যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের সাফল্যের শর্তাবলী
যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের মতো একটি জটিল সরকারের সাফল্য যথেষ্ট কষ্টসাধ্য। বিশেষ করে কেন্দ্রাভিমুখী ও কেন্দ্রত্যাগী- এই দুই বিপরীতধর্মী শক্তির মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করে সাফল্য অর্জন করা যথেষ্ট কষ্টকর। এ কারণে এই দুই প্রবণতার মধ্যে সুসামঞ্জস্য বিধান করা যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের সাফল্যের প্রথম ও প্রধান শর্ত।
উপরোক্ত শর্ত ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের সাফল্যের জন্য আরও কতকগুলো গুরত্বপূর্ণ শর্ত রয়েছে। যথা:
১. যুক্তরাষ্ট্রীয় মনোভাব
যুক্তরাষ্ট্রীয় মনোভাব ব্যতীত যুক্তরাষ্ট্রের সাফল্য সম্ভব নয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় মনোভাব বলতে বোঝায় নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ও নিজ নিজ স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে পরস্পরের সাথে সংযুক্ত হওয়ার মনোভাব। অঙ্গরাজ্যগুলোর মধ্যে ঐক্যবোধ জাগ্রত না হলে যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হবে না। আবার ঐক্যবোধের আধিক্য দেখা দিলেও এককেন্দ্রিক সরকার সৃষ্টির প্রবণতা সৃষ্টি হতে পারে। এ কারণে যথাযথভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিকে অনুধাবন করে ঐক্যবদ্ধ হওয়া এবং ঐক্যবদ্ধ হয়েও নিজের অস্তিত্ব বিলীন না করে স্বকীয়তা বজায় রাখার মাধ্যমেই যুক্তরাষ্ট্র সফল হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার কি ও যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের বৈশিষ্ট্য |
২. ভৌগোলিক নৈকট্য
ভৌগোলিক নৈকট্য যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের সফলতার অন্যতম শর্ত। ভৌগোলিক নৈকট্য ছাড়া বিভিন্ন প্রদেশের অধিবাসীদের মধ্যে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় না। তাই প্রদেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সম্প্রীতির বন্ধন দৃঢ় করতে তাদের ভৌগোলিক নৈকট্য একান্তভাবে প্রয়োজন।
৩. ভাষা, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐক্য
যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থার অন্যতম শর্ত হলো ভাষা, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐক্য। ভাষা, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ঐক্য নাগরিকদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতা বৃদ্ধি করে। ফলে জাতীয় ঐক্য সুদৃঢ় হয়। পক্ষান্তরে, এগুলোর অনুপস্থিতি প্রদেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বিরোধ সৃষ্টি করে। যেমন- ভারতের কাশ্মীর ও পাঞ্জাবের শিখদের বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাবের মূলে রয়েছে ধর্মীয় ঐক্য। আবার পাকিস্তান সৃষ্টির পর ভাষা ও সাংস্কৃতিক বিরোধ পাকিস্তান ভাঙনের সূত্রপাত ঘটায়।
৪. দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা
দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের সফলতার শর্ত হিসেবে অনেকে মতপ্রকাশ করেন। তারা মনে করেন, দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় আইনসভার উচ্চকক্ষে সব অঙ্গরাজ্যের সমান প্রতিনিধিত্ব থাকা উচিত। এই লেখকগণ মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাফল্যের জন্য কেন্দ্রীয় প্রশাসনেও সব অঙ্গরাজ্যের সমান প্রতিনিধিত্ব থাকা উচিত।
৫. সংবিধানের প্রাধান্য
সংবিধানের প্রাধান্য যুক্তরাষ্ট্রের সাফল্যের অন্যতম প্রধান শর্ত। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার স্রষ্টা সংবিধান। এ কারণেই সংবিধানকে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ও পবিত্রতম আইন বলা হয়ে থাকে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান সুস্পষ্ট, সুনিদিষ্ট ও সুলিখিত হওয়া আবশ্যক। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় নাগরিক ও অঙ্গরাজ্যগুলোর অধিকার ও স্বার্থরক্ষার প্রধান রক্ষাকবচ হলো সংবিধান। এ কারণে সংবিধান দুম্পরিবর্তনীয় হওয়া প্রয়োজন। তবে সংবিধান যেন অচল ও স্থবির না হয়ে পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার। একটি আদর্শ ও উত্তম সংবিধান হিসেবে একদিকে যেমন সমাজ পরিবর্তন ও জাতীয় অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে, তেমনি সংবিধান যেন কারো স্বেচ্ছাচার ও ক্রীড়নকে পরিণত না হয় সেদিকেও সতর্ক থাকতে হবে।
