১৯৭২ সালের সংবিধানের বৈশিষ্ট্য সমূহ
বিশ্বের অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংবিধানের ন্যায় বাংলাদেশের সংবিধানও অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এজন্য এটি বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম সংবিধানগুলোর অন্যতম। নিচে ১৯৭২ সালের সংবিধানের বৈশিষ্ট্য সমূহ তুলে ধরা হলো-
১. লিখিত দলিল
বিশ্বের অন্যান্য স্বাধীন দেশের সংবিধানের ন্যায় বাংলাদেশের সংবিধানও লিখিত এবং সুস্পষ্ট। এ সংবিধানের অধিকাংশ ধারা লিপিবদ্ধ আকারে আছে। এতে ১টি প্রস্তাবনা, ১১টি ভাগ, ৪টি তফসিল ও ১৫৩টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। সংবিধানে শাসনব্যবস্থার প্রকৃতি, রাষ্ট্রভাষা, জাতীয় সংগীত, জাতীয় প্রতীক ইত্যাদির সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে।
২. প্রস্তাবনা
বাংলাদেশের মূল সংবিধানে একটি সুন্দর ও আকর্ষণীয় প্রস্তাবনা সংযোজিত হয়েছে। প্রস্তাবনায় সাধারণত সংবিধানের মূলনীতি এবং সাধারণ লক্ষ্যের উল্লেখ আছে। এতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার আকার, সংবিধানের উৎস ও এর আইনগত নৈতিক ভিত্তি উল্লেখ রয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ানের ইতিহাস আলোচনা কর |
৩ দুষ্পরিবর্তনীয়
বাংলাদেশের সংবিধানের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো এটা দুষ্পরিবর্তনীয় প্রকৃতির। সংবিধানের কোনো ধারা বা অংশ পরিবর্তন করতে বিশেষ পদ্ধতির অনুসরণ করতে হয়, যা সংবিধানের দশম ভাগে উল্লেখ আছে। সংবিধানের কোনো ধারা বা বিধানসমূহ পরিবর্তন, সংশোধন বা রহিতকরণের জন্য জাতীয় সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোট প্রয়োজন হয়।
৪. রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি
বিশ্বের অন্যান্য দেশের সংবিধানের ন্যায় বাংলাদেশের সংবিধানেও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির উল্লেখ করা হয়েছে। মূল সংবিধানে চারটি মূলনীতি সংবিধানের মূলস্তম্ভ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যথা- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।
৫. মৌলিক অধিকারের সন্নিবেশ
সংবিধানের তৃতীয় ভাগে বাংলাদেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের সন্নিবেশ করা হয়েছে। সংবিধানে মৌলিক অধিকারের সন্নিবেশ করায় সংবিধানের শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে। বাক-স্বাধীনতা, সম্পত্তি ক্রয়ের স্বাধীনতা, সাম্যের স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার লাভের অধিকার, সরকারি চাকরি লাভের অধিকার, ধর্মীয় অধিকার প্রভৃতি মৌলিক অধিকার হিসেবে ঘোষিত হয়। মৌলিক অধিকারগুলো কোনো কারণে লঙ্ঘিত হলে ভিকটিম বা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আশ্রয় নিয়ে সুবিচার লাভ করতে পারে।
৬. সংবিধানের প্রাধান্য
সংবিধানকে দেশের সর্বোচ্চ ও চূড়ান্ত আইন বলে আখ্যায়িত করা হয়। কোনো আইন সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক বা অসামঞ্জস্যপূর্ণ হলে কেবল অসামঞ্জস্যপূর্ণ অংশটুকু বাতিল বলে গণ্য হবে। আরও বলা হয়, জনগণই প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক এবং জনগণের পক্ষে সংবিধানের অধীনে সেই ক্ষমতা প্রয়োগ ও কার্যকর হবে।
৭. গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা
বাংলাদেশের সংবিধানে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ভিত্তি সুদৃঢ়ভাবে স্থাপন করা হয়েছে। গণতন্ত্রে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার, ভোটাধিকার, মৌলিক মানবাধিকার, বাক ও চিন্তার স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়। গণতন্ত্রে সমতার নীতি অনুসৃত হয়।
৮. সংসদীয় সরকার পদ্ধতি
বাংলাদেশের সংবিধান দেশের জন্য সংসদীয় তথা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার পদ্ধতির প্রবর্তন করেছে। এটা সংবিধানের একটি অতি আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়, “প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ।” এ ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীসহ গোটা মন্ত্রিপরিষদ নির্বাহী ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। রাষ্ট্রপ্রধান তথা রাষ্ট্রপতি নামমাত্র বা সাংবিধানিক প্রধানের ভূমিকা পালন করেন। মন্ত্রিপরিষদ তাদের যাবতীয় কাজের জন্য ব্যক্তিগত ও যৌথভাবে নির্বাচিত আইন পরিষদের নিকট দায়ী থাকেন। আইন পরিষদের আস্থা হারালে সরকার বা ‘মন্ত্রিপরিষদকে পদত্যাগ করতে হয়।
৯. এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা
সংবিধানে দেশের জন্য এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভার উল্লেখ আছে, যার নাম জাতীয় সংসদ (House of the Nation)। জাতীয় সংসদের স্থায়ী কার্যালয় রাজধানী ঢাকায়। এর সদস্য সংখ্যা ৩০০ জন এবং ১৫ জন সংরক্ষিত মহিলা সদস্যসহ সর্বমোট ৩১৫ জন। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংরক্ষিত মহিলা আসন ৫০টি করা হয়েছে। সংসদের মেয়াদ ৫ বছর।
