যৌথ মূলধনী কোম্পানি
মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে কতিপয় মানুষ স্বেচ্ছায় ন্যূনতম পুঁজি বিনিয়োগ ও উদ্যোগ গ্রহণ করে প্রচলিত কোম্পানি আইনের আওতায় যে চিরন্তন অস্তিত্বসম্পন্ন ও কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তা বিশিষ্ট ব্যবসায় গঠন করে এবং ঐ আইনের নিয়ন্ত্রণাধীনে ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা করে তাকেই যৌথ মূলধনী কোম্পানি বলে। বাংলাদেশের ১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইনানুযায়ী যৌথ মূলধনী ব্যবসায় গঠিত, নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়।
যৌথ মূলধনী কোম্পানির কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংজ্ঞা নিচে উল্লেখ করা হলো:
১. অধ্যাপক বিশ্বনাথ ঘোষ বলেন, “মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে কতিপয় ব্যক্তির দ্বারা সংগঠিত, স্বশাসিত একটি বিধিবদ্ধ সংস্থাকে কোম্পানি বলে।”
২. বিচারপতি জন মার্শাল বলেন, কোম্পানি হলো এমন একটি কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তা যা অদৃশ্য ও অস্পৃশ্য অথচ আইনের মধ্যে টিকে থাকে।
চুক্তিই অংশীদারি ব্যবসায়ের মূল ভিত্তি ব্যাখ্যা কর। |
৩. বাংলাদেশের ১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইনের ২.১ (ঘ) ধারা মতে, “কোম্পানি বলতে একটি কোম্পানি যা এ আইনানুযায়ী গঠিত ও নিবন্ধিত অথবা চালু কোনো কোম্পানি।”
সুতরাং বলতে পারি যে, যৌথ মূলধনী কোম্পানি হচ্ছে একটি স্বেচ্ছামূলক যৌথ মালিকানা যেখানে মুনাফা অর্জনের নিমিত্ত কতিপয় ব্যক্তি একটি যৌথ তহবিল গঠন করে, কৃত্রিম ব্যক্তি হিসেবে নিজ নাম ও সীলের দ্বারা পরিচিত হয় এবং আইনের মাধ্যমে চিরন্তন অস্তিত্বের অধিকারী হয়।
যৌথ মূলধনী কোম্পানির সুবিধা
যৌথ মূলধনী কোম্পানির বহুবিধ সুবিধা রয়েছে। নিম্নে এর সুবিধাগুলো বর্ণিত হলো:
১. অধিক পুঁজি: যৌথ মূলধনী ব্যবসায় বিবরণীপত্র প্রচারের মাধ্যমে জনগণের নিকট শেয়ার ইস্যু করে পর্যাপ্ত পুঁজি সংগ্রহ করতে পারে। ফলে জনগণ নিঃসংকোচে অধিক শেয়ার ক্রয় করে থাকে। এজন্য পুঁজির পরিমাণও অধিক হয়।
২. সীমিত দায়: যৌথ মূলধনী কোম্পানির প্রত্যেক শেয়ারহোল্ডারদের দায় তাদের ক্রীত শেয়ারের মূল্য দ্বারা সীমাবদ্ধ বলে শেয়ার বিক্রয় দ্বারা মূলধন সংগ্রহ সহজ হয়।
৩. চিরন্তন অস্তিত্ব: সত্তাবিশিষ্ট এ ধরনের ব্যবসায় সংগঠনের স্থায়িত্ব অধিক বলে একে চিরন্তন অস্তিত্বসম্পন্ন বলা হয়। চিরন্তন অস্তিত্ব কারবারের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন প্রকল্পের সহায়ক হয়।
৪. জনগণের আস্থা: গঠিত, নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত, চিরন্তন অস্তিত্বসম্পন্ন ও কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তাবিশিষ্ট এ ধরনের ব্যবসায় সংগঠনের উপর জনগণের আস্থা অত্যধিক।
৫. শেয়ার হস্তান্তরযোগ্যতা: এর শেয়ার হস্তান্তরযোগ্য বিধায় যে কেউ ইচ্ছা করলে নিজের সুবিধামতো শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় করতে পারে।
