লঞ্চ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা
নদী-নালা ও খাল-বিলের জন্য বিখ্যাত বরিশাল। একদিন সেই বরিশালে যাওয়ার একটি অপূর্ব সুযোগ পেয়ে গেলাম । যাওয়া হবে লঞ্চে। ছোটো খালার শ্বশুরবাড়ি সেখানে। ছোটোকাল থেকেই খুব ইচ্ছে ছিল লঞ্চ ভ্রমণ করার। এবার সেই ইচ্ছেটা পূরণ হতে চলল। আজকে আমি আমার সেই রোমাঞ্চিত লঞ্চ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা তুলে ধরবো।
খালারা গত মাসে যখন সপরিবার বরিশাল যাচ্ছিলেন, আমাকেও যাওয়ার জন্য প্রস্তাব করলেন। আমি রাজি হয়ে গেলাম। কারণ, বাসে, ট্রেনে, এমনকি নৌকায় ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে; কিন্তু লঞ্চে ভ্রমণের সুযোগ হয়নি। খালাতো ভাই চয়নের মুখে লঞ্চ ভ্রমণের অনেক মজার মজার কথা শুনেছি। তাই রাজি হতে মোটেও দেরি করিনি।
বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে আমরা সদরঘাটে পৌঁছলাম। ঘাটের টিকিট কিনে প্রবেশ করলাম জেটিতে। দেখলাম প্রকাণ্ড সব লঞ্চ জেটির সঙ্গে বাঁধা। প্রত্যেক অঞ্চলের লঞ্চ আলাদা আলাদা করে রাখা। কর্মচারীরা নিজ নিজ লঞ্চে ওঠার জন্য যাত্রীদের জোর গলায় ডেকে চলেছে। জেটিতে প্রচুর মানুষ। নানা গন্তব্যের যাত্রীরা নিজেদের লঞ্চটি খুঁজে নিচ্ছে। কেউ একা, কারো সঙ্গে পরিবারের সদস্যরা। হকাররা তাদের পণ্য সাজিয়ে যাত্রীদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছে। হকাররা শুধু জেটিতেই নয়, নৌকায় করেও বিক্রি করছে তাদের জিনিসপত্র। নদীর ওপার থেকে ছোটো ছোটো নৌকায় যাত্রীরা এপারে আসছে।
প্রত্যেকটি লঞ্চই উজ্জ্বল আলোয় সজ্জিত। আমাদের লঞ্চটি বেশ বড়। লঞ্চের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে নির্ধারিত স্থানে ব্যাগ ও অন্যান্য জিনিস রাখলাম। লঞ্চটি ৫ তলাবিশিষ্ট। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৮০ মিটার। বেশ কৌতূহল নিয়ে লঞ্চটি ঘুরে ঘুরে দেখলাম। দোতলা ও তিন তলায় সারবাঁধা বিলাসবহুল কক্ষ । নিচতলার পুরোটাই ডেক। নিচতলার ডেকের মেঝেতে যাত্রীরা চাদর বিছিয়ে নিজের শোয়ার ব্যবস্থা করছে। লঞ্চের পিছন দিকে ইঞ্জিনরুম, রেস্তোরাঁ ও একটি চায়ের দোকান। জানা গেল জরুরি চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। আর নিরাপত্তার জন্য টহল দিচ্ছে আনসার সদস্যরা।
রাত সাড়ে ৮টার দিকে লঞ্চটি বরিশালের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল। যদিও লঞ্চ ছাড়ার সময় ছিল সাতটা। ধীরে ধীরে জেটির মানুষগুলো ছোটো হতে হতে ঝাপসা হয়ে গেল। আমরা ঘাট থেকে অনেক দূরে চলে এলাম। লঞ্চের সারেং একটু পরপর সাইরেন বাজাচ্ছেন আর সার্চলাইট ফেলে পথটা দেখে নিচ্ছেন। অনেকক্ষণ চলার পর একটি বড়ো নদী দেখতে পেলাম। একূল ওকূল দেখা যায় না। খালার কাছ থেকে জেনে নিলাম নদীটির নাম মেঘনা। এটি বাংলাদেশের গভীরতম ও প্রশস্ততম নদী। রেলিং ধরে দাঁড়ালে যতদূর চোখ যায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোটো ছোটো আলোকবিন্দু চোখে পড়ে। খালা জানালেন ওগুলো মাছধরা নৌকা। নৌকাগুলো দেখে ‘পদ্মানদীর মাঝি‘ উপন্যাসের কথা মনে পড়ে গেল ।
