সাধারণ অর্থে মুনাফা অর্জনের উদ্দেশে পণ্যদ্রব্য ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত কাজকে ব্যবসায় বলা হয়। অর্থাৎ স্বল্প মূল্যে পণ্যদ্রব্য ক্রয় করে অপেক্ষাকৃত বেশি মূল্যে বিক্রয় করার কার্যই ব্যবসায়। কিন্তু ব্যাপক অর্থে পণ্যদ্রব্য ও সেবাসামগ্রী উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তার হাতে পৌছানো পর্যন্ত সকল কার্যাবলিই ব্যবসায়ের অন্তর্ভুক্ত।
পণ্য উত্তোলন, উৎপাদন, বণ্টন, পরিবহন, গুদামজাতকরণ, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সেবা প্রদান ইত্যাদি সবই মানুষ অর্থোপার্জনের জন্য করে থাকে। এ কার্যাবলিই ব্যবসায়ের সহায়ক শক্তি। অতএব, ব্যবসায় হচ্ছে বৈধভাবে অর্থোপার্জনের উদ্দেশে নিম্নোক্ত কার্যাবলি:
১. পণ্যদ্রব্য ও সেবাকর্ম উৎপাদন।
২. উৎপাদিত পণ্যদ্রব্যের বণ্টন।
৩. উৎপাদন ও বণ্টনে সহায়ক কার্য ও
৪. প্রত্যক্ষ সেবাকর্ম।
ব্যবসায়ের সংজ্ঞা
নিচে কয়েকজন প্রথিতযশা ব্যক্তির দেয়া ব্যবসায়ের সংজ্ঞা উল্লেখ করা হলো:
১. Roger W. Babson (রজার ডাব্লিউ ব্যাবসন): পণ্যসামগ্রী, সেবা এবং মতাদর্শের উৎপাদন ও বণ্টন সংক্রান্ত যে সকল মানবীয় কার্যাবলি মুনাফা অর্জনের উদ্দেশে পরিচালিত হয় এদের সবগুলোই ব্যবসায়ের অন্তর্ভুক্ত।
২. R. E. Gloss and H. A. Baker (গ্লস ও বেকার): দেশের প্রয়োজন মোতাবেক পণ্য ও সেবা উৎপাদন ও বিক্রয়ের নিমিত্তে পরিচালিত মানুষের একক বা সম্মিলিত প্রচেষ্টাই মূলত ব্যবসায়।
৩. Bayar O. Wheeler (বেয়ার ও হ্রইলার): মুনাফা লাভের অনুপ্রেরণায় সমাজে পণ্যসামগ্রী ও সেবা সরবরাহ করার জন্য সংঘটিত ও পরিচালিত প্রতিষ্ঠানই ব্যবসায়।
8. Prof. M. C. Shukla-এর মতে, “মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে সম্পদ উৎপাদন, ক্রয় ও বণ্টনের সাথে জড়িত মানুষের যাবতীয় কার্যাবলিকে ব্যবসায় বলে।”
৫. Prof. L. H. Haney-এর মতে, “পণ্যদ্রব্য ও সেবাকার্য ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে উৎপাদন অথবা অর্জনের জন্য মানুষের যাবতীয় কার্যাবলিকে ব্যবসায় বলে।”
সুতরাং, মুনাফা অর্জনের উদ্দেশে প্রকৃতিপ্রদত্ত সম্পদের আহরণ, রূপান্তরকরণ ও বাজারজাতকরণের পর ভবিষ্যৎ প্রয়োজনের নিমিত্তে এদের পরিবর্তন, গুদামজাতকরণ, ক্রয়-বিক্রয় ইত্যাদির মাধ্যমে ভোক্তার কাছে পণ্য ও সেবাকর্ম পৌঁছে দেবার যাবতীয় কার্যাবলিকে ব্যবসায় বলে।
ব্যবসায়ের বৈশিষ্ট্য গুলো কি কি? – আলোচনা কর |
ব্যবসায়ের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
ব্যবসায়ের উৎপত্তির ইতিহাস শুরু হয় সেই সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই। সৃষ্টির প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষ প্রকৃতির উপর নির্ভর করে জীবনধারণ করত। পৃথিবীতে তখন মানুষের সংখ্যা ছিল কম এবং প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে প্রাপ্ত ফলমূলই তাদের ক্ষুন্নি বৃত্তির জন্য যথেষ্ট ছিল। মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের প্রয়োজনেও বৈচিত্র্য আসতে শুরু করে। নিজেদের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী ছাড়া অন্যান্য পণ্যসামগ্রীর অভাব দেখা দিতে শুরু করল। অভাব পূরণের স্বার্থেই প্রয়োজন দেখা দিল পণ্য বিনিময়ের।
