সামাজিক ব্যবসায়
কোনো আর্থিক স্বার্থের বিষয়টিকে প্রাধান্য না দিয়ে বরং সামাজিক কল্যাণ অর্জনের বিষয়কে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিবেচনায় এনে ব্যবসায় পরিচালনা করাকেই সামাজিক ব্যবসায় বলে। সামাজিক ব্যবসায়ের ধারণাটি সর্বপ্রথম প্রবর্তন করেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহম্মদ ইউনূস। তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “Creating a World without Poverty: Social Business and the Future of Capitalism” নামক গ্রন্থে সামাজিক ব্যবসায়ের ধারণাটি ব্যাখ্যা করেন। তাঁর রচিত এ গ্রন্থে তিনি সামাজিক ব্যবসায়ের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, “সামাজিক ব্যবসায় হলো ক্ষতিবিহীন, লভ্যাংশবিহীন কোম্পানি- যা বর্তমান বাজারকে সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে একটি সামাজিক উদ্দেশ্যকে লক্ষ করে পরিচালিত হয়ে থাকে। এটি অলাভজনক ব্যবসায় থেকে আলাদা, কারণ এ ব্যবসায় পরিমিত লভ্যাংশ অর্জনের পেছনে কাজ করে; কিন্তু এ লভ্যাংশ কোম্পানির অর্জন বা প্রাপ্তিকে বর্ধিত করতে থাকবে, এটি পণ্য বা সেবার মানোন্নয়ন সাধন করবে অথবা যে কোনোভাবেই হোক সামাজিক উন্নয়নের উদ্দেশ্য অর্জনের পথকে সুগম করবে।”
শিল্পের গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর |
বর্তমানে গোটা বিশ্বে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত পুঁজিবাদী ব্যবসায়ের বিপরীতধর্মী ব্যবসায় হচ্ছে সামাজিক ব্যবসায়। এ ব্যবসায়ের মূল বক্তব্য হচ্ছে, লাভ-লোকসানের কথা চিন্তা না করে সমাজবদ্ধ মানুষের কল্যাণার্থে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালিত হওয়া উচিত। এ ব্যবসায়ের উদ্দেশ্য হলো ব্যবসায় পরিচালনার মাধ্যমে সমাজের প্রভূত উপকার সাধন করা। এ ধরনের ব্যবসায়ের পেছনে মুনাফা লাভের উদ্দেশ্য নিহিত থাকে না। সামাজিক ব্যবসায়ে বিনিয়োগকারীগণ অথবা এর উদ্যোক্তাগণ পর্যায়ক্রমে বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত পেলেও এক্ষেত্রে কোনো লভ্যাংশ গ্রহণ করে না।
এ ধারণার উপর ভিত্তি করে প্রফেসর ড. মুহম্মদ ইউনূস ২০০৫ সালে বগুড়ায় ‘গ্রামীণ ডানোন ফুড’ নামে একটি সামাজিক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। বিশ্বখ্যাত শিশুখাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ‘ডানোন’ এর সাথে যৌথ উদ্যোগে তিনি এই প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। প্রতিষ্ঠানটির মূল লক্ষ্য হলো দেশে অপুষ্টিতে ভোগা বিপুল সংখ্যক অবহেলিত শিশুদের জন্য সুলভ মূল্যে পুষ্টিসমৃদ্ধ শিশুখাদ্য সরবরাহ করা।
সামাজিক ব্যবসায়ের গুরুত্ব
সমাজজীবনে মানুষ জীবিকা অর্জনের জন্য নানা ধরনের কাজ করে। অর্থনীতির ভাষায় এ নিয়ম সকল অবস্থায় সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এমতাবস্থায় কেউ হয় শ্রমিক, কেউ বা হয় শিক্ষক, সাংবাদিক, ডাক্তার, উকিল, প্রকৌশলী, নির্বাহী; আবার কেউ হয় ব্যবসায়ী। বস্তুতপক্ষে এ সবই পেশা। এ সকল পেশাকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যথা: (i) পেশা হিসেবে চাকরি ও (ii) পেশা হিসেবে ব্যবসায়।
ব্যবসায় হলো জীবিকার্জনের একটি অন্যতম উপায়। মানুষ অসীম অভাব পূরণের জন্য মুনাফা অর্জনের উদ্দেশে পণ্যদ্রব্য ও সেবাসামগ্রী উৎপাদন, বণ্টন ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কার্যাবলি সম্পাদন করে থাকে। সমাজে বসবাসরত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, কনসালটেন্ট ইত্যাদি ব্যক্তিবর্গও সেবা পরিবেশন করার মাধ্যমে জীবিকার্জন করে। এদের কাজ পেশার অন্তর্ভুক্ত। তাই বলা যায়, ব্যবসায় ও পেশা উভয়েরই মূল উদ্দেশ্য হলো কাজ বা সেব্য পরিবেশনের মাধ্যমে জীবিকার্জন করা। তবে অনেকে ব্যবসায়কে পেশা হিসেবে গণ্য করতে চায় না।
স্বাধীনভাবে জীবিকা নির্বাহের উপায় হিসেবে ব্যবসায় অত্যন্ত আকর্ষণীয়। বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসায় জগতে মানুষ ব্যবসায়কে এক উল্লেখযোগ্য পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে। সমাজে স্বাধীনচেতা মানুষজন অন্যের অধীনে না থেকে স্বাধীনভাবে স্বাবলম্বী হতে চায়। তাই বর্তমান সময়ে শিক্ষিত যুবক-যুবতীগণ সরাসরি ব্যবসায়, বাণিজ্য ও শিল্পে প্রবেশ করে একদিকে নিজেদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে, অন্যদিকে ব্যবসায় সম্প্রসারণের মাধ্যমে সমাজে বেকার লোকদের কর্মের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি নিত্য নতুন পণ্যদ্রব্য ও সেবাকর্ম উৎপাদন করে সমাজে বসবাসরত মানুষের চাহিদা পূরণের মাধ্যমে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সহায়তা করছে।
স্বাধীনভাবে অর্থোপার্জনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবসায়, শিল্প ও বাণিজ্যের মাধ্যমে যত সহজে মুনাফা অর্জন করা যায় অন্য কোনো পেশার মাধ্যমে তা সম্ভব নয়। তবে ব্যবসায় রয়েছে ঝুঁকি। তাই ব্যবসায়কে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে হলে ব্যবসায় স্থাপনের উদ্যোগের পাশাপাশি ক্ষেত্র নির্বাচন, মূলধন সংগ্রহের উৎস নির্বাচন এবং সাথে সাথে ব্যবসায় জগতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য সততা, আত্মবিশ্বাস, মুনাফা, ঝুঁকি গ্রহণ ক্ষমতা, আন্তরিকতা ইত্যাদি গুণাগুণ থাকা আবশ্যক।
প্রত্যক্ষ সেবা কি? প্রত্যক্ষ সেবার বৈশিষ্ট্য কি কি? |
বর্তমান সময়ে জনপ্রিয় পেশাগুলোর মধ্যে ব্যবসায়, বিপণন, উৎপাদন, কৃষি, ব্যাংকিং, বিমা, পরিবহন, প্রতিনিধি মধ্যস্থব্যবসায়ী, দালাল, বিক্রয়-কর্মী, গুদামজাতকরণ, ব্যবসায়ের উপদেষ্টা, আয়কর উপদেষ্টা, হিসাবরক্ষক ও নিরীক্ষক, গবেষক, বিজ্ঞাপনী সংস্থা, সিনেমা প্রদর্শন, নাচ ও গান, শিক্ষকতা, চিকিৎসা, আইনজীবী, প্রকৌশলী প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। মোটকথা, অর্থ উপার্জনের উদ্দেশে পণ্যদ্রব্য ও সেবাকার্য উৎপাদন, বণ্টন ইত্যাদিতে সহায়ক কার্যাবলিই অন্যতম ব্যবসায় পেশা বলে বিবেচিত হয়।
সুতরাং উপর্যুক্ত আলোচনা হতে বলা যায় যে, যারা স্বল্প পরিমাণ পরিশ্রম করে অধিক মুনাফা অর্জন ও স্বাধীনভাবে জীবিকা নির্বাহ করতে আগ্রহী তাদের জন্য ব্যবসায়ই উত্তম পেশা।