প্রত্যেকেরই প্রিয় লেখক আছেন। আমিও তার ব্যতিক্রম নয়। আজ তাই আমার প্রিয় লেখক সম্পর্কে লিখছি। তিনি কেন আমার প্রিয় লেখক তা লেখাটিতে তুলে ধরেছি।
রচনা: আমার প্রিয় লেখক
যাহার অমর স্থান প্রেমের আসনে
ক্ষতি তার ক্ষতি নয় মৃত্যুর শাসনে।
দেশের মাটির থেকে নিল যারে হরি,
দেশের হৃদয় তারে রাখিয়াছে ধরি।
————–রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ভূমিকা
প্রিয় লেখক? কে আমার প্রিয় লেখক ? এক লহমায় এই প্রশ্নের উত্তরে যে নামটি জ্বলজ্বল করে ওঠে তিনি হলেন শরৎচন্দ্র। হ্যাঁ, সেই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ই আমার প্রিয় লেখক, যাঁর লেখনী স্পর্শে বাংলা কথাশিল্প অর্থাৎ, উপন্যাস ও ছোটগল্প জনপ্রিয়তার শীর্ষে আরোহণ করেছে। তিনি বাংলার একান্ত দরদি কথাশিল্পী, বাঙালির বেদনার বিশ্বস্ত রূপকার। তাঁর লেখনীতেই বাংলার ব্যথিত মানুষের বানীহারা বেদনা পেয়েছিল প্রকৃত প্রকাশের ভাষা। তাঁর হাতেই বাংলার নিরুদ্ধ অশ্রুর উৎসমুখ গিয়েছিল খুলে। বাংলার সাহিত্য গগনে যখন বঙ্কিম প্রতিভা অস্তমিত এবং রবীন্দ্রনাথ পূর্ণ দীপ্তিতে ভাস্বর, তখনই শরৎকালের পূর্ণচন্দ্রের স্নিগ্ধ জ্যোতি নিয়ে শরৎচন্দ্রের বিস্ময়কর আবির্ভাব। সাহিত্যের দরবারে তিনি শোনালেন সমাজের চিরবঞ্চিত, চির অবহেলিতদের জীবন কাহিনী, মর্মস্পর্শী ভাষায় রচনা করলেন তাদের বেদনাময় অশ্রুনির্বেদ।
আরও পড়ুন:
বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প রচনা ২০ পয়েন্ট এসএসসি ও এইচএসসি
বাংলাদেশের কৃষক রচনা [ Class 5, 6, 7, 8, 9, 10 ]
শিশু শ্রম রচনা (৬৫০ শব্দ) – ১০০% কমন সকল ক্লাস
শরৎচন্দ্র অপ্রতিদ্বন্দী কথাশিল্পী। বাংলার মাটি ও মানুষকে তিনি দেখেছেন সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে। তাঁর সৃষ্টির মধ্যে তাই সাধারণ মানুষ অসাধারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। তিনিই সার্থকভাবে দেখিয়েছেন সাধারণ মানুষের মধ্যে রয়েছে কী অপার মনুষ্যত্বের মহিমা; অনুভব করেছেন বাঙালির সীমিত জীবনের অন্তরালেও চলেছে কত বিচিত্ররূপের লীলাভিসার। এ অনুভবই তাঁর রচনায় পরিস্ফুট। তাই শরৎচন্দ্র আমার প্রিয় লেখক ।
জীবন ও অনুশীলন
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৭৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত ব্রাহ্মণ পরিবরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মতিলাল চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সংসার নিস্পৃহ একজন সরল মানুষ। তিনি সংস্কারমুক্ত এক সাহিত্যিক মনের অধিকারী ছিলেন। শরৎচন্দ্রের সাহিত্যিক মানসিকতার ওপর পিতার প্রভাব নিঃসন্দেহে গভীর। মাতা ভুবনমোহিনী ছিলেন অতি সহিষ্ণু ও সহৃদয়া রমণী। শরৎচন্দ্রের দরদি চরিত্রভাবনা মাতার সহৃদয়তার দ্বারা অনেকটাই