পরামর্শদান সংক্রান্ত কাজ
অনেক দেশে বিচার বিভাগ শাসন বিভাগকে কোনো কোনো বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে থাকে। দৃষ্টান্ত হিসেবে ভারতের কথা বলা যায়। এখানে রাষ্ট্রপতি প্রয়োজনবোধে কোনো আইন বা তথ্য সংক্রান্ত বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ চাইতে পারেন। সুপ্রিম কোর্ট সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তার মতামত রাষ্ট্রপতিকে জানায়। ইংল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কতকগুলো অঙ্গরাজ্যে এ ব্যবস্থা প্রচলিত আছে।
৫. মৌলিক অধিকার রক্ষা
ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকারের সংরক্ষক হিসেবেও বিচার বিভাগের গুরুদায়িত্ব রয়েছে। আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ থেকে বিচার বিভাগ জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে। দেশে লিখিত শাসনতন্ত্র থাকলে আইন ও শাসন বিভাগকে শাসনতান্ত্রিক গণ্ডির মধ্যে থেকে কাজ করতে হয়। সরকার নাগরিকদের সংবিধানে লিপিবদ্ধ মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করলে বিচার বিভাগ অপহৃত অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করে।
৬. বিচার বিভাগীয় সমীক্ষা
বিচার বিভাগীয় সমীক্ষা আদালতের একটি বড় দায়িত্ব ও ক্ষমতা। এ ক্ষমতাবলে বিচার বিভাগ সংবিধান বিরোধী যেকোনো আইন এবং সরকারি সিদ্ধান্তকে অসাংবিধানিকতার অভিযোগে বাতিল করে দিতে পারে। আইন বিভাগ যদি এমন কোনো আইন প্রণয়ন করে বা শাসন বিভাগ এমন কোনো আদেশ জারি করে যা সংবিধানের কোনো ধারার বিরোধী, তা হলে সে আইন বা আদেশকে বাতিল করার যে ক্ষমতা বিচার বিভাগের হাতে আছে তাকে বিচার বিভাগীয় সমীক্ষার অধিকার বলে। এ ক্ষমতার মাধ্যমে বিচার বিভাগ সংবিধানের রক্ষক ও ব্যাখ্যাকর্তা হিসেবে কাজ করে। সংবিধান ব্যাখ্যার মাধ্যমে বিচার বিভাগ যেকোনো আইনের বৈধতাও বিচার করে দেখতে পারে।
৭. রাজনৈতিক প্রাতিষ্ঠানিক বিরোধ মীমাংসা
বিচার বিভাগ রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিরোধের মীমাংসাও করে থাকে। সাংবিধানিক উপায়ে বা সংবিধান ব্যাখ্যার মাধ্যমে বিচার বিভাগ এসব বিরোধের মীমাংসা করে। শাসন বিভাগের সাথে আইন বিভাগের বা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে বিভিন্ন সরকারের মধ্যে এ ধরনের বিরোধ দেখা দিতে পারে।
৮. সংবিধানের ব্যাখ্যা প্রদান
বিচার বিভাগ সংবিধানের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রদান করে থাকে। বিচার বিভাগ হলো দেশে রাজনৈতিক ব্যবস্থার একটি অঙ্গবিশেষ। এ কারণে বিচার বিভাগ দেশের প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সমর্থন ও সংরক্ষণ করে। বিচার বিভাগ অনেক ক্ষেত্রে সরকারি নীতি ও কার্যাবলিকে বৈধ ঘোষণা করে রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা বজায় রাখে। বিচার বিভাগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ভারত প্রভৃতি দেশে সংবিধান ব্যাখ্যার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারকে অধিকতর শক্তিশালী করেছে।
১. গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ
ন্যায়বিচারকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে গণতন্ত্রের স্বরূপ সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও বিচার বিভাগের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিচার বিভাগ যদি অন্যান্য বিভাগ কর্তৃক প্রভাবিত হয় বা দুর্নীতিপরায়ণ হয় তাহলে গণতন্ত্রের ভরাডুবি অবধারিত। গণতন্ত্রের রক্ষাকর্তা হিসেবেও বিচার বিভাগের ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ। তাই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বিচার বিভাগের দায়িত্ব গুরুত্বপূর্ণ। দেওয়ানি, ফৌজদারি প্রভৃতি যেকোনো মামলায় সত্যানুসন্ধানের মাধ্যমে অপরাধীকে শাস্তি দিয়ে বিচার বিভাগকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হয়।
