Home » বঙ্গভঙ্গের কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর
বঙ্গভঙ্গের কারণ ও ফলাফল, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের কারণ ও ফলাফল,

বঙ্গভঙ্গের কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর

by Susmi
0 comment

আজকে অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বঙ্গভঙ্গ তথা বঙ্গভঙ্গের কারণ ও ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা করবো।

বঙ্গভঙ্গ

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক এবং শাসনতান্ত্রিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ একটি অনন্যসাধারণ ঘটনা। মূলত কলকাতার ধনী ও সামন্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের একচেটিয়া আধিপত্যের নাগপাশ থেকে পূর্ব বাংলার অবহেলিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত জনসাধারণকে মুক্তিদানের লক্ষ্যেই ১৮৫০ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছিল। বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবের পেছনে যে মহান ব্যক্তিত্বের অক্লান্ত প্রচেষ্টা কাজ করছিল তিনি হলেন ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ। তিনি পূর্ব বাংলার গণমানুষের যে দাবি- ‘দাওয়া ব্রিটিশ সরকারের কাছে তুলে ধরেন, তার যৌক্তিকতা বিচার-বিশ্লেষণ করেই তৎকালীন ভারতের ভাইসরয় (Vice Roy) লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালে বাংলাকে বিভক্ত করে দুটি প্রদেশের সৃষ্টি করেন।

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পটভূমি এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
লর্ড কার্জন

লর্ড কার্জন

বঙ্গভঙ্গের কারণ

১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের কারণ সমূহ আলোচনা করার পূর্বে ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ বাংলাকে বিভক্ত করার পক্ষে যেসব দাবি ও যৌক্তিকতা তুলে ধরেন সে সম্পর্কে আলোকপাত করা প্রয়োজন। নবাব স্যার সলিমুল্লাহ উত্থাপিত যুক্তিগুলো নিম্নরূপ-

ক. তৎকালীন সময়ে হিন্দু সম্প্রদায় শিক্ষা ও সম্পদে অত্যন্ত অগ্রগামী ছিল বিধায় সরকারি চাকরি ও ব্যবসায় বাণিজ্যের কর্তৃত্ব তাদের হাতেই ন্যস্ত ছিল।

খ. হিন্দু জমিদারশ্রেণি মূলত কলকাতায়ই বসবাস করতেন এবং পূর্ববঙ্গ থেকে অর্থ উপার্জন করে কলকাতায় ব্যয় করতেন।

গ. তৎকালে কলকাতা বাংলা প্রদেশের রাজধানী হওয়ায় ব্যবসায় বাণিজ্য ও শিল্প-কারখানাগুলো কলকাতাকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে। এর ফলে যে সুযোগ-সুবিধার সৃষ্টি হয় তা থেকে পূর্ববঙ্গের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বঞ্চিত হয়।

ঘ. রাজধানী কলকাতা ছিল রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র এবং নেতৃত্ব ছিল হিন্দুদের হাতে।

৫. জাতীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে হিন্দুদের কর্তৃত্ব বিদ্যমান থাকায় সকল সুযোগ-সুবিধা তারাই ভোগ করত। এক্ষেত্রে পূর্ববঙ্গের মুসলমান সম্প্রদায় ছিল পশ্চাৎপদ।

এসব যুক্তির আলোকে নবাব স্যার সলিমুল্লাহ আশা পোষণ করেন যে, যদি বঙ্গকে ভাগ করা হয় তাহলে যে সুবিধা বা সুফল হবে তা হলো- পূর্ববঙ্গ ও আসাম দুটি প্রদেশের সৃষ্টি হলে পূর্ববঙ্গের মুসলমানগণ ব্যবসায় বাণিজ্য ও সরকারি চাকরির সুযোগ পাবে। শিল্প, যাতায়াত ও শিক্ষাক্ষেত্রে পূর্ববঙ্গ উন্নত হবে। রাজনীতির ক্ষেত্রে মুসলমানদের প্রভাব প্রতিষ্ঠা পাবে। হিন্দু জমিদারদের প্রভাব হ্রাস পাবে এবং পূর্ববঙ্গের মুসলমানগণ নিজস্ব ঐতিহ্যানুযায়ী সামাজিক জীবনব্যবস্থা গড়ে তোলার সুযোগ পাবে।

