১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে দেশে সংসদীয় ব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ায় প্রকৃত শাসন ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীসমেত মন্ত্রিসভার হাতে ন্যস্ত হয়। রাষ্ট্রপতি নামমাত্র শাসক প্রধানের ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি প্রকৃত শাসক প্রধানে পরিণত হন। প্রজাতন্ত্রের সকল নির্বাহী ক্ষমতার মালিক রাষ্ট্রপতি। ১৯৯১ সালে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে সংসদীয় ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তিত হওয়ায় রাষ্ট্রপতি পুনরায় নামসর্বস্ব প্রধানে পরিণত হন। প্রজাতন্ত্রের সকল নির্বাহী ক্ষমতা তাঁর নামে মন্ত্রিপরিষদ কর্তৃক পরিচালিত হয়। আজকের লেখায় আমরা বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও কার্যাবলী সম্পর্কে জানবো। সেই সাথে জানবো রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রক্রিয়া, রাষ্ট্রপতি পদের যোগ্যতা, রাষ্ট্রপতির পদমর্যাদা ও রাষ্ট্রপতির অপসারণ সম্পর্কে।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রক্রিয়া
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান রাষ্ট্রপতি নামে অভিহিত। তিনি শাসনতান্ত্রিক প্রধান নন। তিনি জাতীয় সংসদের সদস্যদের ভোটে পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। বাংলাদেশ সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে, বাংলাদেশে একজন রাষ্ট্রপতি থাকবেন, যিনি আইন অনুযায়ী সংসদ সদস্যগণ কর্তৃক নির্বাচিত হবেন। প্রজাতন্ত্রের সকল নির্বাহী ক্ষমতা তাঁর নামে মন্ত্রিপরিষদ কর্তৃক পরিচালিত হয়।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও কার্যাবলী আলোচনা করো |
রাষ্ট্রপতি পদের যোগ্যতা
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার জন্য কোনো ব্যক্তিকে নিম্নোক্ত যোগ্যতার পূর্ণ অধিকারী হতে হয়।
১. তাকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে;
২. ৩৫ বছর বয়স্ক হতে হবে এবং
৩. জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা থাকতে হবে।
রাষ্ট্রপতির পদমর্যাদা
রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের প্রধান এবং তিনি অন্য সকল ব্যক্তির উর্ধ্বে। তিনি বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের সর্বজন শ্রদ্ধাশীল ‘মহামান্য’ ব্যক্তি। তিনি সংবিধান প্রদত্ত ক্ষমতা প্রয়োগ ও কর্তব্য পালন করবেন। তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের জন্য তিনি কোনো আদালতে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন। তিনি রাষ্ট্র প্রদত্ত সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা ও মর্যাদা ভোগ করেন।
রাষ্ট্রপতির অপসারণ
সংবিধান অনুযায়ী সংবিধান লঙ্ঘন গুরুতর অসদাচরণ এবং শারীরিক ও মানসিক অসামর্থ্যের কারণে রাষ্ট্রপতিকে মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্বেই তাঁর পদ থেকে অপসারণ করা যায়। এক্ষেত্রে সংসদের মোট সদস্যের দু-তৃতীয়াংশের সমর্থন প্রয়োজন হয়।
রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও কার্যাবলি
সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রকৃত শাসন ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীসমেত মন্ত্রিসভার হাতে ন্যস্ত। তথাপি রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী নিম্নোক্ত কার্যাবলি সম্পাদন করে থাকেন।
১. নির্বাহী ক্ষমতা
রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে রাষ্ট্রপতির নামে প্রজাতন্ত্রের সকল নির্বাহী ব্যবস্থা গৃহীত ও প্রকাশিত হয়। রাষ্ট্রপতির নামে প্রণীত আদেশ ও অন্যান্য চুক্তিপত্র কীভাবে সত্যায়িত বা প্রমাণকৃত হবে তা রাষ্ট্রপতি নির্ধারণ করেন। তিনি সরকারি কার্যাদি বণ্টন ও পরিচালনার বিধি তৈরি করেন।
২. নিয়োগ ক্ষমতা
রাষ্ট্রপতি জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগদান করেন। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী তিনি অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী নিয়োগ করেন। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিসহ অন্যান্য বিচারপতি, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ পদে রাষ্ট্রপতি নিয়োগদান করেন।
৩. আইন বিষয়ক ক্ষমতা
রাষ্ট্রপতি জাতীয় সংসদের অধিবেশন আহ্বান, স্থগিত ও ভেঙে দিতে পারেন। তিনি সংসদে ভাষণ দেন ও বাণী প্রেরণ করেন। রাষ্ট্রপতি প্রত্যেক সাধারণ নির্বাচনের পর সংসদের প্রথম অধিবেশনের প্রারম্ভে এবং প্রত্যেক বছরের প্রথম অধিবেশনের প্রারম্ভে ভাষণ দেন। সংসদে গৃহীত কোনো বিল রাষ্ট্রপতির সম্মতিসাপেক্ষে আইনে পরিণত হয়।
৪. আর্থিক ক্ষমতা
সরকারের আয়-ব্যয় সংবলিত কোনো বিল (অর্থ বিল) রাষ্ট্রপতির সুপারিশ ব্যতীত সংসদে উত্থাপন করা যায় না। এমনকি রাষ্ট্রপতির সুপারিশ ব্যতীত কোনো মঞ্জুরিও দাবি করা যায় না। চলতি অর্থবছরে কোনো বিভাগের জন্য অনুমোদিত ব্যয় যথেষ্ট না হলে অথবা নতুন কোনো বিভাগের জন্য ব্যয় নির্বাহের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে রাষ্ট্রপতির সংযুক্ত তহবিল থেকে উক্ত ব্যয় নির্বাহের জন্য কর্তৃত্ব প্রদান করতে পারেন।
জাতীয় সংসদের গঠন ক্ষমতা ও কার্যাবলী আলোচনা কর |
৫. বিচার ক্ষমতা
রাষ্ট্রপতির বিচারসংক্রান্ত ক্ষমতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ও অন্য বিচারকদের নিয়োগ দেন। কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্যকোনো কর্তৃপক্ষ প্রদত্ত যেকোনো দণ্ডের মার্জনা, বিলম্ব ও বিরাম মঞ্জুর করা বা যেকোনো দণ্ড মওকুফ বা হ্রাস করার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতি ভোগ করেন।
৬. জরুরি অবস্থা ঘোষণার ক্ষমতা
দেশ বহিঃশত্রুর আক্রমণ দ্বারা আক্রান্ত হলে কিংবা অভ্যন্তরীণ গোলযোগের কারণে বাংলাদেশ বা তার কোনো অংশের নিরাপত্তা বা অর্থনৈতিক জীবন সংকটের সম্মুখীন হলে রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন। উল্লেখ্য, জরুরি অবস্থা ঘোষণার ফলে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার স্থগিত রাখা হয়।
৭. বিবিধ ক্ষমতা
রাষ্ট্রপতি সংসদ অধিবেশন বন্ধ থাকাকালীন প্রয়োজনীয় পরিস্থিতিতে আশু ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অধ্যাদেশ প্রণয়ন ও জারি করেন। তিনি প্রতিরক্ষা বিভাগের সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব পালন, বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের অভ্যর্থনা এবং পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন দেশ সফর করেন।
সংসদীয় ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি প্রশাসনযন্ত্রের প্রধান। তাঁর ক্ষমতা ও পদমর্যাদা ব্রিটেনের রাজা/ রাণীর সাথে তুলনীয়। তথাপিও রাষ্ট্রপতির ভূমিকা একেবারে গুরুত্বহীন নয়। তিনি শাসনব্যবস্থার ধারাবাহিকতা সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
আশাকরি, উপরের ব্লগ লেখা থেকে আপনারা বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও কার্যাবলী সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা লাভ করেছেন।