৬. সৎ ও সুযোগ্য নেতৃত্ব
সৎ, দেশপ্রেমিক ও সুযোগ্য নেতৃত্ব ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র সফল হয় না। জর্জ ওয়াশিংটন, ম্যাডিসন, হ্যামিল্টন, জেফারসন ও লিঙ্কনের মতো সুযোগ্য ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতারা পৃথিবীর বুকে প্রথম যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার প্রতিষ্ঠা এবং তা সফল করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
৭. সুস্থ দলব্যবস্থা
সুস্থ দলব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের সাফল্যের অন্যতম শর্ত বলে অনেকে মত দিয়েছেন। তারা মনে করেন, সুস্থ ও সংহত রাজনৈতিক দল থাকলে বিভিন্ন অঞ্চলের স্বার্থের সমন্বয় সম্ভবপর হয়। সুস্থ ও সংহত দল বলতে জাতীয় স্বার্থকে তুলে ধরতে সক্ষম এরূপ দলকেই বোঝানো হয়েছে। এসব দল সুসংহত হলে তারা একদিকে আঞ্চলিক স্বার্থ সম্পর্কে যেমন সচেতন থাকবে, তেমনি জাতীয় স্বার্থকে অক্ষুণ্ণ রাখার মনোভাবও তাদের মধ্যে কাজ করবে।
এককেন্দ্রিক সরকার কাকে বলে ও এককেন্দ্রিক সরকারের বৈশিষ্ট্য |
৮. আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল
আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা ও পরমতসহিষ্ণুতা যুক্তরাষ্ট্রের সাফল্যের একটি শর্ত। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম নীতি হলো ‘আইন মান্য করার মনোভাব।’ কোনটি সংবিধান কর্তৃক পরিচালিত হচ্ছে, কোনটি সংবিধান বহির্ভূত তা নির্ধারণ করার জন্য শক্তিশালী যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতের রায়কে সহজে মান্য করে নেওয়ার মানসিকতা সবার মধ্যে না থাকলে যুক্তরাষ্ট্র ব্যর্থ হতে বাধ্য।
৯. উপযুক্ত শিক্ষার বিস্তার ও রাজনৈতিক চেতনা
যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থাকে গ্রহণ ও সংরক্ষণ করার মতো সচেতন ও দায়িত্বশীল নাগরিক বিশেষভাবে প্রয়োজন। এ জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের শিক্ষাদীক্ষা ও রাজনৈতিক চেতনার বিকাশের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবোধের সৃষ্টি এবং একই সাথে আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্যবোধের সৃষ্টি করতে হবে। তবেই যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা সাফল্য লাভ করবে।
১০. আর্থিক সামর্থ্য
যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থা অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও জটিল সরকার পদ্ধতি। এ সরকারব্যবস্থা পরিচালনা ও প্রতিপালনের জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সামর্থ্য থাকতে হবে। তা না হলে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থার সাফল্য অর্জিত হবে না।
পরিশেষে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের সাফল্যের পশ্চাতে সবচাইতে বড় শক্তি হলো সুশিক্ষিত, সচেতন, দায়িত্বশীল নাগরিকবৃন্দ এবং তাদেরকে যথাযথভাবে পরিচালিত করার জন্য সৎ, দক্ষ ও যোগ্য নেতৃত্ব। প্রকৃত শিক্ষা ও রাজনৈতিক চেতনার অভাব থাকলে নাগরিকদের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের দ্বৈত নাগরিকত্ব ও দ্বৈত আনুগত্য সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট ধারণা সৃষ্টি হবে না। ফলে তারা স্থানীয় সংকীর্ণ মনোভাবে আক্রান্ত হয়ে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থকে মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হবে। তাই একথা সত্য যে, সুশিক্ষিত ও প্রজ্ঞাবান নাগরিক এবং যোগ্য নেতৃত্ব যুক্তরাষ্ট্রের সাফল্যের জন্য অপরিহার্য শর্ত।