রবীন্দ্রনাথকে ভারতীয় জাতীয়বাদের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাদাতা বলার কারণ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আমরা জানি বিশ্বকবি হিসেবে। কিন্তু তিনি একজন দার্শনিকও ছিলেন। তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ভারতের চিন্তাজগতে প্রাধান্য বিস্তার করেন। তবে তাঁর রাজনৈতিক দর্শন তেমন ভাবে মনোযোগ লাভ করেনি। কারণ, সাহিত্য শিল্পকলার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান এতটাই বিশাল ও বহুমুখী যে, তাঁর রাজনৈতিক দর্শন এর নিচে তলিয়ে পড়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি একজন বড় মাপের কবি-র পাশাপাশি দার্শনিক এবং রাজনৈতিক চিন্তাবিদও ছিলেন। বিশেষত জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তার ধারণা/দর্শন বিশেষ গুরুত্বের দাবীদার। তাকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাদাতাও বলা হয়। নিম্নে রবীন্দ্রনাথকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাদাতা বলার পেছনের যুক্তি বা রবীন্দ্রনাথের দর্শন সম্পর্কে আলোচনা করা হল:
রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তা/দর্শন
রবীন্দ্রনাথ সরাসরি কোন রাজনৈতিক দর্শন প্রদান করেননি। তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকেও দূরে ছিলেন। শুধুমাত্র ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে তাকে সক্রিয় হতে দেখা গেলেও পরবর্তীতে তিনি সেখান থেকে সরে আসেন। তবে তার মানে এই নয় যে তিনি রাজনীতি বিমুখ ছিলেন। তার অনেক আচরণেই রাজনীতি ও রাজনৈতিক সচেতনতার বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়। তিনি ধর্মের মাঝে সংঘাত সৃষ্টি করতে চাননি। তিনি মূলত ছিলেন স্থান, কাল, ধর্মের উর্ধ্বে। তিনি ভারতের সাথে সারা বিশ্বের নৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মিলন সাধনের চেষ্টা করেছেন। যার ফলে সমগ্র বিশ্বে তার এক স্থায়ী আসন প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি তৎকালীন রাজনৈতিক দুই উপ-ধারার তথা চরমপন্থী ও নরমপন্থী কোনটির প্রতিই সায় দেননি। তিনি বরং গল্প, কবিতা, উপন্যাস, গান দ্বারা ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে বেগবান করেছেন। নিম্নে কবির জাতীয়তাবাদী দর্শন সহ অন্যান্য বিষয়ে চিন্তাধারা বিস্তারিত আলোচনা করা হল:
রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদী দর্শন
জাতীয়তাবাদ হল একটি মানসিক অনুভূতি যার কারনে মানুষ ভাষা কিংবা সংস্কৃতি কিংবা ধর্মের ঐক্যের ভিত্তিতে বসবাস করার প্রচেষ্টা চালায়।
- রবীন্দ্রনাথের মতে, যে প্রেক্ষাপটে ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও প্রসার ঘটে, সে প্রেক্ষাপটে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উদ্ভব, বিকাশ ও প্রসার ঘটেনি। ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ঘটে পুঁজির সম্প্রসারণের প্রেক্ষাপটে। সেই সাথে ছিল বাজার দখল, শোষণ ইত্যাদি। আর জাতীয়তাবাদের উদ্ভব ঘটেছে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ ও শোষণ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে। ভারতীয় চিন্তাবিদদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথই প্রথম জাতীয়তাবাদকে আদর্শবাদ বলার কথা প্রত্যাখ্যান করেন। ভারতের প্রতি তার গভীর আবেগময় ও আন্তরিক প্রেম থাকা সত্ত্বেও তিনি রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদের পূজারী হতে পারেননি। তবে তিনি সরাসরি ইউরোপ বিরোধী ছিলেন না। তিনি “Nationalism” নামক গ্রন্থে বলেছেন, “জাতীয়তাবাদ মানুষকে মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করে এবং মনুষত্বকে অবরুদ্ধ করে। এই ভাবাবেগের প্রতি ব্যক্তিকে বলি দিলে তার সৃজনশীল সত্ত্বার বিকাশ ব্যাহত হয়।”
