শিল্প বলতে কি বোঝায়
প্রকৃতিপ্রদত্ত অপরিসীম সম্পদের সবগুলো আমরা অনেক সময় সরাসরি ভোগ করতে পারি না। এ সম্পদকে ব্যবহারের উপযোগী করে তোলার জন্য নানাবিধ প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হয়। বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে সম্পদের আকৃতিগত কিংবা রূপগত পরিবর্তন সাধন করার প্রয়োজন হয়। প্রকৃতিপ্রদত্ত সম্পদকে ব্যবহারের উপযোগী করে তোলার জন্য যেসব প্রক্রিয়া ব্যবহার করা হয় তাকে শিল্প বলে। অন্যভাবে বলা যায়, সম্পদের রূপগত উপযোগ সৃষ্টিই হলো শিল্প। সাধারণভাবে আমরা পণ্য ও সেবার উৎপাদনকে শিল্প হিসেবে অভিহিত করে থাকি। উদাহরণস্বরূপ, বনের একটি বৃহৎ বৃক্ষ সরাসরি কেটে এনে এটিকে বসার আসন হিসেবে ব্যবহার করা যথেষ্ট অসুবিধাজনক। চেয়ার বানানোর জন্য উক্ত গাছটিকে প্রক্রিয়াজাত করে এর আকৃতি পরিবর্তন করে রূপগত উপযোগ সৃষ্টি করা হয়। এ প্রক্রিয়াই হলো শিল্প।
ব্যবসায়ের উদ্দেশ্য সমূহ আলোচনা কর |
নিচে শিল্প সম্পর্কে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির সংজ্ঞা দেয়া হলো:
১. P.H.Collin (পি.এইচ, কলিন): “শিল্প হলো সকল কারখানা, প্রতিষ্ঠান অথবা প্রক্রিয়া যা পণ্য প্রস্তুতের সাথে সম্পৃক্ত”।।
২. M.C. Shukla (এম.সি.শুকলা): “পণ্যের উত্তোলন, উৎপাদন, রূপান্তরকরণ, প্রক্রিয়াকরণ কিংবা সংযোজন প্রক্রিয়াকে শিল্প বলে।”
৩. অধ্যাপক মৃত্যুঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “যে কর্মপ্রচেষ্টা প্রকৃতি থেকে সম্পদ আহরণের মাধ্যমে তার রূপান্তর ঘটিয়ে মানুষের ব্যবহার্য পণ্য বা সেবা তৈরি করে তাকে শিল্প বলে।”
পরিশেষে বলা যায়, যে প্রক্রিয়া বা কর্মপ্রচেষ্টা দ্বারা প্রকৃতিপ্রদত্ত সম্পদ আহরণ করে এর প্রক্রিয়াজাতকরণ বা রূপান্তরের মাধ্যমে উপযোগ সৃষ্টি করা হয় তাকে শিল্প বলে।
শিল্পের প্রকারভেদ
প্রকৃতিগত দিক বিবেচনায় শিল্পকে ছয় ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন-
১. কৃষিজাত শিল্প
কৃষিজাত শিল্প হচ্ছে সে ধরনের শিল্প যা জলবায়ু ও মাটি থেকে প্রকৃতিগতভাবে উৎপাদিত হয়ে থাকে। যেমন- ধান, গম ইত্যাদি ফসল উৎপাদন কৃষিজাত শিল্পের উদাহরণ।
২. প্রজনন শিল্প
প্রজনন বা জন্মদানের সাথে সম্পর্কিত শিল্পকে প্রজনন শিল্প বলা হয়। এ শিল্প প্রজনন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উৎপাদন কার্যে নিয়োজিত থাকে। হাঁস-মুরগি প্রতিপালন, মৎস্য চাষ, নার্সারি ইত্যাদি প্রজনন শিল্পের উদাহরণ।
৩. নিষ্কাশন শিল্প
প্রকৃতিপ্রদত্ত বিভিন্ন উৎস থেকে সম্পদ আহরণ করাই নিষ্কাশন শিল্পের কাজ। যেমন- খনি থেকে আকরিক, কয়লা, লোহা, খনিজ তেল ইত্যাদি উত্তোলন।
৪. উৎপাদনমূলক শিল্প
বিভিন্ন প্রকার প্রাথমিক দ্রব্য বা কাঁচামালকে যন্ত্র ও শ্রমের সাহায্যে রূপান্তরিত করে রূপগত উপযোগ সৃষ্টি করা হলে তাকে উৎপাদন শিল্প বলে। পাট শিল্প, বস্ত্র শিল্প, যন্ত্র শিল্প, চিনি শিল্প ইত্যাদি এর উদাহরণ। উৎপাদন শিল্পকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন-
(ক) প্রক্রিয়াজাত শিল্প: এ শিল্প কাঁচামাল বা-আধাপ্রস্তুত সামগ্রীকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যবহারের উপযোগী পণ্যে রূপান্তর করে। যেমন- পাট শিল্প।
(খ) বিশ্লেষণমূলক শিল্প: যে শিল একই বস্তু থেকে কয়েক প্রকার দ্রব্য উৎপাদন করে তাকে বিশ্লেষণমূলক শিল্প বলে। একটি বিশেষ বস্তুকে বিশ্লেষণের মাধ্যমে সে বস্তু থেকে এক বা একাধিক পণ্য তৈরি করা হয় বলে এরূপ শিল্পকে বিশ্লেষণমূলক শিল্প বলে। যেমন- খনিজ তেলকে পরিশোধন করে পেট্রোল, কেরোসিন, আলকাতরা, মবিল ইত্যাদি পাওয়া যায়।
(গ) যৌগিক শিল্প: এ শিল্প বিভিন্ন প্রকার কাঁচামাল মিশ্রণ করে একটি পণ্য উৎপাদন করে। যেমন- সিমেন্ট শিল্প, সাবান ও সার শিল্প ইত্যাদি।
(ঘ) সংযোজন শিল্প: বিভিন্ন যন্ত্রাংশ একত্রিত করে একটি নতুন পণ্য তৈরি করা হলে তাকে সংযোজন শিল্প বলে। যেমন- সাইকেল ও ঘড়ি তৈরির শিল্প। বাস, ট্রাক, মোটরগাড়ি, টেলিভিশন ইত্যাদি সংযোজন শিল্পের তৈরি পণ্য।
(ঙ) সমন্বিত শিল্প: এ শিল্পে বিশ্লেষণ, যৌগিক, সংযোজন ইত্যাদি প্রক্রিয়া সম্পাদন করা হয়। যেমন- লোহা ও ইস্পাত শিল্প। এ ধরনের শিল্পে বিভিন্ন প্রকার শিল্প-প্রক্রিয়ার সমন্বয় ঘটে।
ব্যবসায়ের আওতা ও পরিধি বর্ণনা কর |
৫. সেবা পরিবেশক শিল্প
যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহ জনগণকে সেবার উপকরণাদি পরিবেশন করে থাকে সেগুলোকে সেবা পরিবেশক শিল্প বলা হয়। যেমন- বিদ্যুৎ উৎপাদন, গ্যাস উৎপাদন ইত্যাদি।
৬. নির্মাণ শিল্প
এর দ্বারা সাধারণত ঐসব, শিল্পকে বুঝানো হয় যেগুলো সেতু, বাঁধ, রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি ইত্যাদি নির্মাণ কাজে ব্যবহার করা হয়।
পরিচালনা ও আয়তনগত দিক বিবেচনায় শিল্পকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়:
(ক) রাষ্ট্র পরিচালিত শিল্প: রাষ্ট্র পরিচালিত শিল্প বলতে রাষ্ট্র কর্তৃক চালিত ও নিয়ন্ত্রিত শিল্পকে বুঝায়। সাধারণত সেবামূলক, বৃহদায়তন ও ঝুঁকিপূর্ণ শিল্প রাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত হয়। অস্ত্র কারখানা, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, টেলিফোন শিল্প সংস্থা, পাটকল সংস্থা ইত্যাদি এ জাতীয় শিল্পের উদাহরণ।
(খ) বৃহদায়তন শিল্প: আয়তনের দিক থেকে বৃহদাকার শিল্প এর অন্তর্ভুক্ত। এগুলো অধিক ঝুঁকিসম্পন্ন এবং সাধারণত কোম্পানি ব্যবসায় বা রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। যেমন- চন্দ্রঘোনা পেপার মিল, গ্রামীণ ফোন ইত্যাদি।
(গ) ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প: এগুলো স্বল্প পুঁজি এবং সীমিত স্থান ও স্বল্প শ্রমভিত্তিক শিল্প। তাঁত শিল্প, মৃৎশিল্প, হস্তশিল্প ইত্যাদি এ শিল্পের অন্তর্ভুক্ত।
আশাকরি, উপরের আলোচনা থেকে আপনারা শিল্প বলতে কি বোঝায়, শিল্পের প্রকারভেদ সম্পর্কে সঠিক ও বিস্তারিত জ্ঞানলাভ করতে পেরেছেন।