লর্ড কার্জন উল্লিখিত যুক্তিসমূহ ও বাস্তব সুবিধার কথা বিচার-বিশ্লেষণ করে বঙ্গকে ভাগ করার উদ্যোগ নেন। তবে বিশেষজ্ঞমহল মনে করেন যে, ব্রিটিশ সরকারের বঙ্গভঙ্গের পশ্চাতে মূলত প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কারণই মুখ্য ছিল। এ সম্পর্কে নিচে সবিস্তারে আলোকপাত করা হলো-

১. প্রশাসনিক কারণ

বঙ্গকে বিভক্ত করার প্রশাসনিক যুক্তি দেখিয়ে ১৯০২ সালে লর্ড কার্জন ভারত সচিবকে লেখেন যে, বঙ্গ প্রদেশের আয়তন ২,০০,০০০ বর্গমাইল এবং জনসংখ্যা প্রায় ৭ কোটি ৮৫ লক্ষ। এ বিশাল আয়তন এবং বিপুল জনসংখ্যা অধ্যুষিত বাংলাকে একজন প্রশাসকের পক্ষে সুচারুরূপে শাসন করা সম্ভব নয়। পক্ষান্তরে, প্রতিবেশী আসাম প্রদেশ ছিল অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র এবং জনসংখ্যাও ছিল কম। এজন্য বাংলাকে বিভক্ত করে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম বিভাগ ও আসামকে নিয়ে ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ নামে একটি নতুন প্রদেশের সৃষ্টি করা হয়- যার রাজধানী হয় প্রাচীন শহর ঢাকা।

২. রাজনৈতিক কারণ

বাংলাকে বিভক্ত করার পশ্চাতে আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণ ছিল রাজনৈতিক। রাজনৈতিক কারণের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো হলো-

ক. জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ: ১৮৮৫ সালে ভারতদরদি ইংরেজ স্যার এলান অক্টোভিয়ান হিউম-এর নিরলস প্রচেষ্টায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস (Indian National Congress) প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ভারতের হিন্দু সমাজ সচেতন হয়ে ওঠে এবং ধীরে ধীরে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে তোলে। এতে ব্রিটিশ সরকার হতচকিত হয়ে প্রশাসনিক সঙ্কটে পড়ে যায়। এরূপ জাতীয়তাবাদী চেতনা ও সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনকে দমন করার জন্য ব্রিটিশ সরকার বাংলাকে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়।

খ. ভাগ কর ও শাসন কর: ব্রিটিশ সরকার Divide and Rule নীতিতে বিশ্বাসী। তাই বাংলাকে বিভক্ত করে একটি সম্প্রদায়কে নিজেদের অনুকূলে রেখে অপর সম্প্রদায়কে শাসন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে।

গ. মুসলমানদের উন্নতি সাধনের প্রয়াস: অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে মুসলমান সামন্তশ্রেণি মুসলমানদের স্বার্থ সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। অপরদিকে, স্যার সৈয়দ আহমদ আলীগড় আন্দোলনের মাধ্যমে মুসলমানদের স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টা চালান। ফলে ব্রিটিশ সরকার তাদের স্বার্থ সম্বন্ধে সচকিত হয়ে ওঠে।

৩. অর্থনৈতিক কারণ: তৎকালে বাংলা প্রেসিডেন্সির (বাংলা, উড়িষ্যা, বিহার ও ছোট নাগপুর) রাজধানী কলকাতাকে কেন্দ্র করে ব্যবসায় বাণিজ্য, শিল্পকারখানা গড়ে ওঠে। পূর্ব বাংলায় পাট উৎপন্ন হলেও F পাটকলগুলো গড়ে ওঠে কলকাতায়। ফলে কলকাতা অল্পদিনে সমৃদ্ধিশালী হয়ে ওঠে। অন্যদিকে, পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয় হতে থাকে। এরূপ অবস্থার হাত থেকে মুক্তির লক্ষ্যে স্বরাষ্ট্র সচিব মি. রিজলী প্রশাসনিক ও রাজস্ব আদায়ের সমস্যার কথা উল্লেখ করে বড় লাটকে পত্র লেখেন। উক্ত পত্রের যৌক্তিকতা বিচার করে বাংলা ভাগ করা হয়।

৪. সামাজিক ও সাম্প্রদায়িক কারণ: হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের সামাজিক ঐতিহ্য ও ধর্মীয় রীতিনীতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাই পূর্ববঙ্গের মুসলমানগণ নিজেদের সামাজিক ও ধর্মীয় আদর্শের ভিত্তিতে নতুন প্রদেশে সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রত্যাশা করে।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কি বা কাকে বলে ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলাফল

বঙ্গভঙ্গের ফলাফল

বঙ্গভঙ্গের ফলাফল সাময়িক হলেও বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সম্প্রদায় বেশি লাভবান হয়েছিল। নিচে বঙ্গভঙ্গের ফলাফল সবিস্তারে আলোচনা করা হলো-

১. মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া

বঙ্গভঙ্গের ফলে ঢাকা নতুন প্রদেশের তথা ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’-এর রাজধানী হয়। রাজধানী ঢাকাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান অফিস, আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। ফলে মুসলমানগণ নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা লাভে সক্ষম হয়। অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বড় বড় সুরম্য অট্টালিকা গড়ে ওঠায় ঢাকার শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। বঙ্গভঙ্গকে মুসলমানগণ তাদের হৃত গৌরব ও মর্যাদা ফিরে পাবার আনন্দে মেতে ওঠে। নবাব স্যার সলিমুল্লাহ বঙ্গভঙ্গ পরিকল্পনাটি কার্যকর করার দিন ঢাকায় এক জনসভায় বলেন, “বঙ্গভঙ্গ আমাদেরকে নিষ্ক্রিয়তার হাত থেকে মুক্তি দিয়েছে। এটা আমাদের উদ্দীপ্ত করেছে কর্মসাধনায় এবং সংগ্রামে।” অর্থাৎ বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ব বাংলার গণমানুষের ভাগ্যোন্নয়নের দ্বার উন্মোচিত হয়।

২. হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া

বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে হিন্দুদের অবস্থান ছিল খুবই কঠিন। বাংলার উচ্চ ও মধ্যবিত্ত হিন্দুরাই এর বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ঝড় তুলেছিল। কলকাতার আইনজীবী সমিতি মনে করল বঙ্গভঙ্গের অর্থ নতুন প্রদেশে হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠা করা। অপরদিকে, কলকাতার সাংবাদিকরাও তাদের স্বার্থ নস্যাৎ হবে জেনে এর বিরুদ্ধাচরণ শুরু করে।

পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষিত হিন্দু সমাজ মনে করে যে, পূর্ব বাংলায় ক্রমোন্নতিশীল শিক্ষিত ও রাজনীতি সচেতন হিন্দু সমাজের বিকাশ রোধের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ব্রিটিশ সরকার পূর্ব বাংলার মুসলমানদের প্রভাব বৃদ্ধির জন্য এ ব্যবস্থা নিয়েছে কাশিম বাজারের এক জনসভায় সভাপতি মহারাজা মহীন্দ্রচন্দ্র নন্দী বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদ করতে গিয়ে বলেন, “নয়া প্রদেশে মুসলমান জনগণের রাজত্ব হবে- বাঙালি ‘হিন্দুরা হয়ে পড়বে সংখ্যালঘু। আমরা নিজেদের মাটিতে আগন্তুক হয়ে পড়ব। এ সম্ভাবনায় আমি আতঙ্কিত। এ সম্ভাবনা আমাকে আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদ্বেগাকুল করে তোলে।”

৩. মুসলিম লীগের জন্ম: ১৯০৬ সালে কতিপয় মুসলিম নেতৃবৃন্দের প্রচেষ্টায় মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণ ও ব্রিটিশ সরকারের কাছে তাদের দাবি-দাওয়া পেশ করার জন্য সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল হিসেবে মুসলিম লীগের জন্ম হয়। পরবর্তীতে ১৯০৯ সালে মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইনে মুসলমানদের পৃথক নির্বাচন পদ্ধতি স্বীকৃত হলে হিন্দু সম্প্রদায় ক্ষোভে ফেটে পড়ে।

একদিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রবল বিরোধিতা ও ব্রিটিশ পণ্য বয়কট, অন্যদিকে উগ্র হিন্দুদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ফলে অবশেষে ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ রদ করেন।

আশাকরি, উপরের আলোচনা থেকে আপনারা বঙ্গভঙ্গের কারণ ও ফলাফল সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছেন। 

Related Posts