বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু হলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বাংলাদেশের সরকার প্রধান। ১৯৯১ সালের সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে পুনরায় সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা চালু হলে প্রধানমন্ত্রী প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব লাভ করেন। সংবিধানের ৫৫ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বা তাঁর কর্তৃত্বে এ সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রযুক্ত হবে।” সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীকে কেন্দ্র করেই শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হয়। তিনি দেশ ও জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক।
প্রধানমন্ত্রীর নিয়োগ
জাতীয় সংসদের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভকারী দলের নেতাকে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দান করেন। সংসদে কোনো দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে রাষ্ট্রপতি তাঁর বিচার- বিবেচনায় এমন একজনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ প্রদান করবেন, যিনি জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন লাভে সমর্থ হবেন। নিয়োগ লাভের পর প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতির নিকট শপথ গ্রহণ করেন।
জাতীয় সংসদের গঠন ক্ষমতা ও কার্যাবলী আলোচনা কর |
প্রধানমন্ত্রী পদের মেয়াদ
সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী দায়িত্বভার গ্রহণের তারিখ হতে পাঁচ বছরের জন্য দায়িত্ব পালন করবেন। সংবিধানের ৫৭ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর পদ নিম্নবর্ণিত কারণে শূন্য বলে ঘোষিত হবে। যদি-
১. প্রধানমন্ত্রী যদি রাষ্ট্রপতির নিকট পদত্যাগপত্র প্রদান করেন অথবা সংসদ সদস্য হিসেবে না থাকেন।
২. জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থা হারালে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করবেন।
৩. প্রধানমন্ত্রী পদের উত্তরাধিকারী দায়িত্ব গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী স্বীয় পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন।
প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও কার্যাবলি
১৯৭২ সালের মূল সংবিধান অনুযায়ী এবং সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর আলোকে সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও কার্যাবলি নিম্নরূপ-
১. প্রধানমন্ত্রী কেবিনেটের নেতা
প্রধানমন্ত্রী কেবিনেটের প্রধান। তাকে কেন্দ্র করেই কেবিনেট গঠিত হয়। কেবিনেটের উত্থান-পতন ও জীবন-মৃত্যু প্রধানমন্ত্রীর ওপর নির্ভরশীল। “He is central its (cabinet) formation, central to its life and to its death.” তিনি সমকক্ষদের মধ্যে সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান। অর্থাৎ “He is more than primus inter-pares first among equals.” প্রধানমন্ত্রী যেন একটি সূর্য। তার চারদিকে রাজনৈতিক উপগ্রহ (অন্যান্য মন্ত্রী) সমূহ আবর্তিত হয়।
২. সমগ্র শাসনব্যবস্থার মূলস্তম্ভ
প্রধানমন্ত্রী সমগ্র শাসনব্যবস্থার মূলস্তম্ভ। প্রজাতন্ত্রের সকল নির্বাহী ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির নামে প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে পরিচালিত হয়। তিনি মন্ত্রণালয়সমূহের সমন্বয়ক এবং বিভাগসমূহের মধ্যে ঐক্যের বন্ধন হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। রাষ্ট্রপতির নিয়োগসংক্রান্ত ক্ষমতায় প্রধানমন্ত্রীর মতামত প্রতিফলিত হয়। যেকোনো মন্ত্রীর বিরুদ্ধে তাঁর কাছে আপিল করা যায়। আইনসভায় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যই চূড়ান্ত।
৩. সেতুবন্ধনস্বরূপ
রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিপরিষদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী সেতুবন্ধনস্বরূপ। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি অন্য মন্ত্রীদের নিয়োগ করেন। সংবিধানের ৮৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে রাষ্ট্রীয় এবং পররাষ্ট্র বিষয়ে অবহিত করেন। সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতির বিষয়ে অবহিত করবেন এবং রাষ্ট্রপতি অনুরোধ করলে যেকোনো বিষয় মন্ত্রিসভায় বিবেচনার জন্য পেশ করবেন। রাষ্ট্রপ্রতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করবেন।
৪ . দলীয় নেতা
প্রধানমন্ত্রী তাঁর দলের প্রধান। সাধারণ নির্বাচনে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে সেই দলের প্রধানকে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। সুতরাং তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ তথা নিজ দলের নেতা। তিনি দলীয় সদস্যদের ওপর প্রভাব বিস্তার করেন এবং যেকোনো সিদ্ধান্ত ও দলের নির্দেশ কার্যকর করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। বলা হয়, “আইনগতভাবে নির্ধারিত ক্ষমতার দ্বারা নয়, বরং দলীয় কাঠামোয় তাঁর প্রভাবই নির্ধারণ করে তার ক্ষমতা।”
১৯৭২ সালের সংবিধানের বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর |
৫. জাতীয় সংসদের নেতা
প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদের নেতা। প্রকৃত অর্থে সংসদ পরিচালনার দায়িত্ব তাঁর ওপর ন্যস্ত। তিনি সংসদের কার্যসূচি এবং আইন প্রণয়নের পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সরকারের মুখপাত্র হিসেবে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে সরকারের নীতি ও সিদ্ধান্ত সম্পর্কে বিবৃতি দেন। আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে সংসদের অধিবেশন আহ্বান স্থগিত কিংবা ভেঙে দিতে পারেন।
৬. জাতীয় নিরাপত্তা ও সংহতির প্রতীক
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতীয় নিরাপত্তা ও সংহতির প্রতীক। সংকটকালীন সমগ্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তাঁর নিয়ন্ত্রণে চলে আছে।
৭. বিবিধ
এছাড়া প্রধানমন্ত্রী যে সকল ভূমিকা পালন করেন তা হলো আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদন, আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান, দেশের জরুরি অবস্থায় প্রয়োজনীয় নির্দেশ জারি ইত্যাদি।
সংসদীয় শাসন পদ্ধতিতে প্রধানমন্ত্রী প্রভৃত ক্ষমতা ও পদমর্যাদার অধিকারী। তিনি প্রশাসনযন্ত্রের মূলস্তম্ভ। তিনি দেশের অভ্যন্তরে জাতীয় নেতা আর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাষ্ট্রের মুখপাত্র। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধান এবং দ্বাদশ সংশোধনীর ফলে প্রবর্তিত সংসদীয় ব্যবস্থায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও পদমর্যাদাকে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর সাথে তুলনা করা হয়।