দিন গড়িয়ে যায়, মানুষের রুচির পরিবর্তন আসে। মুদ্রা ব্যবস্থার প্রচলন হয়। শিল্পক্ষেত্রেও দেখা দেয় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
ব্যবসায়ের ক্ষেত্রেও ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটে। ব্যবসায় ধীরে ধীরে আধুনিক রূপ পরিগ্রহ করে। ব্যবসায়ের এ ক্রমোন্নয়নকে নিম্নোক্ত তিনটি যুগে বিভক্ত করা হয় এবং পুরো বিবর্তনকে কয়েকটি করে বিভাজন করে আলোচনা করা যায়।
১. প্রাচীন যুগ (Ancient period)
(ক) আদিম স্তর (Primitive stage): প্রাচীন যুগে মানুষ প্রকৃতিনির্ভর জীবনযাপন করত। প্রকৃতিপ্রদত্ত ফলমূল খেয়ে এবং শিকার কার্য করে তারা জীবনধারণ করত। অধিকাংশ মানুষ ছিল যাযাবর জীবন ব্যবস্থায় অভ্যন্ত। কেউ কেউ সমাজবদ্ধভাবে বাস করলেও ব্যবসায়ের প্রচলন তখন ছিল না।
(খ) বিনিময় স্তর (Exchange stage): ব্যবসায়ের শুরু মূলত এ তবেই। যাবাবর ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে মানুষ পরিবারকেন্দ্রিক উৎপাদন শুরু করে। শুরু করে পণ্য বিনিময়া কার্য। এভাবেই Barter system বা পণ্য বিনিময় ব্যবস্থার ব্যাপক প্রচলন ঘটে। তবে এ ব্যবস্থা স্থায়ী আসন গাড়তে সক্ষম হয়নি।
২. মধ্যযুগ (Middle age)
(ক) মুদ্রার ব্যবহার (Lise of coin): Barter system বা পণ্য বিনিময় ব্যবস্থা অকার্যকর হধার ফলে মানুষ বিনিময়ের বিকল্প পন্থা বের করতে সচেষ্ট হয়। প্রথম দিকে মানুষ মূল্যবান শামুক, ঝিনুক, পাথর, কড়ি এসবকেই বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। পরবর্তীতে শুরু হয় ধাতব মুদ্রা। যেমন- তামা, ব্রোঞ্জ, সোনা, রূপা ইত্যাদির ব্যবহার। দ্রব্য বিনিময়ের সমস্যা দূরীকরণের জন্য কালক্রমে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে শুরু হয় মুদ্রার প্রচলন। শাসক শ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতায় এ ব্যবস্থার প্রচলন হয়। ফলে ব্যবসায় কার্য ছাড়াও শ্রমিকদের মজুরি প্রদান, খাজনা ও কর আদায় এতে সহজতর হয়।
(খ) বাজার ব্যবস্থার উদ্ভব (Growth of market system): মুদ্রা ব্যবস্থার প্রসারের ফলে ব্যবসায় আরও বিস্তৃতি লাভ করে। বিনিময়ের জন্য তখন প্রয়োজন হয় হাট-বাজারের। বাজার হচ্ছে এমন একটি কেন্দ্র যেখানে ক্রেতা ও বিক্রেতা সমবেত হয়ে তাদের উৎপাদিত ও প্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রয় ও ক্রয়ের সুযোগ পায়। বাজার সম্প্রসারণের ফলে গড়ে ওঠে বড় বড় ব্যবসায় কেন্দ্র ও শহর বন্দর। পণ্য পরিবহনের জন্য সস্থল ও নৌপথের অধিক ব্যবহার শুরু হয়। ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তার স্বার্থে সৃষ্টি হয় Merchant Guild (বণিক সমবায় সংঘ), Craft Guild (কারিগরি সমবায় সংঘ) ইত্যাদি ব্যবসায়ী জোটের।
