সুপ্রিয় পাঠকবৃন্দ, আজ আমি তুলে ধরবো ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন ও এ আইনের বৈশিষ্ট্য সমূহ। আশাকরি, এর মাধ্যমে অনেকেই মূল্যবান তথ্য জানতে পারবেন।
ভারতবর্ষের শাসনতান্ত্রিক জটিলতা নিরসনকল্পে ব্রিটিশ সরকার বিভিন্ন সময়ে যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করে ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন বা মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কার আইন তন্মধ্যে অন্যতম। পূর্বে ১৯০৯ সালে মর্লে-মিন্টো যে সংস্কার আইন প্রবর্তন করা হয় তাতে ভারতবাসীর দাবি-দাওয়া পূরণ না হওয়ায় তারা ক্ষুব্ধ হয় এবং ১৯১৪ সালে ব্রিটিশ সরকার প্রথম মহাযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় ভারতবাসীর সাহায্য-সহানুভূতি অপরিহার্য হয়ে ওঠায় ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের দাবি-দাওয়ার প্রতি নমনীয় হয়। ফলে ব্রিটিশ সরকার ১৯১৭ সালে এক নতুন নীতি ঘোষণা করেন। ১৯১৯ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসান হওয়ায় উক্ত নতুন নীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ভারত সচিব মন্টেন্ড এবং গভর্নর জেনারেল চেমসফোর্ড ১৯১৯ সালে ভারত শাসন আইন প্রবর্তন করেন।
মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পটভূমি বা প্রেক্ষাপট এবং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য |
১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের প্রেক্ষাপট
ব্রিটিশ শাসিত ভারতে ব্রিটিশদের এক তরফা নীতি গ্রহণের ফলে ভারতের শিক্ষিত ও সচেতন মহল ভারতে দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবিতে সুদৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে। হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠা ও স্বশাসনের লক্ষ্যে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ ঐকমত্য হন। এরূপ অবস্থায় Report on the Constitutional Reforms, 1918-এর ভিত্তিতে ১৯১৯ সালে ভারত শাসন আইন ঘোষিত হয়। উল্লেখ্য যে, ভারত সচিব E. S. Montague এবং গভর্নর জেনারেল Chemsford এই রিপোর্ট তৈরি করেন বলে এটাকে মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার রিপোর্টও বলা হয়ে থাকে। এর মূলনীতিগুলো নিম্নরূপ-
ক. স্থানীয় সংস্থাগুলোর ওপর জনগণের যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণ থাকবে এবং তারা বাইরের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত থাকবে।
খ. প্রদেশগুলোতে দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা (Responsible Government) প্রবর্তনের লক্ষ্যে আশু পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
গ. দায়িত্বশীলতার পক্ষে ভারত সরকারের সাময়িকভাবে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিকট জবাবদিহিতা থাকবে এবং
ঘ. ভারত সরকার ও প্রাদেশিক সরকারগুলোর ওপর থেকে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ও ভারত সচিবের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ক্রমশ হ্রাস পাবে।
১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের বৈশিষ্ট্য
ব্রিটিশ ভারতের সাংবিধানিক বিকাশে ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এ আইন বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ। নিচে উক্ত আইনের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ তুলে ধরা হলো-
১. সংসদীয় শাসন পদ্ধতি
১৯১৯ সালের আইনের প্রধান এবং অতীব আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো সংসদীয় পদ্ধতির শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন। এ ব্যবস্থায় আইনসভার সকল সদস্য জনসাধারণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন এবং নির্বাচিত সদস্যদের মধ্য থেকে মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হয়।
২. দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা
দায়িত্বশীলতা এ আইনের আরেকটি আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। সরকারের অর্থাৎ প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার সদস্যগণ স্ব স্ব আইনসভার কাছে তাদের যাবতীয় কাজের জন্য একক এবং যৌথভাবে দায়ী থাকবেন। তবে বাস্তবে এ দায়িত্বশীলতা খুবই সীমিত ছিল।
৩. দ্বৈতশাসন
১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য প্রদেশে দ্বৈতশাসন (Dyarchy) প্রবর্তন। প্রাদেশিক বিষয়গুলোকে দু শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়। যেমন- (ক) হস্তান্তরিত বিষয় (Transferred) এবং (খ) সংরক্ষিত বিষয় (Reserved)। হস্তান্তরিত বিষয়ের মধ্যে ছিল শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, শিল্প, স্থানীয় শাসন ইত্যাদি। আর সংরক্ষিত বিষয়ের মধ্যে অন্যতম ছিল আইনশৃঙ্খলা, বিচার ও পুলিশ এবং অর্থ। হস্তান্তরিত বিষয়গুলো গভর্নর ও প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা যৌথভাবে পরিচালনা করতেন। আর সংক্ষিত বিষয় কেবল গভর্নর ও শাসন পরিষদের নেতৃত্বে পরিচালিত হতো। এভাবে প্রাদেশিক শাসন সংক্রান্ত বিষয়কে দুভাগে বিভক্ত করায় একে দ্বৈতশাসন বলে অভিহিত করা হয়।
৪. প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন
এ আইনে প্রদেশে স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তন করা হয়। অর্থাৎ প্রাদেশিক সরকারগুলোকে স্বশাসনের সুযোগ দেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়া হয়। অথচ গভর্নর জেনারেলদের স্বৈরশাসনের কবলে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন অর্থহীন হয়ে পড়ে।
৫. ক্ষমতার বণ্টন
এ আইন কেন্দ্রীয় সরকার ও প্রাদেশিক সরকার প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক নীতি, শুল্ক ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পরিচালনার দায়িত্ব পালন করত। আর অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেমন স্থানীয় শাসন, জনস্বাস্থ্য, পূর্ত, শিল্প, আইনশৃঙ্খলা ইত্যাদি প্রাদেশিক সরকারের দায়িত্বে পরিচালিত হতো।
৬. গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা বৃদ্ধি
৯১৯ সালের আইন অনুযায়ী গভর্নর জেনারেলদের ক্ষমতা ব্যাপক পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। প্রধান শাসনকর্তা হিসেবে (Chief Executive) গভর্নর জেনারেল আইন প্রণয়নের ব্যাপক ক্ষমতা ভোগ করতেন। তিনি আইনসভার কোনো আইনকে নাকচ, কোনো আইনকে জরুরি হিসেবে প্রত্যায়িত করে বিধিবদ্ধকরণের ব্যবস্থা, আইনসভা ভেঙে দেওয়া এবং জরুরি অবস্থায় অধ্যাদেশ জারি করতে পারতেন।
৭. দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা
এ আইনের ফলে কেন্দ্রে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা প্রতিষ্ঠিত হয়। নিম্নকক্ষ ‘Legislative Assembly’ বা ব্যবস্থা পরিষদ। মোট ১৪৫ জন সদস্যের সমন্বয়ে নিম্ন পরিষদ গঠিত হয়। তন্মধ্যে ১০৫ জন সদস্য জনগণের ভোটে নির্বাচিত এবং ২৬ জন সরকার মনোনীত; বাকি ১৪ জন বেসরকারিভাবে মনোনীত। আর উচ্চকক্ষ Council of State বা রাজ্যসভা সর্বোচ্চ ৬০ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হয়। তন্মধ্যে ৩৪ জন নির্বাচিত এবং বাকি ২৬ জন সরকার কর্তৃক মনোনীত।
বঙ্গভঙ্গ রদের কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর |
৮. নির্বাচন ব্যবস্থা
১৯১৯ সালের আইনে নির্বাচন ব্যবস্থা বহাল রেখে উল্লেখ করা হয় যে, প্রাদেশিক আইন পরিষদের কমপক্ষে ৮০% সদস্য জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবেন এবং বাকি ২০% সদস্য সরকার কর্তৃক মনোনীত হবেন। এ দৃষ্টিকোণে প্রত্যেক প্রাদেশিক আইন পরিষদে তিন প্রকার সদস্য ছিলেন। অর্থাৎ নির্বাচিত সদস্য, সরকারি সদস্য ও মনোনীত সদস্য।
৯. পৃথক নির্বাচকমণ্ডলী
আইনে পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর ব্যবস্থা রাখা হয়। অর্থাৎ জাতি, ধর্ম, বর্ণভেদে পাঞ্জাবের শিখ, ভারতের খ্রিস্টান, ইউরোপীয় অধিবাসীদের জন্য পৃথক নির্বাচন পদ্ধতি অনুসৃত হয়। সে লক্ষ্যে প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক নির্বাচনি এলাকাও গঠন করা হয়।
১০. ভারতীয় হাইকমিশনার
এ আইনের মাধ্যমে ইংল্যান্ডে ভারতীয় হাইকমিশনার নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়। বিশেষত ইংল্যান্ডের ভারতীয় ছাত্র-শ্রমিকদের স্বার্থ ও বাণিজ্য সংক্রান্ত বিষয়াদি তত্ত্বাবধান করার লক্ষ্যে ভারতীয় হাইকমিশনারের পদ সৃষ্টি করা হয়।
১১. ব্রিটিশ রাজার বর্ধিত ক্ষমতা
এ আইনে ব্রিটিশ রাজার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ভারতবর্ষ সম্রাট বাহাদুরের নামে শাসিত হয় এবং তিনি কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের এবং প্রাদেশিক পরিষদের প্রণীত আইনকে বাতিল করার ক্ষমতা লাভ করেন।
১২. কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া
১৯১৯ সালের আইনে কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া গঠনের ব্যবস্থা বহাল রাখা হয়। উল্লেখ করা হয় যে, সর্বোচ্চ ১২ জন সদস্য নিয়ে এ কাউন্সিল গঠিত হবে। সদস্যদের মধ্যে কিছুসংখ্যক ভারতীয়ও ছিলেন।
১৩. ভারত সচিবের ক্ষমতা হ্রাস
এ আইনের মাধ্যমে গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে ভারত সচিবের ক্ষমতা সামান্য হ্রাস পায়। কারণ যদিও প্রাদেশিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয় তথাপিও ভারত সচিব প্রদেশে ভারতীয় মন্ত্রীদের কাছে হস্তান্তরিত বিষয়ের নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন।
১৪. বিধিবদ্ধ কমিশন গঠন
১৯১৯ সালের আইনে আরও উল্লেখ করা হয় যে, এ আইন প্রবর্তন হওয়ার ১০ বছর পর এর কার্যকারিতা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করার জন্য বিধিবদ্ধ কমিশন গঠনের ব্যবস্থা থাকবে।
বস্তুত ১৯১৯ সালের আইনে ভারতীয়দের দাবি-দাওয়ার প্রেক্ষিতে যেসব বিষয় বিধিবদ্ধ করা হয় বাস্তবে এর কোনো কার্যকারিতা প্রত্যক্ষ করা যায়নি। বরং সকল আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ধূলিসাৎ করে ভারত সচিব ও গভর্নর জেনারেলের স্বৈরশাসনের পথকে সুগম করা হয়েছে। এজন্য এন, সি. রায়, (N. C. Roy) তাঁর ‘Constitutional History of India’ গ্রন্থে বলেন, “১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনকে এদেশবাসী কখনো সাদরে গ্রহণ করেনি।”