রাজনৈতিক সামাজিকীকরণের মাধ্যম সমূহ
রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ একটি শিক্ষণ প্রক্রিয়া। এ শিক্ষণ প্রক্রিয়া বিভিন্ন উপায়ের মাধ্যমে অর্জন করা যেতে পারে। রাজনৈতিক সামাজিকীকরণের কতিপয় মাধ্যম এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে রাজনৈতিক সামাজিকীকরণের মাধ্যম গুলো বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন ধরনের। নিচে রাজনৈতিক সামাজিকীকরণের মাধ্যম সমূহ আলোচনা করা হল-
১. পরিবার (Family)
পরিবার রাজনৈতিক সামাজিকীকরণের প্রথম উপাদান মাধ্যম। শিশু পরিবারে জন্মগ্রহণ করে এবং লালিতপালিত হয় বিধায় পারিবারিক শিক্ষা তার জীবনে বেশি প্রভাব ফেলে। পিতামাতার আদর্শ অনুসারে সন্তানের আদর্শ গড়ে ওঠে। প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত শিশুকে সামাজিকভাবে পরিবারের উপর নির্ভরশীল হতে হয় বিধায় পারিবারিক আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গি এবং রাজনৈতিক প্রভাব শিশুর জীবনে অধিক ক্রিয়াশীল থাকে। পরিবারই রাজনৈতিক সামাজিকীকরণের সূতিকাগার।
রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞান পাঠের প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর |
২. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (Educational institution)
সামাজিকীকরণের মাধ্যম হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ শিশুকাল থেকে বিদ্যালয়ের সাথে পরিচিত। সকল বিদ্যালয়ে বিভিন্ন রকমের পাঠ্যসূচি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কী রাজনীতি, কী অর্থনীতি ও কী সমাজনীতি সকল কিছু বিদ্যালয়ে শিশুদের শেখানো হয়। রাজনীতির প্রভাব থেকে শিক্ষাজীনব বিচ্ছিন্ন নয়। বিদ্যালয়ে প্রবেশের পর শিশুর জ্ঞান বিস্তৃত হয়। বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নাগরিকের অধিকার, কর্তব্য, রাজনৈতিক ঘটনাবলি ও ব্যক্তিত্ব ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকে। আর এ সকল বিষয়ে জ্ঞানার্জন শিশুর রাজনৈতিক সচেতনতা ও সামাজিকীকরণ ঘটায়।
৩. পেশাগত সংগঠন (Professional association)
পেশাগত সংগঠন জনগণকে রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলে। বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে সকল দেশেই কিছু পেশাগত সংগঠন গড়ে ওঠে। যেগুলো পেশাগত স্বার্থ সংরক্ষণকরণেও বর্তমানে এগুলো রাজনীতির অঙ্গসংগঠন হিসেবে কাজ করছে। কেননা এগুলো কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতা করে। এতে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের মতাদর্শ, মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন হয়। এগুলো রাজনৈতিক সামাজিকীকরণের পথ সুগম করে।
৪. খেলার সাথী (Peer-group)
রাজনৈতিক সামাজিকীকরণে বন্ধু-বান্ধব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পরিবারের গণ্ডি পেরিয়ে শিশু বিভিন্ন মনমানসিকতার ছেলেমেয়ের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করে। আর এ সকল বন্ধুবান্ধবের মাধ্যমে রাজনৈতিক বিষয়ে শিশু বা কিশোর কিশোরীরা এমন জ্ঞান অর্জন করতে পারে, যা পরিবার বা অন্য কোনো মাধ্যমের দ্বারা সম্ভব নয়। তা ছাড়া বন্ধুবান্ধব একত্রিত হলে তাদের মধ্যে রাজনীতির বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। ফলে তারা কোনো না কোনো রাজনৈতিক আদর্শে দীক্ষিত হয়।
৫ . গণমাধ্যম (Mass media)
আধুনিককালে রাজনৈতিক সামাজিকীকরণে গণমাধ্যমগুলো কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে। এ মাধ্যমগুলো জনগণের সামনে রাজনীতি সম্পর্কিত বিভিন্ন ঘটনার তথ্য ও বিবৃতি তুলে ধরতে সক্ষম হয়। এতে জনগণের মধ্যে রাজনীতির বিষয়ে ধারণা জন্মায়। তারা রাজনীতির অনেক অস্পষ্ট বিষয় বুঝতে শেখে। রাজনীতি সম্পর্কে তাদের চিন্তাধারা প্রসারিত হয়। ফলশ্রুতিতে জনগণের মধ্যে রাজনীতি বিষয়ে আগ্রহ বৃদ্ধি পায় ও জ্ঞান সমৃদ্ধ হয়।
৬. রাজনৈতিক দল (Political party)
রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক সামাজিকীকরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। রাজনৈতিক দল বর্তমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ। রাজনৈতিক দলগুলোর মতাদর্শ ও মূল্যবোধের দ্বারা পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত। রাজনৈতিক দল জনগণের সামনে তাদের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, কার্য প্রক্রিয়া, প্ল্যান, প্রোগ্রাম, সীমাবদ্ধতা এবং বিরোধী দলের ভুলত্রুটিগুলো তুলে ধরে। ফলে জনগণ রাজনীতির বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন হবার পাশাপাশি ব্যাপক শিক্ষা লাভ করে।
