বিচার বিভাগ কি?
সরকারের যে বিভাগ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে আইন বিভাগ প্রণীত আইনসমূহকে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে অপরাধীর দণ্ড বিধান করে থাকে তাকে বিচার বিভাগ বলে অভিহিত করা হয়। এটি সরকারের তিনটি বিভাগের মধ্যে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ। নাগরিকদের স্বাধীনতা ও অধিকারকে অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য বিচার বিভাগ বিচারকার্য পরিচালনা করে। দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের আদালতের সমন্বয়ে গঠিত হয় সরকারের বিচার বিভাগ। বস্তুত বিচার বিভাগের দক্ষতা ও নিপুণতার ওপরই নির্ভর করে শাসনব্যবস্থার উৎকর্ষ। এ জন্যই অধ্যাপক লাস্কি বলেছেন, ‘একটি রাষ্ট্র কীভাবে বিচারকার্য পরিচালনা করে তার মাধ্যমে সে রাষ্ট্রের নৈতিকতার মান সঠিকভাবে পরিমাপ করা যায়।’ যেকোনো রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থায় বিচার বিভাগের গুরুত্ব অপরিসীম। একটি দেশের শাসনব্যবস্থার মান নির্ণয় করা যায় বিচার ব্যবস্থার দক্ষতার মাধ্যমে। এ প্রসঙ্গে লর্ড ব্রাইস বলেন, ‘কোনো সরকারের যোগ্যতা পরিমাপ করার সবচেয়ে উত্তম ও আদর্শ মানদণ্ড হলো বিচার বিভাগ।’
শাসন বিভাগ কি বা কাকে বলে? শাসন বিভাগের গঠন আলোচনা কর |
বিচার বিভাগের গঠন
যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থায় দুই ধরনের আদালত থাকে। একটি হলো কেন্দ্রীয় আদালত, অন্যটি হলো আঞ্চলিক স্তরের আদালত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রীয় অঙ্গরাজ্যগুলোতে রাজ্য আদালতের সাথে সাথে যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতের শাখাও বর্তমান থাকে। ব্রিটেন ও ফ্রান্সে আপিল আদালতসহ দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত রয়েছে। তবে ব্রিটেনে আইন বিভাগের উচ্চকক্ষ লর্ডসভা সর্বোচ্চ আপিল আদালত হিসেবে কাজ করে। জার্মানিতে দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার বিচারের জন্য সাধারণ আদালত রয়েছে। বাংলাদেশের বিচার বিভাগ স্তরভিত্তিক। বিচার বিভাগের শীর্ষে রয়েছে সুপ্রিম কোর্ট এবং সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে গ্রাম আদালত, ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভার সালিশী আদালত। সুপ্রিম কোর্ট আবার হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগ নিয়ে গঠিত। নিম্নে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের সাংগঠনিক রূপ, আলোচনা করা হলো:
১. নিম্ন আদালত
অপরাধের প্রকৃতি অনুযায়ী নিম্ন আদালত দুভাবে বিভক্ত। যথা: (১) ফৌজদারি আদালত ও (২) দেওয়ানি আদালত। ফৌজদারি আদালতে অপরাধ সংক্রান্ত বিবাদের বিচার হয়। দেওয়ানি আদালতে সম্পত্তি সংক্রান্ত বিবাদগুলোর বিচার হয়। ১ম, ২য় ও ৩য় শ্রেণির ক্ষমতাপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ফৌজদারি মামলার বিচার করে থাকেন। এসব ম্যাজিস্ট্রেট আদালত হতে দায়রা জজের আদালতে আপিল পেশ করা যায়। পূর্বে উপজেলা পর্যায়ের বিচারের জন্য ‘মুন্সেল্ফ আদালত’ গঠিত হয়েছিল। বর্তমানে সহকারী জজগণ উপজেলার বিচারের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও জেলা সদরে ‘সাবজজ আদালত’ রয়েছে, যা বর্তমানে ‘যুগ্ম জেলা জজ’ আদালত নামে অভিহিত। যুগ্ম জেলা জজগণ যখন ফৌজদারি মামলা পরিচালনা করেন তখন তাঁরা সহকারী দায়রা জজ হিসেবে অভিহিত হন। এছাড়াও বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকায় রয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ এবং পৌরসভার সালিসী আদালত।
২. মধ্যম স্তরের আদালত
মধ্যম স্তরের আদালতে গুরুতর মামলার প্রথম শুনানি হয়, বিচার হয় এবং নিম্ন আদালতের আপিল গ্রহণ করা হয়। এ স্তরের আদালতে দেওয়ানি ও ফৌজদারি উভয় প্রকারের মামলার বিচার করা হয়। দেওয়ানি মামলার জন্য জেলা জজের আদালত এবং ফৌজদারি মামলা নিষ্পত্তির জন্য দায়রা বা সেসন জজ আদালত কাজ করে। নিম্ন আদালত হতে প্রদত্ত রায় পুনর্বিবেচনার জন্য মধ্যস্তরের অর্থাৎ, জেলা জজ আদালতসমূহে আপিল করা হয়। এসব আদালতে বড় বড় মামলার প্রথম শুনানি ও বিচার হয়। অতিরিক্ত দায়রা জজ এবং দায়রা জজের প্রধান আদালত আসামীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ প্রদান করতে পারে। তবে এরূপ মৃত্যুদণ্ডাদেশের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অনুমোদন লাভ করতে হয়। বর্তমানে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালত’ নামে বিশেষ আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ আদালত দায়রা জজ আদালতের সমমানের।
