ব্যবসায়ের উদ্দেশ্য
ব্যবসায় সংগঠন প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার পেছনে মানুষের কতিপয় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উদ্দেশ্য জড়িত থাকে। তবে ব্যবসায়ের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মুনাফা অর্জন। এটি ব্যবসায়ের প্রধানতম প্রত্যক্ষ উদ্দেশ্য হলেও বর্তমান প্রতিযোগিতাপূর্ণ ব্যবসায় জগতে শুধু মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যকে ঘিরে ব্যবসায় পরিচালিত হতে পারে না। একজন ব্যবসায়ীকে মুনাফা অর্জনের পাশাপাশি ক্রেতা, সমাজ ও সরকারের দিকটিও বিবেচনায় রাখতে হয়। ফলে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য হয়ে পড়ে বহুমুখী। নিচে ব্যবসায়ের উদ্দেশ্য সমূহ আলোচনা করা হলো:
১. মুনাফা অর্জন (Making profit)
ব্যবসায়ী তার মূলধন বিনিয়োগ করে নিজ শ্রম ও মেধা দিয়ে ব্যবসায় গঠন ও পরিচালনা করেন শুধু অধিক অর্থ লাভের আশায়। মুনাফাই ব্যবসায়ীর প্রধানতম লক্ষ্য। মুনাফা অর্জন ব্যতীত কোনো ব্যবসায় পরিচালিত হতে পারে না।
ব্যবসায়ের কার্যাবলী আলোচনা কর |
২. মূলধন বিনিয়োগ (Investment of capital)
ব্যবসায়ী প্রথমত, নিজের সঞ্চিত মূলধন ছাড়াও সারাদেশে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় ব্যাংকিং ব্যবসায়ের মাধ্যমে একত্রিত করে মূলধন গঠন করে। এতে ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারী হতে শুরু করে পণ্য বা সেবার ভোক্তা পর্যন্ত উপকৃত হয়ে থাকেন।
৩. সম্পদের সুষম ব্যবহার (Proper utilization of wealth)
মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর জন্য প্রতিটি মানুষকেই অপরের উৎপাদন বা সেবার ওপর নির্ভর করতে হয়। এক্ষেত্রে উৎপাদনকারীর পণ্য প্রকৃত ব্যবহারকারীর হাতে পৌঁছে দিয়ে ব্যবসায় দেশের সম্পদের সুষম ব্যবহার নিশ্চিত করে।
৪. নতুন উদ্ভাবন (Janovation)
মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে একজন ব্যবসায়ী জনগণের চাহিদা অনুযায়ী নতুন নতুন পণ্য উচ্চাবনের ব্যবস্থা করেন। ফলে এটি সমাজের প্রয়োজনের তালিকায় একটি বিশেষ সংযোজন হিসেবে বিবেচিত হয়।
৫. জনগণের আয় বৃদ্ধি (Increase of income of the people)
ব্যবসায় একদিকে যেমন এর মালিক এবং কর্মরত শ্রমিক কর্মচারীদের আয় বৃদ্ধিতে সহায়তা করে, অন্যদিকে ন্যায্যমূল্যে পণ্যসামগ্রী কিনতে পারায় দেশের জনগণের অর্থ বেঁচে যাবার কারণে তাদেরও আয় বৃদ্ধি পায়। ফলে জনগণের জীবনযাত্রার মানেরও উন্নয়ন ঘটে।
৬. সমাজের চাহিদা পুরণ (Fulfilment of social demand)
সমাজের চাহিদা অনুযায়ী ব্যবসায়ী নিজে পণ্যদ্রব্য উৎপাদন, সংরক্ষণ ও পরিবহন করে এবং ক্রেতার সন্নিকটে সরবরাহের নিশ্চয়তাসহ মজুত রাখে। এটি সমাজবদ্ধ মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাবার নিশ্চয়তাও দেয়।
৭. পণ্যের যথাযথ বণ্টন (Proper distribution of product)
পণ্যসামগ্রী কোনো একটি বিশেষ স্থানে উৎপাদিত হলেও তা সমগ্র দেশের জনগণ ভোগ করে থাকে। এক্ষেত্রে ব্যবসায় প্রতিটি এলাকার প্রয়োজন অনুসারে পণ্যসামগ্রী উৎপাদনস্থল থেকে বণ্টন করে এবং সকলের চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তা প্রদান করে।
৮. কর্মসংস্থান (Employment)
ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান স্থাপনের মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা নিজেদের এবং সমাজবন্ধ অন্যান্য বেকার লোকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে থাকে। এতে দেশের বেকার ও অদক্ষ লোকজন সুদক্ষ হয়ে ওঠে এবং দেশের জন্য তারা উৎপাদন কাজে অংশ নিতে পারে।
৬. সমাজকল্যাণে অংশগ্রহণ (Participation in social welfare)
সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশ সাধনে, ধর্মীয়, জনহিতকর বা সামাজিক অন্যান্য আচার অনুষ্ঠানে প্রত্যক্ষ সাহায্য দানের মাধ্যমে ব্যবসায় সমাজকল্যাণে অংশ নিয়ে থাকে।
১০. সমাজবিরোধী কাজ না করা (Refraining from anti-social work)
হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার নিমিত্তে কালোবাজারি, চোরাকারবারি, মজুতদারি হতে বিরত থাকা ব্যবসায়ের মৌলিক দীক্ষা।
১১. শ্রমিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্ক উন্নয়ন (Development of labour management relationship)
প্রতিষ্ঠানে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ব্যবসায়ীরা শ্রমিক কর্মীদের কল্যাণার্থে নানাবিধ কার্যক্রম গ্রহণ করেন। যেমন- বাসস্থানের ব্যবস্থা করা, তাদের সন্তানদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য রক্ষার কার্যক্রম গ্রহণ ইত্যাদি। এতে শ্রমিক কর্মীরা অনুপ্রেরণা পায়। ফলে শ্রমিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটে।
১২. ক্রেতাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন (Relation with customers)
ব্যবসায়ের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে ক্রেতাদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে মুনাফা অর্জন করা। ব্যবসায়ীরা ক্রেতাদের চাহিদা ও রুচি অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ করে তাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন ও উন্নয়ন করেন।
১৩. জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন (Development of national economy)
জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা অনুসারে উৎপাদন, বণ্টন, পরিবহন ইত্যাদি কার্য পরিচালনা করে ব্যবসায় পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ও জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে সাহায্য করে।
ব্যবসায়ের বৈশিষ্ট্য গুলো কি কি? – আলোচনা কর |
১৪. জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধি (Increase of national resources)
ব্যবসায়ী ভোক্তাদের চাহিদা মেটাতে উৎপাদন কার্য পরিচালনা করে থাকেন। এর ফলে জাতীয় সম্পদ বেড়ে যায় এবং দেশ উন্নতির দিকে ধাবিত হয়।
১৫. জাতীয় সম্পদের ব্যবহার (Use of national resources)
দেশের সর্বপ্রকার প্রাকৃতিক সম্পদাদি আহরণ এবং ব্যবসায় কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে ঐ সম্পদের সুষম ব্যবহার নিশ্চিত করা ব্যবসায়ের উদ্দেশ্য। অনুরূপ সম্পদের ব্যবহার দেশের অথনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করে।
সুতরাং কেবল মুনাফা অর্জনই ব্যবসায়ের উদ্দেশ্য নয়, সমাজের মানুষের বিভিন্নমুখী চাহিদা পূরণের মধ্যেই ব্যবসায়ের অস্তিত্ব নির্ভরশীল। অর্থ উপার্জনের সাথে সাথে সামাজিক ও জাতীয় কল্যাণ সাধনের মধ্যে ব্যবসায়ের প্রকৃত উদ্দেশ্য নিহিত। এ লক্ষে আধুনিক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো কাঙ্ক্ষিত সাফল্য লাভের জন্য উপরিউক্ত কার্যাবলি সম্পাদন করে থাকে।