৬. কম ঝুঁকি: শেয়ার হোল্ডারদের দায় পরিমিত থাকায় তাদের ব্যক্তিগত ঝুঁকি কম।
৭. বৃহৎ ব্যবসায়েরের সুবিধা: অধিক মূলধন, দক্ষ পরিচালনা ইত্যাদি কারণে এ ব্যবসায় বৃহদায়তন কারবারের প্রায় সকল সুবিধা ভোগ করে।
৮. ঝুঁকি বণ্টন: এ কারবারের মালিকের সংখ্যা অনেক। ফলে কারবারের কোনো ক্ষতি হলে অনেক মালিকের মধ্যে তা বণ্টিত হয়।
৯. সুদক্ষ পরিচালনা: যৌথ মূলধনী কারবারের পরিচালনা পরিষদে দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিগণকেই সাধারণ শেয়ার মালিকগণ নির্বাচিত করে থাকেন। ফলে এর পরিচালনাও সুদক্ষ হয়।
১০. বিভিন্ন প্রকার শেয়ার: যৌথ মূলধনী কারবারে বিভিন্ন প্রকার শেয়ার বিক্রয় হয়ে থাকে বলে বিভিন্ন শ্রেণির লোক শেয়ার ক্রয়ের ইচ্ছা পূরণ করতে পারে।
১১. আইনগত সত্তা: আইনগত পৃথক সত্তা থাকায় এটি কৃত্রিম ব্যক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। ফলে সকলেই কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হতে সুবিধা পায়।
১২. গণতান্ত্রিক পরিচালনা: এরূপ ব্যবসায় পরিচালনা গণতান্ত্রিক বলে নতুন ও বিচক্ষণ ব্যক্তিবর্গ অনায়াসে নির্বাচন প্রার্থী হয়ে পরিচালনায় অংশগ্রহণ করতে পারে।
১৩. সম্প্রসারণের সুযোগ: অধিক মূলধন ও নিপুণ ব্যবস্থাপনার কারণে এ ব্যবসায় দ্রুত সম্প্রসারিত হতে পারে।
১৪. বৃহৎ কারবারের সুবিধা: অধিক মূলধন, দক্ষ পরিচালনা ইত্যাদি কারণে এ ব্যবসায় বৃহদায়তন কারবারের প্রায় সকল সুবিধা ভোগ করে।
১৫. ঋণের সুযোগ: কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তাবিশিষ্ট হওয়ার কারণে যৌথ মূলধনী ব্যবসায় অধিক ঋণের সুযোগ পায়।
১৬. অধিক উৎপাদন: বৃহদায়তনের এ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান অধিক পরিমাণ পণ্যদ্রব্য উৎপাদন করতে পারে।
১৭. সঞ্চয়: এ ধরনের কারবারে মূলধন বিনিয়োগ করে মালিক হওয়া যায় ও লভ্যাংশ পাওয়া যায় যা মানুষের সঞ্চয়স্পৃহা বৃদ্ধি করে।
১৮. গবেষণা: যৌথ মূলধনী ব্যবসায় পণ্যের মান উন্নয়নের জন্য গবেষণাগার খুলে থাকে। এতে পণ্যের গুণগত মান বৃদ্ধি পায়। ফলে জনগণ উপকৃত হয়ে থাকে।
১৯. প্রতিযোগিতা: বর্তমান বাজার অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক। যৌথ ব্যবসায় যে কোনো প্রতিযোগিতার মোকাবিলা করতে পারে।
পরিশেষে বলা যায়, যৌথ মূলধনী ব্যবসায় ব্যতীত অন্য কোনো ব্যবসায় সংগঠন এত অধিক সুবিধা ভোগ করতে পারে না।
যৌথ মূলধনী কোম্পানির অসুবিধা
যৌথ মূলধনী কোম্পানি আধুনিক যুগের সর্বোত্তম মর্যাদাসম্পন্ন ব্যবসায় সংগঠন হলেও এর অনেক অসুবিধাও বিদ্যমান। নিচে বিভিন্ন অসুবিধাগুলো সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:
১. জটিল গঠন: এর গঠন প্রণালি অত্যন্ত জটিল। কোম্পানি আইনের বিভিন্ন নিয়ম-কানুন পালন করে এরূপ ব্যবসায় গঠন করতে হয়।
২ . একচেটিয়া ব্যবসায়: একচেটিয়া ব্যবসায় সমাজ স্বার্থের পরিপন্থি। কিন্তু কোনো কোনো যৌথ মূলধনী ব্যবসায় অবৈধভাবে অধিক মুনাফা অর্জনের জন্য একচেটিয়া ব্যবসায় পরিচালনা করে।