১০. এককেন্দ্রিক সরকার
বাংলাদেশ একটি এককেন্দ্রিক প্রজাতন্ত্র। এর কোনো প্রদেশ বা প্রাদেশিক সরকার নেই। রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা একটিমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকবে। রাষ্ট্রপ্রধান সংসদ সদস্যদের ভোটে পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। দেশের সকল অংশের ওপর কেন্দ্রীয় সরকারের • একক নিয়ন্ত্রণ বিদ্যমান।
১১. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা
বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধান দেশের জন্য গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনপূর্বক একে সুদৃঢ়করণের লক্ষ্যে স্বাধীন নিরপেক্ষ বিচার বিভাগের ব্যবস্থা রেখেছে। একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ বা অতন্দ্র প্রহরীস্বরূপ। অন্যদিকে স্বাধীন বিচার বিভাগ নাগরিক অধিকারের অভিভাবক।
১২. বহুদলীয় ব্যবস্থা
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার একটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হলো বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা। গণতন্ত্রের সফলতার জন্য সংবিধানে বহুদলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। বর্তমানে দেশে প্রায় ১০০টির বেশি রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম অব্যাহত আছে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনের গুরুত্ব ব্যাখ্যা কর |
১৩. দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষা
বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয় যে, কোনো সংসদ সদস্য তাঁর নিজ দল থেকে পদত্যাগ করলে বা সংসদে দলের বিপক্ষে ভোট দিলে অথবা দলের নির্দেশ অমান্য করলে বা ভোট প্রদানে বিরত থাকলে সংসদে তাঁর আসন শূন্য হবে।
১৪. দায়িত্বশীল মন্ত্রিপরিষদ
মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারের একটি বড় গুণ হলো মন্ত্রীদের জবাবদিহিতা। অর্থাৎ মন্ত্রিপরিষদ তাদের যাবতীয় কাজের জন্য ব্যক্তিগত এবং যৌথভাবে আইনসভার নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবেন। সেই সাথে আইনসভার আস্থা হারালে তারা পদত্যাগ করবেন।
১৫. ন্যায়পালের পদ সৃষ্টি
প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণের জন্য সংবিধান ন্যায়পালের পদ সৃষ্টি করেছে, যা ৭৭ অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং অধস্তন দপ্তরের কর্মকর্তাদের কার্যের তদারকির জন্য সংসদ আইনের দ্বারা ন্যায়পালের পদ সৃষ্টি করতে পারবে।
১৬. সর্বজনীন ভোটাধিকার
সংবিধান সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ব্যবস্থা রেখেছে। সকল প্রাপ্তবয়স্ক তথা ১৮ বছর বয়সের নাগরিক সকল নির্বাচনে ভোট প্রদান এবং শর্তসাপেক্ষে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হতে পারবে। গণতন্ত্রে ভোটাধিকার নাগরিকের শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক অধিকার।
১৭. জনগণের সার্বভৌমত্ব
আমেরিকার সংবিধানের ন্যায় বাংলাদেশের সংবিধানেও ‘জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ সংসদে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করবে।
১৮. প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল
সংবিধানে সাধারণ বিচার ব্যবস্থা ছাড়াও প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল গঠনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সরকারি কর্মচারীদের নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, বরখাস্ত, দণ্ড ও কর্মের মেয়াদ এবং রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগ, সম্পত্তির পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত বিষয়ের ওপর প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালকে এখতিয়ার দেওয়া হয়।
১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের সংবিধান কার্যকর হওয়ার পর থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১৭টি সংশোধনী প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। এতে রাজনৈতিক ব্যবস্থা, সরকার পদ্ধতি, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসন ইত্যাদির ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল এবং সংরক্ষিত মহিলা আসন ৫০ করা হয়েছে। ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের পদের মেয়াদ বাড়ানো হয়। এবং সর্বশেষ ৮ জুলাই ২০১৮ সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচনের বিধি আরও ২৫ বছর বহাল রাখার প্রস্তাব সম্বলিত সংবিধানের সপ্তদশ সংশোধনী বিল পাস হয়েছে।
অতএব, উপরোক্ত লেখা থেকে আপনারা ১৯৭২ সালের সংবিধানের বৈশিষ্ট্য গুলো সম্পর্কে জানতে পারলেন। এই সংবিধান রচনা ছিল স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের এক যুগান্তকারী অধ্যায়।