১০. সংবিধানের অভিভাবক
বিচার বিভাগ সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে কাজ করে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনায় সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা ও গুরুত্ব যথেষ্ট বেড়েছে। সংবিধানের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা বিচার বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বিচার বিভাগ সংবিধান বিরোধী কোনো আইনকে বাতিল বলে গণ্য করতে পারে।
১১. অধস্তন আদালতের নীতি নির্ধারণ
বিচার বিভাগ দেশের মধ্যে অবস্থিত বিভিন্ন আদালতের নীতি নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। যেমন- বিদেশি নাগরিকদের নাগরিকত্ব দান, অভিভাবকত্ব নিরূপণ, নাবালকের সম্পত্তির তত্ত্বাবধান ইত্যাদি।
১২. বিচার বিভাগীয় নীতিমালা প্রণয়ন
বিচার বিভাগীয় আদালত নিজস্ব নীতিমালা নির্ধারণ করে। আর এ নীতি বাস্তবায়ন করার জন্যে বিভিন্ন পন্থা, পদ্ধতি ও কঠোরতা প্রয়োগ করে থাকে। আদালত অমান্য করার দায়ে দায়ী ব্যক্তিকে শাস্তিসহ বিচারের সুবিধার্থে আদালতে হাজির করার আদেশ দিয়ে হাজির হতে বাধ্য করতে পারে।
১৩. তদন্তসংক্রান্ত কাজ
জনগণের জানমালের নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও নির্বিঘ্নে চলাফেরার বাধাদানে বিচার বিভাগ তদন্ত করে থাকে। তদন্ত শেষে বিচার বিভাগ প্রতিকারের ব্যবস্থা করে থাকে।
শাসন বিভাগ কি বা কাকে বলে? শাসন বিভাগের গঠন আলোচনা কর |
১৪. ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষা
বিচার বিভাগ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রত্যেকের ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার ব্যবস্থা করে থাকে। ব্যক্তির মৌলিক অধিকার যাতে ক্ষুন্ন না হয় সেজন্যে বিচার বিভাগ প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে।
১৫. সুবিচার প্রদান
আদালত ব্যক্তির ক্ষতি রোধের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি আদালতের শরণাপন্ন হয়ে সুবিচার লাভ করতে পারে। কারণ আদালত ন্যায়বিচার প্রাপ্তির সর্বশেষ আশ্রয়।
১৬. বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা
বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা বিচার বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এই ক্ষমতাবলে বিচার বিভাগ সংবিধান পরিপন্থী যেকোনো আইন বাতিল ঘোষণা করতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা ক্ষমতার অধিকারী।
১৭. ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা
বিচার বিভাগ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় কার্যকরী ভূমিকা রাখে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিচার বিভাগ হলো ন্যায়ের প্রতীক। কোনো ব্যক্তিকে শাস্তি প্রদান ও নিরপরাধীকে মুক্তি দেওয়ার মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব বিচার বিভাগের ওপর ন্যস্ত।
১৮. শাসন সংক্রান্ত কাজ
উপর্যুক্ত কার্যাবলি ছাড়াও বিচার বিভাগকে কতকগুলো শাসন বিভাগীয় দায়িত্ব সম্পাদন করতে হয়। যেমন- নাবালকের অভিভাবক নিয়োগ, কোনো সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ক বা অছি নিয়োগ, মৃত ব্যক্তির উইল অনুমোদন, লাইসেন্স প্রদান, দেউলিয়া প্রতিষ্ঠানের পক্ষে আদায়কারী নিয়োগ প্রভৃতি।
শাসন বিভাগের ক্ষমতা ও কার্যাবলী আলোচনা কর |
অধ্যাপক লাঙ্কির (Laski) মতানুসারে, ‘কোনো রাষ্ট্রের বিচার পদ্ধতি পর্যালোচনা করলে সে রাষ্ট্রের নৈতিক প্রকৃতি অনুধাবন করা যায়।’ ন্যায়বিচারের ওপর জনসাধারণের অনাস্থা সৃষ্টি হলে বা ন্যায়বিচারের অভাব দেখা দিলে রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিপর্যয়ের আশঙ্কা এড়ানো যাবে না। সরকারের সব থেকে শক্তিশালী স্তম্ভ হলো বিচার ব্যবস্থার পরিচালনা।
অতএব, উপরের আলোচনা থেকে বিচার বিভাগের ক্ষমতা ও কার্যাবলী সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করলেন।