যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার কি বা কাকে বলে?
যুক্তরাষ্ট্রের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো ‘Federation’। ‘Federation’ শব্দটি ল্যাটিন শব্দ ‘Foedus’ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। এর অর্থ ‘সন্ধি’ বা ‘মিলন।’ সুতরাং শব্দগত অর্থে, কতিপয় রাষ্ট্রের সন্ধি বা মিলনের ফলে যে রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয় তাকে যুক্তরাষ্ট্র বলে। এ সংজ্ঞা অনুযায়ী কতিপয় স্বাধীন রাষ্ট্র পারস্পরিক চুক্তির মাধ্যমে একটি সাধারণ সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধীনে ঐক্যবন্ধ হয়ে যে নতুন রাষ্ট্র গঠন করে তাই যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারে সংবিধান কর্তৃক কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন করা হয়। কেন্দ্র ও প্রাদেশিক সরকার নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র। এই সরকারে সাংবিধানিক প্রাধান্য স্বীকৃত হয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতের ওপর সংবিধান ব্যাখ্যা করার চরম ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে। আধুনিক যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা আমেরিকার সংবিধান থেকেই নেওয়া হয়েছে। সে দেশের সংবিধান একটি রাষ্ট্রীয় সংঘ প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হয়েছে, যাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হয়েছে।
এককেন্দ্রিক সরকার কাকে বলে ও এককেন্দ্রিক সরকারের বৈশিষ্ট্য |
প্রকৃতপক্ষে পৃথক পৃথক এবং সমমর্যাদাসম্পন্ন সরকারগুলোর মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন করে দেওয়ার নীতিগত ভিত্তির ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত। যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে অধ্যাপক এইচ, ফাইনার (Prof. H. Finer) বলেন, ‘যখন কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার কিছু অংশ আঞ্চলিক ক্ষেত্রে অর্পিত হয় এবং অন্যান্য অংশ ঐ সব আঞ্চলিক সংঘের মধ্যকার কেন্দ্রীয় সংস্থায় অর্পিত থাকে, তখন তাকে যুক্তরাষ্ট্র বলে।’
যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের অন্যতম প্রবক্তা হলেন কে. সি. হুইয়ার (K. C. Wheare)। তিনি এ সম্পর্কে বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতি বলতে আমি ক্ষমতা বণ্টনের একটি পদ্ধতিকে বুঝি, যেখানে কেন্দ্রীয় সরকার ও আঞ্চলিক সরকারসমূহ বিশেষ ক্ষেত্রে পরস্পরের পরিপূরক অথচ স্বতন্ত্র।’ (By the federal principle I mean the method of dividing powers so that the general and regional governments are each within its sphere co-ordinate and independent.) ঐতিহাসিক ফ্রিম্যান (Freeman) যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থার স্পষ্ট সংজ্ঞা দিয়েছেন। তাঁর মতে, ‘পূর্ণরূপে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক নির্ণয়ের একটি রাষ্ট্র বলে মনে হয়, কিন্তু অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তা বহু রাষ্ট্রের মতোই।’ (Federation in its perfect form is one which forms a single state in its relations to other nations, but which consists of many states with regard to internal government.)
অধ্যাপক ডাইসির (Prof. Dicey) মতে, ‘যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে জাতীয় ঐক্যের সাথে প্রদেশ বা অঙ্গ রাজ্যের অধিকারের সমন্বয় সাধনের রাজনৈতিক কৌশল।’ (A federal state is a political contrivance intended to reconcile national unity and power with the maintenance of state rights.)