প্রভাবিত হয়েছে। ছেলেবেলা থেকেই অসহনীয় দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করে শরৎচন্দ্রকে বড় হতে হয়েছে। ভাগলপুরে মামার বাড়িতে তাঁর কৈশোর ও যৌবনে খানিক অংশ কেটেছে। তাঁর বহু রচনাতেই ভাগলপুরের মানুষ, অরণ্য প্রকৃতি, নদী প্রান্তর গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিয়েছে। মাতুলালয় ভাগলপুরে থাকাকালে শরৎচন্দ্র এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কিন্তু অর্থাভাবে তাঁর উচ্চশিক্ষার পথ একেবারে রুদ্ধ হয়ে যায়। সংসারে বীতশ্রদ্ধ হয়ে শরৎচন্দ্র কিছুকাল নিরুদ্দেশ হন। সেই কয়েক বছর তিনি সন্ন্যাসীদের দলে মিশে দেশের বিভিন্ন স্থান পদব্রজে ভ্রমণ করেন এবং বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন, যা পরবর্তীকালে তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির সহায়ক হয়েছে।
পিতৃবিয়োগের পর শরৎচন্দ্র জীবিকা অর্জনের জন্যে স্বদেশ ত্যাগ করে সুদূর রেঙ্গুনে যাত্রা করেন। সেখানে তিনি ছিলেন প্রায় চৌদ্দ বছর এবং এই প্রবাসে থাকাকালীন সময়ে শরৎচন্দ্র কথাশিল্পী হিসেবে সুপরিচিত হন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞান বিষয়ে তাঁর গভীর অধ্যয়ন ও অনুশীলনে তা আরও পরিশীলিত ও পরিণত হয়ে ওঠে। শরৎচন্দ্রই প্রথম বাঙালি লেখক, যিনি লেখাকেই একমাত্র জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করেন।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর জনপ্রিয়তা অক্ষুণ্ণ ছিল। ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি ৬২ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।
শিল্পসৃষ্টি ও সাহিত্যকৃতি
শরৎচন্দ্রের শিল্পসৃষ্টির মূল উৎস সহমর্মিতা ও একাত্মবোধ, যা তাঁকে সহায়তা করেছে সমাজের নিম্নশ্রেণির মানুষদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশতে, তাদের দুঃখক্লান্ত জীবনের সান্নিধ্যে এসে বিচিত্র অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হতে। মানুষের গড়া সমাজ ও সমাজের গড়া মানুষ সম্পর্কে সুগভীর অভিজ্ঞতা সেকালের বাংলাদেশের কোনো কথাশিল্পীরই ছিল না। প্রগাঢ় বাস্তবধর্মিতা, সুগভীর জীবনবোধ এবং অভিজ্ঞতাই কথাসাহিত্যের মৌলিক উপাদান। ইতঃপূর্বে বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু তাতে সাধারণ জীবনের উষ্ণ বাস্তবতার পরিচয় নেই। ইতিহাসের সুদূরলোকে, রোমাঞ্চ মধুর জগতের বঙ্কিম উপন্যাসের পটভূমি নির্মিত। রবীন্দ্র উপন্যাসে জীবনের রূপ রং আছে সত্য, কিন্তু জীবন বাস্তবতার সুপরিচিত পরিবেশ নেই। উপন্যাস যে মুখ্যত সমাজবদ্ধ বাস্তব জীবনেরই প্রতিচ্ছায়া, শরৎচন্দ্রের রচনাতেই তা প্রথম সার্থকভাবে প্রমাণিত। শরৎচন্দ্র নিজেই লিখেছেন- “আমার উপন্যাসের অধিকাংশ চরিত্র ও ঘটনা আমার স্বচক্ষে দেখা।”