(গ) উপনিবেশিক স্তর (Colonial stage): মধ্যযুগে পৃথিবীর বিভিন্ন জনপদে ব্যবসায়ের বিস্তৃতি ঘটলেও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে এর ব্যাপক সমৃদ্ধি ঘটে। ব্যবসায়ীগণ তাদের পণ্যের অধিক প্রসারের জন্য নতুন নতুন বাজার খুঁজতে থাকে। কলম্বাসের আমেরিকা ‘আবিষ্কার ও ভাস্কো-ডি-গামার ভারত মহাদেশ আবিষ্কার নৌপথে ব্যবসায়ের সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ সময়ে ইউরোপের অনেক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উপনিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে প্রভুত্ব স্থাপনে সচেষ্ট হয়। ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, আমেরিকায় হাডসন কোম্পানি, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে নেভাল্ড কোম্পানি এ ধরনের উপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা কায়েমের মাধ্যমে তাদের ব্যবসা বাণিজ্য আন্তর্জাতিক অজ্ঞানে বিস্তার ঘটায়।
৩. আধুনিক যুগ (Modern period)
(ক) শিল্প বিপ্লব (Industrial revolution): ১৭৫০ সাল থেকে ১৮৫০ সাল পর্যন্ত ছিল শিল্প বিপ্লবকাল- যা ব্যবসায়ের সম্প্রসারণ ও উন্নয়নে বিশাল পরিবর্তন সাধন করে। এ সময়ের কতিপয় যুগান্তকারী আবিষ্কার। যেমন- জেমস ওয়াটের বাষ্পীয় ইঞ্জিন, হারগ্রিভসের স্পিনিং, জেলি কে (Kay) এর পাওয়ার লুম, আর্করাইটের স্পিনিং ফ্রেম ইত্যাদি শিল্পের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে অকয়ানীয় ভূমিকা রাখে। শিল্প বিপ্লবের ফলে ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যবসায়ের ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়। গড়ে উঠে নতুন নতুন শিল্প কারখানা। যান্ত্রিক শক্তির বলে উৎপাদন বেড়ে যায় বহুগুণে। ব্যবসায়ের পারিবারিক উৎপাদন ব্যবস্থা কারখানায় স্থানান্তরিত হয়। বিকাশ ঘটে গুদামজাতকরণ, ব্যাংকিং, বিমা, বিজ্ঞাপনী সংস্থা ইত্যাদি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের। ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড বিস্তার লাভ করে এক দেশ থেকে অন্য দেশে।
(খ) প্রযুক্তি ও তথ্য ব্যবস্থা সস্তর (Stuge of technology and information system): শিল্পবিপ্লব পরবর্তী স্তরে শিল্প ক্ষেত্রে গবেষণা ও উন্নয়ন (R&D) এর ফলে ব্যবসায় বাণিজ্যের গুণগত মান বৃদ্ধি পায়; উৎপানিত হয় নতুন নতুন পণ্য। প্রযুক্তির আধুনিকায়নের ফলে ব্যবসায়ের পরিধি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ব্যাপ্তি লাভ করে। প্রযুক্তির ছোঁয়া ক্ষুদ্রায়তন ব্যবসায়ের পাশাপাশি বৃহদায়তনের যৌথ মূলধনী ব্যবসায় সৃষ্টিতে সহায়ক হয়। সাম্প্রতিককালে কম্পিউটারভিত্তিক তথ্য ব্যবস্থা আধুনিক যুগের ব্যবসায় বাণিজ্যে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। বর্তমানে ইন্টারনেটের মাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যে বিশ্বের সর্বত্র ব্যবসায়িক যোগাযোগ সাধিত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, আজ কম্পিউটারভিত্তিক তথ্য ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত ক্রয়- বিক্রয় কার্যও সম্পাদিত হচ্ছে।
সুতরাং বলা যায়, হঠাৎ ব্যবসায় কার্যের উৎপত্তি হয়নি। সামাজিক ক্রমবিকাশ ও সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সামঞ্জস্যবিধান করে ব্যবসায় তার আপন স্থান দখল করে নেয়।