ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব
বাঙালির জাতীয় জীবনে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। এ আন্দোলন ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশের প্রথম পদক্ষেপ। কেননা এর মাধ্যমে বাঙালির জাতীয় স্বাতন্ত্র্য ও সংস্কৃতিবোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এ আন্দোলনের মাধ্যমেই বাংলা ভাষা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে। তাই বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। যেমন-
প্রথমত, ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ববাংলার জনগণের মধ্যে নব জাতীয় চেতনা তথা বাংলা ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটে। এ আন্দোলনের মাধ্যমেই বাঙালি প্রথম রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে।
ভারত স্বাধীনতা আইন ১৯৪৭ এর প্রেক্ষাপট, বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব |
দ্বিতীয়ত, ভাষা আন্দোলনে অনেক রক্ত ঝরে। তাই এ আন্দোলন বাঙালিদেরকে রক্তের বিনিময়ে জাতীয়তার দাবি আদায়ের শিক্ষা দেয়। সেই সাথে বাঙালি জাতি আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের সুদৃঢ় প্রেরণা লাভ করে।
তৃতীয়ত, ২১ ফেব্রুয়ারির বিয়োগান্তক ঘটনায় বাংলার বুদ্ধিজীবী সমাজ সংগ্রামী চেতনায় জেগে ওঠে। ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, শ্রমিক, ব্যবসায়ী নির্বিশেষে সর্বস্তরের গণমানুষের মধ্যে এক বৈপ্লবিক চেতনার উন্মেষ ঘটে। যা পরবর্তীকালে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেরণা যোগায়।
চতুর্থত, ১৯৫৪ সালে পূর্ববাংলার প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট যে ঐতিহাসিক ২১ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে অবতীর্ণ হয় তার প্রথম দফা ছিল ‘বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হবে।’ এ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট অভূতপূর্ব বিজয় লাভ করে। বিপরীতে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে। এ বিজয় পরবর্তীকালে বাঙালিদের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের মূলমন্ত্র হিসেবে কাজ করে।
পঞ্চমত, ভাষা আন্দোলনে ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, কৃষক, শ্রমিক তথা সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে যে ঐক্য স্থাপিত হয় তার ফলশ্রুতিতেই পরবর্তীকালে ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের সাধারণ নির্বাচন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিদের বিজয় অর্জিত হয়।
লাহোর প্রস্তাবের গুরুত্ব আলোচনা কর |
উপরের আলোচনার প্রেক্ষাপটে প্রতীয়মান হয় যে, বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে মহান ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। এ আন্দোলনে বাঙালি জাতির স্বকীয় জাতিসত্তা এবং স্বাধিকার আদায়ের তেজদীপ্ত ঐক্যানুভূতির প্রকাশ ঘটে- যার ফলশ্রুতিতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। ১৯৫২ সালের ঐতিহাসিক ২১ ফেব্রুয়ারিকে বিশ্ব সংস্থা জাতিসংঘ ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণা করায় বাঙালির মাতৃভাষার গৌরব ও মর্যাদা আজ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত।