ভারতীয় উপমহাদেশের জনগণের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের সোনালি ফসল ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন (The Indian Independent Act. 1947)। এ আইনের মাধ্যমে ভারতবর্ষে দীর্ঘ দু শ বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে। মূলত ভারতের রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা নিরসনকল্পে ১৯৪৬ সালের ৩ জুন পরিকল্পনাকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৯৪৭ সালের ১০ জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে Indian Independent Act, 1947 পাস হয়।
১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইনের প্রেক্ষাপট
মন্ত্রিমিশন পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার কারণে ভারতে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ গঠন নিয়ে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে। এ সময় ভারতের নতুন ভাইসরয় লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের সাথে ক্ষমতা হস্তান্তর ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি রক্ষার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালান। কিন্তু এ প্রচেষ্টায় তিনি ব্যর্থ হয়ে ঘোষণা করেন, “ভারত বিভাগ ছাড়া ভারতে শান্তি প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প উপায় নেই।” পরবর্তীতে সাম্প্রদায়িকতার ভয়াবহতায় কংগ্রেস ভারত বিভক্তি মেনে নিতে বাধ্য হয়। এমতাবস্থায় ১৯৪৭ সালের ৩ জুন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দের সাথে এক ঘরোয়া বৈঠকে লর্ড মাউন্টব্যাটেন যে পরিকল্পনা তুলে ধরেন তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৯৪৭ সালের ৪ জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারত স্বাধীনতা আইনের খসড়া বিল পেশ করা হয় এবং পার্লামেন্ট কর্তৃক ১৮ জুলাই আইনটি পাস হয়।
লাহোর প্রস্তাবের পটভূমি আলোচনা কর |
১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইনের বৈশিষ্ট্য
১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন বিভিন্ন দিক দিয়ে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। নিচে এ আইনের বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরা হলো-
১. দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি
ভারত স্বাধীনতা আইনের মাধ্যমে ভারতবর্ষের ওপর থেকে দীর্ঘ দু শ বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে। সেই সাথে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান এবং ১৫ আগস্ট ভারতীয় ইউনিয়ন নামে দুটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম হয়। পূর্ববাংলা, পশ্চিম পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং পাকিস্তানে যোগদানকারী কয়েকটি দেশীয় রাজ্যের সমন্বয়ে পাকিস্তান গঠিত হয়। পক্ষান্তরে, ভারতবর্ষের অবশিষ্ট অংশ নিয়ে ভারত ইউনিয়ন গঠিত হয়। পাকিস্তান ও ভারত ইউনিয়ন উভয়ই ডোমিনিয়নের মর্যাদা লাভ করে।
২. নতুন প্রদেশের সৃষ্টি
১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইনের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য দুটি নতুন প্রদেশের সৃষ্টি। বাংলা প্রদেশকে বিভক্ত করে পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম বাংলা নামে দুটি প্রদেশ সৃষ্টি করা হয়। গণভোটের মাধ্যমে আসাম প্রদেশের সিলেট জেলাকে পূর্ববাংলার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আবার পাঞ্জাবকে বিভক্ত করে পশ্চিম পাঞ্জাব ও পূর্ব পাঞ্জাব নামে দুটি নতুন প্রদেশের সৃষ্টি হয়।
৩. গণপরিষদ গঠন
ভারত ও পাকিস্তান ডোমিনিয়নের সংবিধান প্রণয়নের জন্য দুটি গণপরিষদ গঠন করা হয়। গণপরিষদের হাতে সংবিধান প্রণয়নের পূর্ণ দায়িত্ব ও ক্ষমতা ন্যস্ত হয়। তবে উল্লেখ করা হয় যে, নতুন সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত উভয় দেশের গণপরিষদ দেশের কেন্দ্রীয় আইনসভা হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে।
৪. গভর্নর জেনারেল নিয়মতান্ত্রিক প্রধান
ভারত স্বাধীনতা আইনের মাধ্যমে উভয় ডোমিনিয়নের কেন্দ্রীয় শাসনের জন্য একজন গভর্নর জেনারেল থাকবেন যিনি ব্রিটিশ কেবিনেটের পরামর্শ অনুযায়ী রাজা/রানী কর্তৃক নিযুক্ত হবেন। গভর্নর জেনারেল নিয়মতান্ত্রিক প্রধানের দায়িত্ব পালন করবেন। তবে গভর্নর জেনারেলের স্বেচ্ছাধীন ও বিচারবুদ্ধিজনিত ক্ষমতা বিলুপ্ত করা হয়।
৫. ১৯৩৫ সালের আইনের কার্যকারিতা
এ আইনে উল্লেখ করা হয় যে, নতুন সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্তানের শাসনকার্য ১৯৩৫ সালের আইন অনুযায়ী পরিচালিত হবে। তবে প্রয়োজনানুযায়ী উক্ত আইনের পরিবর্তন করা যেতে পারে। এ ব্যবস্থা উভয় ডোমিনিয়নের সকল প্রদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। এ লক্ষ্যে ১৯৩৫ সালের আইনের নিম্নোক্ত পরিবর্তন আনয়ন করা হয়।
ক. স্বাধীন ভারত ও পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেলদ্বয় স্ব-স্ব দেশের মন্ত্রিসভার পরামর্শ অনুযায়ী ব্রিটিশ রাজা কর্তৃক নিযুক্ত হবেন। সেই সাথে প্রাদেশিক গভর্নরগণ ডোমিনিয়ন মন্ত্রিসভার পরামর্শ অনুযায়ী গভর্নর জেনারেল কর্তৃক নিযুক্ত হবেন।
খ. গভর্নর জেনারেল ও গভর্নরদের স্বেচ্ছাধীন ও বিচারবুদ্ধিজনিত ক্ষমতা বিলোপ করা হয়।
গ. কেন্দ্রে প্রচলিত দ্বৈত শাসনব্যবস্থার বিলোপ করা হয়।
ঘ. উভয় দেশের গণপরিষদকে সংবিধান প্রণয়ন অবধি কেন্দ্রীয় আইনসভার মর্যাদা দেওয়া হয়।
৬. আইনসভার ক্ষমতা
প্রত্যেক ডোমিনিয়নের আইনসভাকে আইন প্রণয়নের পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া হয়। ডোমিনিয়নের আইনসভা প্রণীত আইন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আইনের সাথে সংগতিপূর্ণ না হওয়ার কারণে বাতিল বলে গণ্য হবে না। এ আইন ব্রিটিশ রাজার পরিবর্তে গভর্নর জেনারেলের সম্মতিক্রমে কার্যকরী হবে।
৭. দেশীয় রাজ্যগুলোর স্বাধীনতা
এ আইনের মাধ্যমে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট হতে দেশীয় রাজ্যগুলোর ওপর থেকে ব্রিটেনের রাজার সার্বভৌম ক্ষমতার অবসান ঘটে। দেশীয় রাজ্যগুলো এখন থেকে যেকোনো ডোমিনিয়নে যোগ দিতে বা স্বাধীনভাবে থাকতে পারবে। সেই সাথে দেশীয় রাজ্যগুলোর সাথে ব্রিটেনের রাজার সম্পাদিত সকল সন্ধি ও চুক্তির বিলুপ্তি ঘটবে।
লাহোর প্রস্তাবের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর |
৮. ভারত সচিব পদের বিলুপ্তি
১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইনে ভারত সচিব পদের অবসান ঘটে। পাকিস্তান ও ভারত ইউনিয়নের সাথে সংযোগ রক্ষার জন্য কমনওয়েলথ সচিবের ওপর দায়িত্ব অর্পিত হয়।
৯. রাজকীয় উপাধির বিলুপ্তি
এ আইনে রাজকীয় মর্যাদা ও উপাধি হতে ভারত সম্রাট (Emperor of India) উপাধির বিলুপ্তি ঘটে। এখন থেকে ভারতের শাসন সংক্রান্ত বিষয় থেকে ব্রিটিশ সরকারকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়।
১০. কমনওয়েলথে যোগদানের স্বাধীনতা
ব্রিটিশ কমনওয়েলথে যোগদানের ব্যাপারে পাকিস্তান ও ভারতীয় ইউনিয়নকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা দেওয়া হয়। ডোমিনিয়ন গণপরিষদ এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
১১. গভর্নর জেনারেল ও গভর্নরের নিয়োগ
প্রত্যেক ডোমিনিয়নে একজন করে গভর্নর জেনারেল এবং প্রদেশে গভর্নর থাকবেন। ডোমিনিয়ন মন্ত্রিসভার পরামর্শ অনুযায়ী ব্রিটিশ রাজা কর্তৃক গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হবেন এবং গভর্নর জেনারেল মন্ত্রিসভার পরামর্শ অনুযায়ী প্রাদেশিক গভর্নর নিয়োগ করবেন।
১২. সামরিক-বেসামরিক কর্মচারী বণ্টন
১৯৪৭ সালের আইনের মাধ্যমে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বেসামরিক কর্মচারীদের ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয় এবং পূর্বের ন্যায় সকল সুযোগ-সুবিধার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়।
১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন ভারতীয় উপমহাদেশের জনগণের দীর্ঘ আন্দোলনের সোনালি ফসল একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। দুটি বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি ভারতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ কখনো পৃথক আবার কখনো ঐক্যবদ্ধভাবে পূর্ণ স্বায়তশাসন কিংবা স্বাধীনতা অর্জনের আন্দোলন অব্যাহত রেখেছিল। ব্রিটিশ সরকার এ দুটি সংগঠনের দাবি-দাওয়ার প্রতি লক্ষ্য রেখেই ১৯৪৭ সালে ভারতকে বিভক্ত করে দুটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটায়। এতে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়েই সন্তুষ্ট ছিল।
লাহোর প্রস্তাবের গুরুত্ব আলোচনা কর |
১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইনের গুরুত্ব
১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইন উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং অবিস্মরণীয় ঘটনা। ১৯৪৭ সালের ১০ জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হওয়া এ আইনের মাধ্যমে উপমহাদেশে দীর্ঘ প্রায় দু শ বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে। ভারতবর্ষ ভেঙে দুটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম হয়- পাকিস্তান ও ভারত। এ আইনের মাধ্যমে ভারতবর্ষে ব্রিটিশরাজের নিয়ন্ত্রণের পরিসমাপ্তি ঘটে। ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি নতুন রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের সূচনা ঘটে। দুটি রাষ্ট্রই স্বাধীনভাবে স্ব-স্ব সংবিধান প্রণয়নের ক্ষমতা লাভ করে। সুতরাং ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইনের গুরুত্ব অত্যধিক।