ব্যবসায়ের সামাজিক দায়িত্ব
ব্যবসায়ের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মুনাফা অর্জন করা। আর এই উদ্দেশ্য অর্জনে সহযোগিতা করে শ্রমিক-কর্মী, ক্রেতা, সরবরাহকারী, বিনিয়োগকারী ও সাধারণ জনগণ। তাই এদের প্রতি ব্যবসায়ের কিছু প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দায়িত্ব রয়েছে। একে ব্যবসায়ের সামাজিক দায়িত্ব বলে।
ব্যবসায়ের সামাজিক দায়িত্ব সম্পর্কে কয়েকটি সংজ্ঞা নিম্নে প্রদত্ত হলো:
(i) ব্যবস্থাপনাবিদ অলিভার শেলডনের মতে, “সমাজে উত্তম জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন ও সেবা বিতরণের জন্যই ব্যবসায় বিদ্যমান।”
(ii) প্রখ্যাত ব্যবস্থাপনা বিশারদ পি. এফ. ড্রাকার বলেন, “ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান এমনভাবে পরিচালিত হওয়া উচিত যেন জনগণের কল্যাণ সাধন করতে পারে।”
আন্তর্জাতিক ব্যবসায় পরিবেশের উপাদান সমূহ আলোচনা কর |
(iii) এল. এফ. আর. উইক বলেছেন, “জীবনধারণের উদ্দেশ্য যেমন শুধুমাত্র ভোজন করা নয় তেমনি ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যও শুধমাত্র মুনাফা অর্জন নয়।”
সুতরাং ব্যবসায়ের সামাজিক দায়িত্ব বলতে ব্যবসায়ের সাথে যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত তাদের প্রতি দায়িত্ব পালন করাকে বুঝায়। ব্যবসায়ের সাথে জড়িত পক্ষসমূহ হলো ক্রেতা, শ্রমিক-কর্মী, বিনিয়োগকারী, সরবরাহকারী, পাওনাদার, সরকার, মালিক, প্রতিবেশী ও সমাজের সাধারণ জনগণ।
ব্যবসায়ের সামাজিক দায়িত্ব সমূহ
সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে মুনাফা অর্জনের সাথে সাথে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান এর সঙ্গে জড়িত পক্ষসমূহের প্রতি কিছু দায়িত্ব পালন করে থাকে। একে সামাজিক দায়িত্ব বলা হয়। বর্তমানে ক্রেতা, সরবরাহকারী, বিনিয়োগকারী, প্রতিবেশী এবং সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়েই ব্যবসায়ী তার সামাজিক উদ্দেশ্য অর্জন করছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে নিম্নে পর্যায়ক্রমে সামাজিক দায়িত্ব গুলোর বর্ণনা প্রদান করা হলো:
১. মালিকের প্রতি দায়িত্ব
মুনাফা অর্জনের উদ্দেশে মালিক ব্যবসায় গঠন ও পরিচালনা করে। যদি প্রতিষ্ঠানে লাভ না হয়ে ক্ষতি হয় তাহলে ঐ ব্যবসায় সংগঠন বেশিদিন বাজারে টিকতে পারে না। ফলে দেশের উৎপাদন, বণ্টন, জাতীয় স্বার্থরক্ষা ব্যাহত হয়। তাই ব্যবসায়ের সর্বপ্রথম সামাজিক দায়িত্ব হলো মালিকের স্বার্থরক্ষা। মালিকের প্রতি ব্যবসায় সংগঠনের দায়িত্বগুলো হলো:
(ক) সুষ্ঠুভাবে ব্যবসায় পরিচালনা; (খ) মূলধনের কাম্য ব্যবহার নিশ্চিতকরণ; (গ) মুনাফা অর্জন; (ঘ) মিতব্যয়িতা অর্জন; (ঙ) যথাযথভাবে ব্যবসায়ের হিসাব সংরক্ষণ, আর্থিক বিবরণী প্রস্তুত ও পেশকরণ; (চ) সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবহার; (জ) সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা।
২. ক্রেতা বা ভোক্তাগণের প্রতি দায়িত্ব
ব্যবসায়ের মাধ্যমে ক্রেতা বা ভোক্তাগণকে সেবা পরিবেশন করা হয়। ব্যবসায়ের লক্ষ্য হলো ক্রেতা বা ভোক্রাদের চাহিদানুযায়ী পণ্য ও সেবা পরিবেশন। এ লক্ষ্যে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের করণীয় দায়িত্বসমূহ হলো:
(ক) চাহিদানুযায়ী পণ্য ও সেবার যোগান দেয়া; (খ) গুণগত মানসম্পন্ন পণ্যসামগ্রী প্রদান; (গ) সঠিক সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে পণ্য সরবরাহ; (ঘ) ন্যায্যমূল্যে পণ্য ও সেবার যোগান; (ঙ) নতুন নতুন পণ্য উৎপাদন ও বণ্টন।
৩. শ্রমিক-কর্মীদ্র্যের প্রতি দায়িত্ব
উৎপাদন ও বণ্টনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো শ্রমিক-কর্মী। এদের অনুপস্থিতিতে কোনো উৎপাদন কাজই পরিচালনা সত্ত্ব নয়। এদের জন্য করণীয় হলো:
(ক) আন্তরিকতাপূর্ণ ব্যবহার; (খ) ন্যায্য মজুরি প্রদান; (গ) সুষ্ঠু কার্য পরিবেশ গড়ে তোলা; (ঘ) পরিবহণের সুযোগ প্রদান; (ঙ) চিকিৎসা সুবিধা প্রদান (চ) ছেলেমেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থাকরণ; (ছ) শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান। (জ) পদোন্নতির ব্যবস্থাকরণ; (ঝ) বিনোদন ভাতা প্রদান; (ঞ) অবসর ভাতা প্রদান; (ট) চাকরির নিরাপত্তা বিধান; (ঠ) মহার্ঘ ভাতা প্রদান; (ড) টিফিন ভাতা প্রদান।
৪. সরবরাহকারী এবং পাওনাদার/ঋণদাতাদের প্রতি দায়িত্ব
ব্যবসায় সংগঠনের করণীয় সামাজিক দায়িত্ব হলো: (ক) সরবরাহকারীদের কাঁচামালের ন্যায্যমূল্য প্রদান। (খ) ঋণদাতাদের সঠিক সময়ে ঋণের অর্থ পরিশোধ। (গ) ঋণের উপর সুদ প্রদান। ৫. সরকারের প্রতি দায়িত্ব: সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া কোনো দেশে ব্যবসায় বিকাশ লাভ করে না। তাছাড়া ব্যবসায়ের উন্নয়নে রাষ্ট্র বা সরকার বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করে থাকে। তাই রাষ্ট্রের প্রতিও ব্যবসায়ের কিছু করণীয় আছে। এগুলো হলো:
(ক) সরকারি আইনকানুন ও রীতিনীতি মেনে চলা; (খ) নিয়মিত কর প্রদান; (গ) রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকা। (ঘ) কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি। (ঙ) মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি; (চ) অর্থনৈতিক উন্নয়ন; (ছ) জাতীয় স্বার্থরক্ষা।
৬. এলাকার প্রতি দায়িত্ব
যে এলাকায় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত সেই এলাকার জনগণের প্রতিও ব্যবসায়ের কিছু করণীয় রয়েছে। কেননা কলকারখানার ধোঁয়া, আবর্জনা ইত্যাদিতে পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি হয়। তাই এলাকার প্রতি ব্যবসায়ের করণীয় হলো:
(ক) রাস্তাঘাট উন্নয়নে সহায়তা; (খ) পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখা; (গ) স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ, মন্দির, পাঠাগার, ইত্যাদি নির্মাণ। (ঘ) ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজে অংশগ্রহণ ইত্যাদি।
ব্যবসায়ের অবস্থান নির্ধারণে বিবেচ্য বিষয় সমূহ আলোচনা কর |
৭. সমাজের প্রতি দায়িত্ব
সমাজের সকল জনগণের প্রতি ব্যবসায়ের করণীয় হলো:
(ক) নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন; (খ) পণ্যে ভেজাল না দেয়া। (গ) কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা; (ঘ) চোরাকারবারি, মুনাফাখোরি, ফটকাবাজি হতে বিরত থাকা। (ঙ) সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিতকরণ। (চ) স্বাস্থ্যরক্ষা; (ছ) শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নয়ন। (জ) বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রদান; (ঝ) সমাজকল্যাণে মুনাফার কিছু অংশ ব্যয়। (ঞ) খেলাধুলায় পৃষ্ঠপোষকতা; (ট) বৃক্ষরোপণ, নলকূপ স্থাপন, ত্রাণ কাজে অংশগ্রহণ, খাল ও পুকুর খনন ইত্যাদি।
৮. স্বগোত্রীয় ব্যবসায়ীদের প্রতি দায়িত্ব
অন্যায় প্রতিযোগিতা ও রেষারেষি প্রতিরোধ করার জন্য প্রত্যেক ব্যবসায়ীর প্রতি প্রত্যেক ব্যবসায়ীর কিছু দায়িত্ব রয়েছে। এগুলো হলো:
(ক) সমিতি গঠন; (খ) পারস্পরিক সহযোগিতা; (গ) অন্যায় প্রতিযোগিতায় লিপ্ত না হওয়া। (ঘ) তথ্যের আদান-প্রদান ইত্যাদি।
পরিশেষে বলা যায়, বর্তমানে ব্যাপক প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ব্যবসায়কে টিকে থাকতে হলে ব্যবসায়ের প্রয়োজনেই জড়িত পক্ষকে গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ জড়িত পক্ষের উপরই ব্যবসায়ের সফলতা নির্ভর করে। অর্থনীতি শাস্ত্রের জনক অ্যাডাম স্মিথের দু’শ বছর আগের সেই কথা, “A great affair, we always find, is to get many.”