- কবি স্বদেশকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। যে মাটিতে তাঁর জন্ম সেখানকার জল, মাটি, প্রকৃতির প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল প্রবল। দেশ বলতে তিনি কোন ভৌগলিক গণ্ডিকে বোঝাননি। দেশ তাঁর নিকট “মানসী/মানসিক”।সেই অর্থে রবীন্দ্রনাথের কোন দেশ নেই। সারা বিশ্বই তাঁর দেশ। এ কারণে তাঁকে বিশ্বজাতীয়তাবাদী বলা অসঙ্গত নয়। সমগ্র মানব সমাজ কবির নিকট এক ও অখন্ড। তিনি কোন বিশেষ জাতীয়তাবাদের গণ্ডিতে প্রবেশ করতে চাননি।
- স্বদেশের প্রতি গভীর প্রেম থাকা সত্ত্বেও তিনি জাতি ও জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে নেতিবাচক যুক্তি দেখিয়েছেন। কারণ, তাঁর মতে জাতি হল ক্ষমতার সংগঠন। তিনি বলেন যান্ত্রিক সভ্যতার ক্রমবিকাশ, সম্পদের সম্প্রসারণ ইত্যাদির কারণে অর্থ, সম্পদ, আধিপত্য ইত্যাদি নিয়ে জাতিগুলো সংঘাত করে থাকে। এক জাতি অন্য জাতিকে শোষণ করে বড় হওয়ার যে প্রবণতা তা সমগ্র বিশ্বজুড়ে দেখা যায়। তাই তিনি “জাতি”-র ধারণাকে নিন্দার চোখে দেখেছেন। তাঁর সবচেয়ে বড় অভিযোগ হল জাতিপূজার ফলে ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্বিত হয়। কিংবা সম্পূর্ণরূপে নির্মূল হয়ে যেতে পারে। জাতি নিজেকে শক্তিশালী করার জন্য ব্যক্তিকে মানসিক কৃতদাসে পরিণত করে। জাতি ব্যক্তির চিন্তা-চেতনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। জাতি ব্যক্তিকে তার নিজস্ব মডেল অনুযায়ী গড়ে তুলতে চায়। ফলে ব্যক্তি স্বাধীনতা সম্পূর্ণরূপে খর্বিত হয়।
- কবি বলেন, “সামাজিক মানুষের আদর্শ হল নিঃস্বার্থপরতা। আর জাতির আদর্শ হল স্বার্থপরতা”। তিনি তৎকালীন ইংরেজদের বাণিজ্য সম্প্রসারণের আক্রমণাত্মক নীতি ও পররাজ্য গ্রাস/দখল করার নীতিকে সংহতির কারণ বলেন এবং এই নীতিকে ধিক্কার জানান। কবি জাতীয়তাবাদকে একটি সংকীর্ণ মতবাদ ও সভ্যতার প্রতি হুমকি বলে মনে করতেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর দিকে পাশ্চাত্য জগতে যে জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটেছে তিনি তার কঠোর সমালোচনা করেছেন। তিনি পশ্চিমা সভ্যতার সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব ও এর ফলশ্রুতিতে পররাজ্য দখলের প্রবৃত্তিকে ধিক্কার জানিয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ
রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তি স্বাধীনতা সম্পর্কিত ধারণা ভারতীয় রাষ্ট্রদর্শনে এক বিশেষ অবদান। কোন না কোন দিক থেকে তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ সম্পর্কিত ধারণার সাথে কনফুসিয়াস এর ধারণার মিল রয়েছে। তিনি ব্যক্তির সৃজনশীলতার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। তার ব্যক্তিস্বাধীনতার ধারণায় মানবতাবাদের কথা বলা হয়েছে। তিনি মনে করতেন যে, ব্যক্তির স্বাধীনতার দ্বারা আনন্দময় সামাজিক সম্পর্ক গড়ে উঠবে। তিনি একটি সমাজের সার্বিক উন্নয়ন বলতে ব্যক্তির উন্নয়নকে বুঝিয়েছেন। তার মতে, ব্যক্তির উন্নয়নকে বুঝিয়েছেন। তার মতে, ব্যক্তির উন্নয়ন হবে তখন, যখন ব্যক্তি অর্থনৈতিক সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিকাশ লাভ করতে পারবে। এক্ষেত্রে ব্যক্তির চিন্তা, কর্ম ও বিবেকের স্বাধীনতা আবশ্যক।” এক্ষেত্রে J.S. Mill এর সাথে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ধারণার মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
রবীন্দ্রনাথ কেন্দ্রীভূত শক্তিকে নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “বিভিন্ন ধরনের সংকীর্ণতা, সামাজিক বিধি নিষেধ এগুলো ব্যক্তির মুক্তির পরিপন্থি।” কবি রাষ্ট্রকে একমাত্র ইচ্ছা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে গণ্য করতে অনিচ্ছুক। এক্ষেত্রে T. It. Green, Emnuel Kant প্রমুখের চিন্তা ভাবনার সাথে কবিরর দর্শনের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ অনৈতিক শক্তিধায়ক রাষ্ট্র গুলোকে নিন্দার চোখে দেখেছেন।
রবীন্দ্রনাথের মূল আদর্শ ছিল মানবাত্মার স্বাধীনতা। মানুষের ব্যক্তিত্বে স্বাতন্ত্রিক বিকাশের জন্য সব ধরনের আইন, নিয়ম, শৃঙ্খলা ও চিন্তার স্বাধীনতা দানের কথা বলেন তিনি। তিনি বলেন, ব্যক্তির সত্তাকে সমাজ ও রাষ্ট্রের নামে দমন করা যাবেনা। আর যদি এরূপ দমন করা হয় তবে রাজনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। তিনি স্বাধীন ব্যক্তিদের সাথে একটি স্বাধীন সমাজ গঠন করতে চেয়েছেন।
মানবতাবাদ সম্পর্কে ধারণা
রবীন্দ্রনাথ মানবাত্মার মুক্তির কথা বলেছেন। নানা গল্পে, উপন্যাসে তিনি মানুষের মুক্তির বাণী প্রচার করেছেন। এজন্য তাকে মানবতাবাদীও বলা হয়। মানব ধর্মকে তিনি পরম ধর্ম মনে করেছেন। মানুষের অন্য কোন ধর্মীয় পরিচয়কে তিনি স্বীকার করেননি। তিনি সকল ধর্ম, বর্ণের মানুষের মাঝে সৌহার্দ্য ও কল্যাণের ভিত্তিতে একটি ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তার মতে শুধু রাজনৈতিক প্রয়োজনেই নয়, মানুষকে তার আত্মার পূর্ণবিকাশের জন্য আত্মিক ঐক্য গড়ে তোলার দিকে মনযোগ দিতে হবে। আর এসব ধারণার জন্য তাকে মানবতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
আরও পড়ুন: বাক্য কাকে বলে? বাক্য কত প্রকার ও কী কী?
অর্থনীতি সম্পর্কে ধারণা
অর্থনীতি সম্পর্কে তার চিন্তার ক্ষেত্র খুব একটা সুস্পষ্ট না হলেও তিনি অর্থনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে সমাজকেন্দ্রিক ছিলেন যে তা বোঝা যায়। তিনি কুটির শিল্প সমবায় সংঘ ইত্যাদির পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য মাঝারি ও বড় ধরনের শিল্প কারখানা স্থাপনের পক্ষে ছিলেন। তিনি অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে গ্রামে ও শহরের মাঝে সামঞ্ঝস্য বিধানের কথা বলেন।
শিক্ষা সম্পর্কে ধারণা
রবীন্দ্রনাথ শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। তবে তিনি শিক্ষা বলতে সিলেবাস ভিত্তিক নিয়ম মাফিক পড়াশোনাকে বোঝাননি। তার শিক্ষা সম্পর্কে ধারণা ছিল সুশিক্ষা ও স্ব-শিক্ষার ধারণা। তিনি ”শিক্ষার হেরফের” নামক প্রবন্ধে মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের প্রতি জোর দেন।
রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে সমগ্র আলোচনা শেষে বলা যায় যে, রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক ধ্যান ধারণা মানবতাবাদী নীতির দ্বারা প্রভাবিত ছিল। তিনি পেশাদার রাজনীতিক ছিলেন না কিন্তু আধুনিক ভারত গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে কার্যকর শক্তি ছিলেন।
অতএব, উপরের আলোচনা থেকে এটা নিশ্চই বুঝতে পেরেছেন যে, কেন রবীন্দ্রনাথকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাদাতা বলা হয়।