৩. উচ্চ স্তরের আদালত
সুপ্রিম কোর্ট বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত। এই আদালত আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ নিয়ে গঠিত। এটি দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ের ভূমিকা পালন করে। উচ্চ আদালত নিম্ন আদালতের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনা দান করে থাকে। এছাড়া রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ও উচ্চমূল্যের মামলার বিচার কার্য পরিচালনা করে থাকে। মধ্যম স্তরের আদালতের রায়ের আপিলের মীমাংসা করে থাকে। এছাড়া রাষ্ট্রের সংবিধানের ব্যাখ্যা, সাংবিধানিক বিরোধ মীমাংসা এবং সংবিধান রক্ষকের ভূমিকা পালন করে উচ্চ আদালত। উচ্চ আদালত শাসন বিভাগকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দান করে থাকে।
বিচারক নিয়োগ পদ্ধতি
বিচারকদের নিয়োগ পদ্ধতি বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন প্রকার হতে পারে। তবে সাধারণভাবে নিম্নোক্ত তিনটি পদ্ধতি বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে অবলম্বন করা হয়-
১. জনগণ বা নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটের মাধ্যমে
কোনো কোনো রাষ্ট্রে বিচারকগণ জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে থাকেন। ফ্রান্সে জনগণ কর্তৃক প্রত্যক্ষভাবে বিচারক নিয়োগের পদ্ধতি সর্বপ্রথম চালু হয়। তবে ফ্রান্সে এই নিয়োগ পদ্ধতি এখন আর নেই। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কতকগুলো অঙ্গরাজ্যের আদালতসমূহের বিচারকগণ জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে থাকেন। সুইজারল্যান্ডের কয়েকটি ক্যান্টনেও এ প্রথা প্রচলিত আছে। কিন্তু জনগণ কর্তৃক বিচারক নির্বাচন নানাভাবে সমালোচিত হয়েছে। জনগণ কর্তৃক বিচারক নির্বাচন ত্রুটিপূর্ণ; কারণ জনগণ দলীয় প্রচারে ও ভাবাবেগে বিভ্রান্ত হয়ে অযোগ্য প্রার্থী নির্বাচিত করতে পারে। ফলে বিচারকদের নিরপেক্ষতা ও যোগ্যতার হানি ঘটবে। অধ্যাপক লাস্কি এর মতে, ‘বিচারকদের নিয়োগ পদ্ধতিসমূহের মধ্যে জনগণ কর্তৃক প্রত্যক্ষ নির্বাচন হচ্ছে ব্যতিক্রমহীনভাবে নিকৃষ্ট।’ (Of all the methods of appointment that of election by the people at large is without exception the worst).
শাসন বিভাগের ক্ষমতা ও কার্যাবলী আলোচনা কর |
২. আইনসভা কর্তৃক
কোনো কোনো দেশে আবার বিচারকগণ আইনসভার ভোটে নির্বাচিত হয়ে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ, সুইজারল্যান্ডে বিচারকগণ সে দেশের আইনসভার সদস্যদের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে থাকেন। এ ব্যবস্থাও অনেকের মতে ত্রুটিপূর্ণ। কারণ এতে যোগ্যতা অপেক্ষা রাজনৈতিক বিবেচনা বড় হয়ে দেখা দেয়। এছাড়া এ পদ্ধতি ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নীতির লঙ্ঘন এবং এর ফলে বিচার বিভাগ আইনসভার অধীনস্থ হয়ে পড়ে। এতে করে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা বাধাগ্রস্ত হয়।
৩. শাসন বিভাগ কর্তৃক নিয়োগ
বিচারকগণ আবার শাসন বিভাগের প্রধান কর্তৃক নিযুক্তি লাভ করে থাকেন। এ পদ্ধতিই আধুনিককালে বিচারক নিয়োগের সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় পদ্ধতি। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই বিচারকগণ শাসন বিভাগ কর্তৃক নিয়োগ লাভ করে থাকেন। তবে এক্ষেত্রে প্রধান নির্বাহীকে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। বাংলাদেশে প্রধান বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্টের অন্যান্য বিচারপতিগণ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান কর্তৃক নিযুক্ত হয়ে থাকেন। অধ্যাপক লাস্কি (Prof. Laski)-এর মতে, ‘All judicial appointments should be made on the recommendation of the Minister of Justice, with the consent of a standing committee of the judges, which would represent all sides of their work.”