শরৎচন্দ্রের সাহিত্যকৃতিতে ছোটগল্পের সংখ্যা অনেক কম, উপন্যাসই বেশি। ‘মহেশ’ শরৎচন্দ্রের এক অনবদ্য ছোটগল্প। সংস্কারাচ্ছন্ন সময়ের নিষ্ঠুরতার দিকটি তিনি এ গল্পে সুন্দরভাবে অনাবৃত করেছেন। আর একটি গল্প ‘রামের সুমতি’ও তাঁর শক্তিশালী রচনা। এ গল্পের কিশোর চরিত্র সম্পর্কে শরৎচন্দ্র এক আশ্চর্য মনের পরিচয় দিয়েছেন। কিশোর রাম তাঁর এক অপূর্ব চরিত্র সৃষ্টি। শরগুন্দ্রের উপন্যাসগুলো মূলত বাঙালির পারিবারিক জীবনকে আশ্রয় করেই রচিত। ‘বড়দিদি’, ‘বিরাজবৌ’, ‘পরিণীতা’, ‘বামুনের মেয়ে’, ‘অরক্ষণীয়া’ প্রভৃতি উপন্যাসের মধ্যে পারিবারিক জীবনের নানা বৈচিত্র্য লক্ষণীয়।
পরিবারকেন্দ্রিক জীবনে নারীকে এক অসামান্য ভূমিকায় শরৎচন্দ্র দেখিয়েছেন। যৌথ পারিবারিক জীবনে নরনারীর প্রেমের সঙ্গে সঙ্গে স্নেহপ্রীতি, বাৎসল্য, ঈর্ষা-স্বার্থপরতা এসব বৃত্তির পরিচয় এমনভাবে দেখানো হয়েছে যে, তা একান্তভাবে বাঙালির ঘরের সামগ্রী হয়ে উঠেছে। ‘চরিত্রহীন’, ‘শ্রীকান্ত’, ‘গৃহদাহ’ প্রভৃতি উপন্যাসে শরৎচন্দ্র যৌথ পারিবারিক ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তাঁর মনন, চিন্তন ও ভাবনাকে আরও বিস্তৃততর ক্ষেত্রে উপস্থাপিত করেছেন। নারীর সাময়িক ভ্রান্তি, আবিলতা যে নারীত্বের শাশ্বত মহিমাকে আচ্ছন্ন করতে পারে না, এই বিশ্বাসই শরৎচন্দ্র তাঁর উপন্যাসে প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন ও সফলও হয়েছেন। বাংলা উপন্যাসের ক্ষেত্রে এ নতুন ভাবনার পথ উন্মোচনের বিশেষ কৃতিত্ব শরৎচন্দ্রের। তিনি যে চিরন্তন নারীসত্তার অপরূপ রূপকার এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। নারীজীবন সম্পর্কে গভীর সংবেদনশীল ভাবনা ছিল শরৎচন্দ্রের।
সমাজের দরিদ্র, শোষিত মানুষের সঙ্গে নির্যাতিতা নারীহৃদয়ের অকথিত বাণীকেও শরৎচন্দ্রই বাংলা সাহিত্যে প্রথম রূপ দিতে প্রয়াসী হয়েছেন।
শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে নারী চরিত্র
শরৎচন্দ্র তাঁর উপন্যাসে নারী চরিত্রগুলোকে নির্মাণ করেছেন ব্যক্তি ও সমাজের ভেতরের মহল থেকে। তথাকথিত বাঙালি সতী-সাধ্বী এবং করুণাসিক্ত নারীর প্রতিচ্ছবিই তিনি অঙ্কন করেন নি বরং নারী চরিত্রে দিয়েছেন দৃঢ়তা। তাই জীবন চলার পথে যুক্তি আর বিশ্বাসে তারা অটল। কখনো কখনো রহস্যময়ী। উদাহরণস্বরূপ ‘গৃহদাহ’ উপন্যাসের অচলা, ‘দেনাপাওনা’ উপন্যাসের ষোড়শী, ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের রাজলক্ষ্মী, দেবদাসের, পার্বতী ইত্যাদি চরিত্র উল্লেখ করা যায়। শরৎচন্দ্র দেখিয়েছেন, নারী-পুরুষের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
বাংলার সমাজচিত্র ও শরৎচন্দ্র