৭. ধর্মীয় সংগঠন (Religious organization)
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান কাজ জনগণকে ধর্মীয় আচার-আচরণ শিক্ষা দেওয়া হলেও এটি জনগণকে রাজনৈতিক বিষয়ে শিক্ষাদান করে থাকে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ও রীতিনীতি নাগরিকের জীবনকে তথা জীনবধারাকে প্রভাবিত করে। আর ধর্মীয় সংগঠনগুলো কীভাবে ব্যক্তিমানুষকে ধর্মের পাশাপাশি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিজস্ব ভূমিকা পালন করতে হয় তা শিক্ষা দেয়।
৮. সরকারি সংস্থা (Govt agencies)
সরকারের বিভিন্ন সংস্থাগুলো বর্তমানে রাজনৈতিক সামাজিকীকরণে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। এসকল সংস্থাগুলো দিন দিন জননির্ভর হয়ে পড়ছে। আর সরকারের জনকল্যাণমূলক কাজের পরিধিও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই জনগণের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরাক্ষভাবে কাজ করতে গিয়ে জনগণ ও সংস্থার সমস্যদের মধ্যে সরকারি আদর্শ, কর্মকাণ্ড ও বিভিন্ন সংবাদ আদান-প্রদান হয়। এতে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ে এবং তাদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা ও যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়।
১. ক্লাব ও সামাজিক সংগঠন (Clubs and social organization)
ক্লাব ও সামাজিক সংগঠনগুলোর মাধ্যমে। রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ গড়ে ওঠে। একটি সমাজে বিভিন্ন রকমের সামাজিক সংগঠন ও সংস্থা থাকে। এর মধ্যে কতিপয় স্বেচ্ছামূলক সামাজিক সংগঠন বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। এগুলো বিভিন্নমুখী সামাজিক ও উন্নয়নমূলক কর্মসূচি প্রণয়ন করে থাকে। তাদের এ ধরনের কর্মসূচি প্রণয়ন ও পালনের দ্বারা জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটে। এতে রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি পায়।
১০. আত্মীয়স্বজন (Relatives)
আত্মীয়স্বজনও রাজনৈতিক সামাজিকীকরণে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। আত্মীয়রা। সাধারণত একে অপরকে আপন ও ঘনিষ্ঠ বলে মনে করে তারা পরস্পর পরস্পরের সুবিধা, অসুবিধা ও সুখ-দুঃখের কথা বলে। খুব কাছাকাছি মেলামেশা করে। এক আত্মীয়ের ভাবধারা, রাজনৈতিক আদর্শ, সামাজিক রীতিনীতি ইত্যাদি দ্বারা অপর আত্মীয় প্রভাবিত হয়। ফলে আত্মীয়ের রাজনৈতিক চিন্তাধারা অন্যান্য আত্মীয়ের মধ্যে প্রভাব ফেলে।
রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ আলোচনা কর |
১১. ভ্রমণ (Journey)
রাজনৈতিক সামাজিকীকরণের আরেকটি বিশেষ মাধ্যম হচ্ছে ভ্রমণ। বিভিন্ন দেশ, এলাকা বা সমাজের মানুষের রাজনৈতিক চিন্তাধারা, লক্ষ্য ও স্থান থেকে অন্য স্থানে এবং এক দেশ থেকে অন্য দেশে ভ্রমণের মাধ্যমে সেসকল সমাজ ও দেশের রাজনৈতিক আদর্শ, মূল্যবোধ ও চিন্তাধারার সাথে পারচিতি লাভ করার সুযোগ। পায় এবং এ ধরনের অভিজ্ঞতা সঞ্চার করে পরবর্তীতে তা নিজের দেশে এসে কাজে লাগাতে পারে।
১২. পুস্তক (Books)
পুস্তক রাজনৈতিক চেতনার সৃষ্টি করে। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ভা, উদ্দেশ্য ও চিন্তাধারা বই পুস্তকের মাধ্যমে জনগণের সামনে তুলে ধরা হয়। আর পাঠক এগুলো আয়ত্ত করার সুযোগ পায়। সাধারণত বিখ্যাত ব্যক্তিদের আদর্শ ও মতামত পাঠকের মনে রেখাপাত করে। ফলে পাঠক এসকল আদর্শকে নিজের জীবনের আদর্শরূপে প্রতিভাত করতে সচেষ্ট হয়। ফলে রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ সহজ হয়।
সুতরাং উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, রাজনৈতিক সামাজিকীকরণের ক্ষেত্রে কতকগুলো মাধ্যম বা বাহন পরিলক্ষিত হয়। এসকল মাধ্যম বা বাহন ব্যক্তির মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা ও রাজনীতি বিস্তারে মৌলিক ভূমিকা রাখে। উপরোক্ত মাধ্যমগুলোর কোনোটিই একক ভূমিকা পালন করতে পারে না। সবগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বা যোগসূত্র বিদ্যমান। তাই এদের ভূমিকাকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্নভাবে মূল্যায়ন করা যায় না। এ প্রসঙ্গে Prof. Ball বলেন “Agencies can not be examined in complete isolation”. তাই রাজনৈতিক সামাজিকীকরণে উপরোক্ত সকল মাধ্যমের অবদান অনস্বীকার্য।
অতএব, উপরের আলোচনা থেকে আপনারা রাজনৈতিক সামাজিকীকরণের মাধ্যম সমূহ সম্পর্কে জানতে পারলেন।