কিছুক্ষণ পরপর একটি দুটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভটভট আওয়াজ তুলে উল্টো দিকে যাচ্ছে কিংরা আমাদের লঞ্চ সেগুলোকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। আকাশের তারকারাজি আর নদীতে ভেসে থাকা আলোকবিন্দুগুলো অপরূপ দৃশ্য তৈরি করেছে। একসময় রাতের খাওয়ার সময় হয়ে গেল। লঞ্চে রান্না করে ইলিশ মাছ ভাজা, আলু আর শাক দিয়ে রাতের খাওয়া সারলাম। খাওয়া শেষে বসলাম কেবিনের সামনে চেয়ারে। সবাই মিলে রাতের নীরব সৌন্দর্য উপভোগ করে গল্প করতে করতে চললাম।
ঘড়িতে তখন রাত বারোটা। যাত্রীদের কেউ কেউ শুয়ে পড়েছে আবার কেউ কেউ আড্ডা দিচ্ছে। ডেকে হকার তেমন দেখা যাচ্ছিল না। খালামণি বরিশালের বিখ্যাত ব্যক্তিদের গল্প শোনাচ্ছেন। রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবী অশ্বিনীকুমার দত্ত, অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক, বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর, দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বর, ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যের রচয়িতা বিজয় গুপ্ত, কুসুমকুমারী দাশ ও তাঁর পুত্র জীবনানন্দ দাশ, সুফিয়া কামাল, কামিনী রায়, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানের রচয়িতা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী এবং গানটির সুরকার আলতাফ মাহমুদসহ আরো অনেকের কথা জানলাম যাঁরা এই বরিশালেরই মানুষ । প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশের শহরে যাচ্ছি ভেবে রোমাঞ্চিত হলাম। হঠাৎ নৌপুলিশের একটি স্পিডবোট গতি কমিয়ে পাশ দিয়ে চলে গেল। যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও অবৈধ মালামাল পরিবহণ রোধে এই অন্ধকার রাতেও তারা টহল দিচ্ছে। দূরে আরো কয়েকটি লঞ্চ দেখা যাচ্ছে। সারেং মাঝে মাঝে সাইরেন বাজাচ্ছে। একটু পরপরই সার্চলাইট ফেলে পথ দেখে নিচ্ছে। সারেঙের কক্ষে গিয়ে দেখলাম কত রকমের প্রযুক্তি তারা ব্যবহার করছে – ‘রাডার, কম্পাস, জিপিএস ইত্যাদি।
প্রথমবার লঞ্চে চড়ছি বলে উত্তেজনায় আমার ঘুম আসছিল না। খালামণির কথায় শুয়ে পড়লাম। ভোর পাঁচটার দিকে খালামণি ডেকে তুললেন – ‘এই তোরা ওঠ! আমরা বরিশালে পৌঁছে গিয়েছি।’ আমি বেশ হুড়মুড় করে উঠে পড়লাম। দেখলাম লঞ্চটি ইতোমধ্যে ঘাটে বাধা হয়েছে। আরো কয়েকটি লঞ্চ বাধা থাকতে দেখলাম ঘাটে। যাত্রীরা নেমে যাচ্ছে। ভিড় কমলে আমরাও ব্যাগগুলো নিয়ে নেমে পড়লাম। গত রাতের এই লঞ্চ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আমার জীবনের স্মরণীয় একটি রাত হয়ে থাকবে। অসাধারণ একটি ভালো-লাগা অনুভূতি নিয়ে প্রথমবারের মত পা ফেললাম জীবনানন্দের শহরে।
অন্যান্য রচনা:
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন রচনা (৭৫০ শব্দ) | এসএসসি এইচএসসি
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রচনা (১২০০ শব্দ)
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল রচনা/কর্ণফুলী টানেল রচনা
2 comments
[…] লঞ্চ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা রচনা (৬০০ শব্দ) | … […]
[…] লঞ্চ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা রচনা (৬০০ শব্দ) | … […]
Comments are closed.