৩. অদক্ষ পরিচালনা: এ কারবারের শেয়ার মালিক সরাসরি ব্যবসায় পরিচালনায় অংশগ্রহণ করতে পারে না। তাদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত পরিচালক পরিষদের উপর ব্যবসায় পরিচালনার দায়িত্বভার ন্যস্ত থাকে।
৪. স্বজন পোষণ: সুদক্ষ বিচক্ষণ ব্যক্তি নিয়োগ এসব কারবারে কমই দেখা যায়; বরং পরিচালকদের স্বজন পোষণনীতিই এরূপ কারবারে লক্ষণীয়।
অংশীদারি ব্যবসায় চুক্তি পত্রের বিষয়বস্তু আলোচনা কর |
৫. সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব: পরিচালক পরিষদের সভায় যে কোনো বিষয়ে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। তাই আইন-কানুন পালন করে সভা-আহবান, সভায় ফোরামের অভাব ইত্যাদি কারণে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সময়ক্ষেপণ হয়।
৬. ধনতন্ত্র: যদিও যৌথ মূলধনী ব্যবসায় আইনত গণতান্ত্রিক, কিন্তু বাস্তবে এটা ধনতন্ত্রের পরিচায়ক। গোটা কয়েক ব্যক্তির হাতেই পরিচালন ভার থেকে যায় এবং তাদের স্বার্থের কাছে সাধারণ শেয়ার ক্রেতাদের স্বার্থ উপেক্ষিত হয়।
৭. অত্যধিক কর: যৌথ মূলধনী কারবারের অর্জিত আয়ের উপর সরকার অধিক হারে কর ধার্য করে। আবার শেয়ার মালিকগণের লভ্যাংশের উপরও কর দিতে হয়।
৮. গোপনীয়তা রক্ষার অসুবিধা: এ কারবারের অধিক সংখ্যক কর্মচারীর দ্বারা সব ধরনের কার্যাদি সম্পন্ন করতে হয় বলে এর গোপনীয়তা রক্ষা করা সম্ব হয় না।
৯. আইনের কড়াকড়িত্ব পালন: যৌথ মূলধনী কারবারের বিভিন্ন কার্যাদি সম্পন্ন করতে আইনের অনুশাসন কড়াকড়িভাবে পালন করতে হয়। ফলে কার্যকলাপের অগ্রগতি বিঘ্নিত হয়।
১০. বে-আইনি ফটকা ব্যবসায়: কোনো কোনো সময় কোম্পানির অসৎ পরিচালকগণ নিজে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে কারবারের প্রকৃত আর্থিক অবস্থা গোপন রেখে শেয়ার মূল্যের পরিবর্তন ঘটায় এবং ফটকা ক্রয়-বিক্রয় করে।
১১. ব্যক্তিগত উদ্যোগের অভাব: মালিকানা থেকে নিয়ন্ত্রণ আলাদা থাকায় এতে ব্যক্তিগত উদ্যোগের অভাব দেখা যায়।
১২. পরিচালনা ব্যয় অধিক: বৃহদায়তন ব্যবসায় ও বৃহৎ সাংগঠনিক কাঠামোর কারণে এ কারবারের পরিচালনা খরচ ও আনুষঙ্গিক খরচ অনেক বেশি।
১৩. মালিক কর্মচারীর মধ্যে পার্থক্য: মালিক, ও কর্মচারীদের মধ্যে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ না থাকায় ব্যবসায় পরিচালনায় অপচয়ের মাত্রা বেড়ে যায় এবং সস্তায় পণ্য উৎপাদন করা কল্পনামাত্র।
১৪. ব্যক্তিগত উদ্যোগের অভাব: মালিকানা থেকে নিয়ন্ত্রণ আলাদা থাকায় এতে ব্যক্তিগত উদ্যোগের অভাব দেখা যায়।
১৫. দুষিত পরিবেশ: বড় বড় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রায়ই দূষিত কারখানা পরিবেশ দৃষ্ট হয়। এখানে অনেক সময় অন্যায়, অনাচার, অনিয়মের প্রমাণ দেখা যায়।
পরিশেষে বলা যায়, পূর্বোক্ত অসুবিধাগুলো থাকা সত্ত্বেও দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার মাধ্যমে যৌথ মূলধনী কোম্পানি-বিশ্বের প্রতিটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অগ্রদূত হিসেবে শিল্প ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছে।