একনায়কতন্ত্রের দোষ-গুণ
এই জগত সংসারে দোষ-গুণ নিয়েই সবকিছু আবর্তিত হচ্ছে। তেমনি একনায়কতন্ত্রেরও কিছু দোষ-গুণ আছে। এই লেখায় সে সম্পর্কেই তুলে ধরবো। চলুন তবে জেনে নিই একনায়কতন্ত্রের দোষ-গুণ গুলো কি কি?
একনায়কতন্ত্রের দোষ-ত্রুটিসমূহ
একনায়কতন্ত্রের কিছু গুণ থাকলেও এ সরকারের ত্রুটির পরিমাণ অনেক বেশি। নিচে একনায়কতান্ত্রিক সরকারের দোষ বা ত্রুটিগুলো উল্লেখ করা হলো-
১. গণতন্ত্র পরিপন্থী
একনায়কতন্ত্র গণতন্ত্রের সাথে সাংঘর্ষিক। এ সরকার ব্যক্তিস্বাধীনতাকে অস্বীকার করে। একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থা নাগরিক জীবনের মৌলিক অধিকারকে খর্ব করে। ফলে ব্যক্তিত্বের গুণাবলি এখানে বিকশিত হতে বাধার সম্মুখীন হয়।
২. প্রগতি বিরোধী
একনায়কতন্ত্র প্রগতি বিরোধী। এখানে ভিন্নমত ও আদর্শকে কঠোরভাবে দমন করা হয়। প্রতিভাবান ব্যক্তিরা স্বাধীনভাবে তাদের প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারে না। শিল্প, সাহিত্য, চলচ্চিত্র, প্রকাশনা কোনো ক্ষেত্রে যদি একনায়কের বিরুদ্ধে সামান্যতম বিরোধিতারও আভাস পাওয়া যায় তবে তার জন্য প্রাণদণ্ড বা নির্বাসন অনিবার্য। একনায়কের ইচ্ছা ও মতাদর্শ অনুসারে শিল্পী, সাহিত্যিক, দার্শনিক, চিন্তাবিদ সবাইকে চলতে হয়।
৩. দায়িত্বশীলতার অভাব
একনায়কতন্ত্রে সব ক্ষমতা নেতা ও দলের মধ্যে কেন্দ্রীভূত হয়। ফলে জনগণের মধ্যে দায়িত্ববোধ জন্ম নেয় না। জনগণ সুনাগরিকের গুণাবলির চর্চা ও অর্জনের মাধ্যমে দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।
৪. সাম্য ও স্বাধীনতা বিরোধী
একনায়কতন্ত্র সাম্যে বিশ্বাস করে না। স্বাধীনতার প্রতি একনায়কতন্ত্র শ্রদ্ধা পোষণ করে না। শাসকের পছন্দই একনায়কতন্ত্রে ব্যক্তির যোগ্যতা বিচারের মাপকাঠি।
একনায়কতন্ত্র কি | একনায়কতন্ত্র কাকে বলে |
৫. দুর্নীতির প্রসার
একনায়কতন্ত্র সীমাহীন দুর্নীতির জন্ম দেয়। কারও কাছে জবাবদিহি করতে হয় না বলে একনায়ক দুর্নীতিতে আষ্টে-পৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে। লর্ড এ্যাকটন এজন্যই বলেছেন যে, ‘সাধারণত ক্ষমতা মানুষকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে এবং সীমাহীন ক্ষমতা মানুষকে সীমাহীন দুর্নীতিগ্রস্ত করে।’ (Power tends to corrupt and absolute power corrupts absolutely.)
৬. স্বৈরতন্ত্রের নামান্তর
একনায়কতন্ত্র এক ব্যক্তি ও এক দলের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন। একনায়কগণ সংবিধান ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নন। তারা খেয়াল খুশিমতো শাসন ক্ষমতা পরিচালনা করে থাকেন।
৭. রাজনৈতিক শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব
রাজনৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে নাগরিক চেতনা বৃদ্ধি করা সম্ভব হলেও একনায়কতন্ত্রে রাজনৈতিক শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ বজায় থাকে না। এ ব্যবস্থায় সাধারণত একটি মাত্র রাজনৈতিক দল থাকে। উপরন্তু দলীয় সদস্যদের নিজস্ব ইচ্ছানুসারে মতামত প্রদানেরও সুযোগ নেই। তাঁরা শুধু একনায়কের ইচ্ছা প্রচার করে মাত্র। আবার বিরোধী কোনো রাজনৈতিক দলের অস্তিত্বকে স্বীকার করা হয় না বিধায় জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার উন্মেষও ঘটে না।
৮. বিপ্লবের সম্ভাবনা
একনায়কতন্ত্র বিপ্লবের আশঙ্কা থেকে মুক্ত নয়। কেননা, বিরোধী রাজনৈতিক দল প্রকাশ্যভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা থেকে বাধ্য হয়ে বিরত থাকে। কিন্তু এরা গোপনভাবে তৎপরতা চালায় এবং জনগণকে একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগঠিত করে। ফলে একনায়কতন্ত্রে বিপ্লবের সম্ভাবনা অধিক।
আপনারা পড়ছেন একনায়কতন্ত্রের দোষ-গুণ গুলো। এতক্ষণ একনায়কতন্ত্রের দোষ বা ত্রুটিগুলো জানলাম। এবার জানবো একনায়কতন্ত্রের কিছু গুণ সম্পর্কে।
একনায়কতন্ত্রের গুণ
একনায়কতন্ত্র গণতন্ত্র ও মানবিকতা বিরোধী স্বৈরতান্ত্রিক শাসন হওয়া সত্ত্বেও এর কিছু গুণ বা উপযোগিতা রয়েছে। নিচে একনায়কতন্ত্রের গুণাবলি বা সুবিধাসমূহ আলোচনা করা হলো:
১. বলিষ্ঠ নেতৃত্ব
একনায়কতন্ত্রে একজন ব্যক্তির শাসনকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। তাই যোগ্য নেতৃত্ব সৃষ্টিতে এটি অনন্য। সাধারণত একনায়ক ব্যক্তিত্বসম্পূর্ণ ও দক্ষ হয়ে থাকেন। তিনি জীবনের বিনিময়ে হলেও নিজের পছন্দের আদর্শের বাস্তবায়ন করে থাকেন। আর একনায়কের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে দেশ ও জাতি উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারে।
২. শক্তিশালী সরকার প্রতিষ্ঠা
একনায়কতন্ত্রের একটি বিশেষ গুণ হলো, এর মাধ্যমে শক্তিশালী সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়। কেননা, এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় সাধারণত একটিমাত্র দল থাকে এবং বিশেষ কোনো দলীয় কোন্দল থাকে না। এতে সবার সহযোগিতায় স্থিতিশীল ও শক্তিশালী সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়। এছাড়া এ ধরনের সরকার সাধারণত দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থাকতে পারে। কেননা, কঠোর শাসনের মাধ্যমে একনায়ক প্রাদেশিকতা, মতপার্থক্য ইত্যাদি দূর করে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে। Dictionary of Political Science এর ভাষায়, ‘The dictatorship remains in power for a long time with the help of his party and military, with the result that the government becomes stable.’
৩. সরকারের স্থায়িত্ব
একনায়কতান্ত্রিক শাসনের আর একটি বিশেষ গুণ হলো সরকারের দীর্ঘস্থায়িত্ব। গণতন্ত্রে জনমতের পরিবর্তন, দল ত্যাগ ইত্যাদি কারণে রাষ্ট্রের মধ্যে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করতে পারে। অনেক সময় অসময়ে সরকারের পতনও ঘটে থাকে। কিন্তু একনায়কতন্ত্রে একটিমাত্র দল থাকায় সেখানে কোনো বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় না। ফলে সরকার সুষ্ঠুভাবে শাসন পরিচালনা করতে পারে। তাছাড়া একনায়কের লৌহ কঠোর শাসনও একনায়কতন্ত্রের স্থায়িত্ব বিধান করে।
একনায়কতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য সমূহ আলোচনা কর |
৪. দক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা
একনায়ককে ক্ষমতা চর্চার জন্য কারও কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার সুযোগে একনায়ক তার দলীয় ও পছন্দের লোকের সাহায্যে দক্ষ প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলে। এতে করে একনায়কতান্ত্রিক সরকারের প্রশাসন হয় দক্ষ এবং সরকারের নীতি ও সিদ্ধান্তসমূহ দ্রুত বাস্তবায়িত হয়।
৫. দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার বাস্তবায়ন
একনায়কতান্ত্রিক শাসন সাধারণত স্থিতিশীল হয়। স্থায়িত্ব এ ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এর ফলে এ সরকারের পক্ষে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সহজতর। এটি রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখে।
৬. আর্থিক সাশ্রয়
একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একক ও দীর্ঘস্থায়ী নেতৃত্বের ফলে শক্তি ও সম্পদ ব্যয় করে বার বার নির্বাচন অনুষ্ঠান ও সরকার বদলের প্রশ্ন থাকে না। কোনো কাজ সম্পাদনের জন্য বাড়তি অর্থ, সময় ও শক্তি প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না। একনায়ক সহজেই কায়েমী স্বার্থের প্রতিরোধ ভেঙে দিয়ে দ্রুত সংস্কারমূলক কাজ নিষ্পন্ন করতে পারে। আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক রাষ্ট্রে একনায়করা মধ্যযুগীয় প্রথার বাধা ভেঙে আধুনিক শিক্ষা প্রবর্তন করে সমাজের ব্যাপক অগ্রগতি সাধন করেছেন।
৭. জরুরি অবস্থার মোকাবিলা
দেশের সংকটে একনায়কতান্ত্রিক শাসন বিশেষ উপযোগী। কেননা, একনায়কের হাতে রাষ্ট্রীয় সর্বময় ক্ষমতা থাকায় বড় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা কিংবা যুদ্ধের মতো জরুরি পরিস্থিতিতে তিনি দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। এভাবে সংকট মোকাবিলা করা সহজ হয়। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এ ধরনের ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নিতে অনেক সময় ও জটিল প্রক্রিয়া অনুসরণের প্রয়োজন হয়। সোভিয়েত শাসক জোসেফ স্টালিন (Stalin) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে দৃঢ়ভাবে পরাক্রমশালী জার্মানির আক্রমণ মোকাবিলা করে রাশিয়াকে রক্ষা করেন।
৮. জাতীয়তাবাদ
একনায়কতন্ত্রে জনগণ জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়। একনায়কের উদ্দীপনামূলক বক্তব্যে প্রভাবিত হয়ে জনগণের মধ্যে দেশপ্রেম সঞ্চারিত হয়। এভাবে জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা বৃদ্ধি পায়। তবে উগ্র জাতীয়তাবাদ বিপদের জন্ম দেয়। জার্মানিতে নাৎসিবাদের (Nazism) প্রচারিত জাতীয়তাবাদ এর উদাহরণ।
৯. দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি
একনায়কতন্ত্র বড় এমনকি বৈপ্লবিক ধরনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে রাষ্ট্রকে দ্রুত উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে সক্ষম। অসীম ক্ষমতার অধিকারী একনায়কের কাজ বা পরিকল্পনায় কেউ বাধা দিতে পারে না বলেই তা সম্ভব হয়।
১০. জাতীয় সংহতি প্রতিষ্ঠা
যেসব দেশে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি নিয়ে মতৈক্য নেই, দল এবং উপদলে বিভক্ত এবং রাষ্ট্রীয় সংহতির নিদারুণ অভাব, সেখানে একনায়ক জাতীয় সংহতি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।
উপরিউক্ত একনায়কতন্ত্রের দোষ-গুণ বিষয়ক আলোচনা থেকে বলা যায়, আদর্শের বিচারে একনায়কতন্ত্র বিশ্বের সবচাইতে নিন্দিত মতবাদ। এই ব্যবস্থায় যতটা সৃষ্টি হয়েছে, ধ্বংস হয়েছে তার চাইতে সহস্রগুণ বেশি। নিষ্পেষণ, নির্যাতন আর স্বাধীনতা হরণের মধ্য দিয়ে কোনো জাতি বিকশিত ও সমৃদ্ধশালী হতে পারে না।