বাংলার সনাতন রক্ষণশীল সমাজে নারীর স্থান ছিল অত্যন্ত সংকীর্ণ। তার ওপর কৌলিন্য প্রথ্য সমাজে সৃষ্টি করেছিল এক দুরপনেয় ক্ষত। রাজা রামমোহন রায়ের সতীদাহ নিবারণ এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ প্রবর্তন বাংলাদেশে নারী বিগ্রহের কিছুটা উপশম ঘটালেও লোকচক্ষুর অন্তরালে নিয়ত রচিত হচ্ছিল নারীসমাজের পচন ও অবক্ষয়ের নিত্যনতুন করুণ কাহিনী; অন্যদিকে, কৃত্রিম জাতিভেদকে হাতিয়ার করে ব্রাহ্মণ- সমাজ সমাজের নিম্নশ্রেণির মানুষগুলোর ওপর শুরু করেছিল হৃদয়হীন লাঞ্ছনা ও মানবতার দুঃসহ অপমান। তার ওপর লর্ড কর্নওয়ালিশ প্রবর্তিত জমিদারি প্রথায় ক্ষমতাবান দাম্ভিক জমিদারশ্রেণি ব্রাহ্মণ সমাজের ভণ্ডামির প্রশ্রয়ে সফীতকায় হয়ে অকথ্য অত্যাচারে তাদের জীবনকে করে তুলেছিল দুর্বিষহ। বাংলার সমাজে সেদিন প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কেঁদে ফিরছিল। শরৎচন্দ্র বাংলার সেই ব্যথাদীর্ণ বেদনার ওপর বুলিয়ে দিলেন সমবেদনার স্নিগ্ধ শীতল করস্পর্শ। ন্যায়বিচারের আশায় সেই নিপীড়িত, বঞ্চিত, হতভাগ্যদের করুণ কাহিনীর অন্তরালে আর্জি পেশ করলেন মানবতার বিচারশালায়।
ভাষা ও শিল্পরীতি
শরৎচন্দ্রের রচনার প্রধান আকর্ষণ তাঁর ঋজু ভাষা ও শিল্পরীতি। সাধারণ মানুষের মনের কথা মুখের ভাষাকে তিনি উপজীব্য করেছেন তাঁর রচনায়। তিনি সাধুভাষা ও চলিত ভাষার সমন্বয় সাধন করেছেন। সাধুভাষার ঐশ্বর্য ও ঋদ্ধি এবং চলিত ভাষার সৌকর্য ও সিদ্ধি এ উভয়ের সামঞ্জস্য বিধানের প্রয়াস তাঁর রচনায় সর্বত্র লক্ষ করা যায়। এ রচনাগত বৈশিষ্ট্যই তাঁর সাহিত্যের প্রধান সৌন্দর্য এবং তাঁর সাহিত্যিক বাক্তিত্ব বা স্টাইলের ভিত্তি।
শরৎচন্দ্রের ভাষা সংযত ও শান্ত। ভাষার আতিশয্য বা উচ্ছ্বাসের তিনি ছিলেন বিরোধী। শব্দপ্রয়োগে তিনি অতি সতর্ক ছিলেন। ভাষার সংক্ষিপ্ততা ও সংযম তাঁর রচনাকে শিল্পসমৃদ্ধ এবং অনবদ্য করে তুলেছে।
জনপ্রিয় কথাশিল্পী
উপন্যাস সাহিত্যের একটি জনপ্রিয় শাখা। আর বাংলা উপন্যাসের সর্বাধিক জনপ্রিয় লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর উপন্যাসের কাহিনী, চরিত্র, ভাষাভঙ্গি পাঠকসমাজকে খুব সহজেই কাছে টানে। কারণ তাঁর উপন্যাসে রয়েছে ব্যক্তিমন ও সমাজের বিশ্বস্ত রূপায়ণ। সকল শ্রেণির পাঠকই তাঁর উপন্যাসের রসাস্বাদনে সক্ষম। উপন্যাসের চরিত্রের মধ্যে তিনি যেন পাঠকের মনের অভিব্যক্তিই প্রকাশ করেছেন। বস্তুত তাঁর উপন্যাসের এসব গুণই তাঁকে পাঠকমহলে অধিক জনপ্রিয় করেছে।
উপসংহার
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আমার প্রিয় লেখক। দরদি কথাশিল্পী। ‘সরদি’ তাঁর যথার্থ বিশেষণ, সর্বশ্রেষ্ঠ উপাধি। তিনি সমাজের সর্বস্তরের মানুষের হৃদয় জয় করেছেন। বাঙালি জাতি তাঁর কাছে নানাভাবে ঋণী। কেবল বাঙালি জাতিই নয়, সমগ্র ভারতবর্ষ এবং বাংলাদেশ শরৎচন্দ্রের কাছে অপরিশোধ্য ঋণে আবদ্ধ। রবীন্দ্রনাথের কথায় বলা যায়, ‘দেশের হৃদয় তারে রাখিয়াছে ধরি’।