সুতরাং বলা যায়, কেন্দ্র ও প্রদেশের মধ্যে সংবিধানের মাধ্যমে ক্ষমতা বণ্টনের ভিত্তিতে যে সরকার গঠিত হয় তাকে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার বলে। কেন্দ্রীয় সরকার সাধারণ স্বার্থে সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনা করে এবং প্রাদেশিক সরকার স্বাধীনভাবে স্থানীয় বা প্রাদেশিক বিষয়সমূহ পরিচালনা করে থাকে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারত প্রভৃতি দেশে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের বৈশিষ্ট্য
অধ্যাপক কে. সি. হুইয়ার, অধ্যাপক ফাইনার, ব্লন্ডেল প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। তাদের তত্ত্ব ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার কতকগুলো বৈশিষ্ট্য নিরুপণ করা হয়েছে। বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ:
১. দুই ধরনের সরকার
যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারে দুই ধরনের সরকার থাকে। একটি কেন্দ্রীয় সরকার এবং অন্যটি আঞ্চলিক সরকার বা প্রাদেশিক সরকার। সমগ্র দেশের শাসন কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকে। অঞ্চলগুলোর শাসনক্ষমতা আঞ্চলিক সরকারের মাধ্যমে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। দুই ধরনের সরকারের মধ্যে সংবিধান অনুযায়ী ক্ষমতা বণ্টিত হয়ে থাকে। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক উভয় সরকারই সংবিধানের প্রতি অনুগত থাকে।
২. দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা
দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। প্রথম কক্ষ রাষ্ট্রের জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে এবং দ্বিতীয় কক্ষ অঙ্গরাজ্যসমূহ বা আঞ্চলিক সরকারসমূহের প্রতিনিধিত্ব করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড এবং ভারতে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা রয়েছে।
৩. দ্বৈত প্রশাসনব্যবস্থা
যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো দ্বৈত প্রশাসনব্যবস্থা। এখানে কেন্দ্র ও আঞ্চলিক সরকারের নিজস্ব প্রশাসনিক ব্যবস্থা থাকে। কেন্দ্রীয় প্রশাসন কেন্দ্রীয় আইনকে বাস্তবায়ন করে। আঞ্চলিক আইন অনুসারে নির্দিষ্ট অঞ্চলে আঞ্চলিক প্রশাসনব্যবস্থা শাসন ক্ষমতা প্রয়োগ করে। প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে ক্রিয়াশীল থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দ্বৈত বিচার ব্যবস্থাও পরিলক্ষিত হয়।
৪. দ্বৈত নাগরিকত্ব
জনগণের দ্বৈত নাগরিকত্ব ও আনুগত্য যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। যেমন- যে ব্যক্তি যে অঙ্গরাজ্যের নাগরিক সে প্রথমত সে রাজ্যের সরকারের কাছে আনুগত্য প্রদর্শন করে। আবার সমগ্র রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে সে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছেও আনুগত্য প্রর্দশন করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এরূপ দ্বৈত নাগরিকত্ব পরিলক্ষিত হয়। তবে অনেক যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় এ নিয়ম বা বিধান নেই।
৫. ক্ষমতা বণ্টন
যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় সংবিধান কর্তৃক কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন করে দেওয়া হয়। মুদ্রা, বৈদেশিক সম্পর্ক, দেশরক্ষা প্রভৃতি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো কেন্দ্রীয় সরকারকে এবং অন্যান্য বিষয়গুলো প্রাদেশিক সরকারের হাতে অর্পণ করা হয়।
সংসদীয় সরকারের বৈশিষ্ট্য | মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের বৈশিষ্ট্য |
৬. যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত
যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারগুলোর মধ্যকার বিরোধ মীমাংসার জন্য এ আদালত গঠিত হয়। এছাড়া এ আদালত সংবিধানের অভিভাবক ও রক্ষাকারী হিসেবে সংবিধানের যুগোপযোগী ব্যাখ্যা প্রদান করে। এটি একটি সর্বোচ্চ বিচারালয়।
৭. লিখিত সংবিধান
যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের সংবিধান লিখিত হওয়াই বাঞ্ছনীয়। কেননা সংবিধানে অঙ্গরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ক্ষমতা লিখিতভাবে বণ্টন করা থাকলে কেউ কারও ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারে না।
৮. বিচার বিভাগের প্রাধান্য
যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত বা সুপ্রিম কোর্টই সংবিধানের অভিভাবক, রক্ষক ও ব্যাখ্যাকর্তা। সংবিধানের প্রাধান্য স্বীকৃত ও প্রতিপালিত হচ্ছে কি না তা দেখার দায়িত্ব সুপ্রিম কোর্ট বা ফেডারেল কোর্টের। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় বিচার বিভাগের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
৯. দুষ্পরিবর্তনীয় সংবিধান
যুক্তরাষ্ট্রে সংবিধান দুম্পরিবর্তনীয় হওয়াই বাঞ্ছনীয়। কেননা সংবিধান দূষ্পরিবর্তনীয় হওয়ার ফলে এর কোনো ধারা পরিবর্তন করে কেউ ক্ষুদ্র স্বার্থসিদ্ধি করতে পারে না।
১০. প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন
যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থায় প্রদেশগুলো স্বায়ত্তশাসনের অধিকারী। তবে প্রদেশসমূহ পৃথক আইন প্রণয়ন ও আইনসভা পরিচালনার ক্ষমতা ভোগ করলেও তাদের হাতে কোনো সার্বভৌম ক্ষমতা থাকে না।