রাজনৈতিক ব্যবস্থা
সাধারণ অর্থে ব্যবস্থা বলতে বুঝায় কতগুলো উপাদান বা অংশের সমন্বয়, যা পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দ্বারা আবদ্ধ থাকে। ব্যবস্থা শব্দটি অনেকগুলো উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত। এসব উপাদানগুলোর পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও প্রতিক্রিয়া একটি ব্যাপক আবার অন্যদিকে একটি নির্দিষ্ট সীমানার ধারণার সাথে সম্পর্কযুক্ত। যে কোনো ব্যবস্থার সাথে সম্পর্কিত উপাদানসমূহ পরস্পর পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। তাদের একটির পরিবর্তন হলে অন্য উপাদানগুলোও তার দ্বারা প্রভাবিত হয়।
ডেভিড ইস্টন (David Easton) তাঁর ‘The Political System’ নামক গ্রন্থে রাজনৈতিক ব্যবস্থার ধারণাটি সর্বপ্রথম প্রয়োগ করেন। তারপর কার্ল ভয়েস (Karl Deutsch), অ্যালমন্ড ও পাওয়েল (Almond and Powell), মরিস দ্যুভার্জার (Maurice Duverger), হ্যারল্ড লাসওয়েল ও আব্রাহাম ক্যাপলান (Harold Lasswell and Abraham Kaplan), রবার্ট ডাল (Robert Dahl), ব্যারিংটন ম্যুর (Barington Moore), অ্যালান বল (Alan Ball) প্রমুখ ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন।
রাজনৈতিক উন্নয়ন কি? রাজনৈতিক উন্নয়নের সংজ্ঞা দাও |
ডেভিড ইস্টন (David Easton) তাঁর “The Political System’ শীর্ষক গ্রন্থে রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, “Political system is that system of interactions in any society through which binding or authoritative allocations are made.” অর্থাৎ পারস্পরিক আন্তঃক্রিয়ার সম্পর্কে আবদ্ধ ব্যবস্থাই হলো রাজনৈতিক ব্যবস্থা। কর্তৃত্বসম্পন্ন বা বাধ্যতামূলক বরাদ্দের নীতি এ ব্যবস্থার মাধ্যমে কার্যকর হয়। ইস্টনের এ সংজ্ঞাটি বিশ্লেষণ করলে এর তিনটি উল্লেখযোগ্য দিকের সন্ধান পাওয়া যায়। যথা-
ক. রাজনৈতিক ব্যবস্থা এর গৃহীত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে মর্যাদা ও মূল্যবোধ বণ্টন করে,
খ. এ বণ্টন কর্তৃত্বসম্পন্ন, অর্থাৎ এর পিছনে কর্তৃপক্ষীয় শক্তি বিদ্যমান এবং
গ. এ কর্তৃত্বসম্পন্ন বণ্টন গোটা সমাজের উপর বাধ্যতামূলকভাবে প্রযোজ্য।
অ্যালমন্ড এবং পাওয়েল (Almond and Powell) তাঁদের ‘Comparative Politics: A Developmental Approach’ শীর্ষক গ্রন্থে বলেন, “Political system directs attention to the entire scope of political activities within a society, regardless of where in the society such activities maybe located.” অর্থাৎ, রাজনৈতিক ব্যবস্থার মাধ্যমেই সমাজের অন্তর্ভুক্ত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিস্থিতিসমূহ বুঝে উঠা সম্ভব। তাঁর মতানুযায়ী আইনসভা, আদালত ও প্রশাসনিক সংস্থার মতো কেবল সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহকে নিয়েই রাজনৈতিক ব্যবস্থা গঠিত হয় না, রাজনীতির সাথে জড়িত সব কাঠামোই এর অন্তর্ভুক্ত। এসব কাঠামোর মধ্যে আত্মীয়তার বন্ধন ও জাতিবর্ণভিত্তিক গোষ্ঠীর মতো সনাতন কাঠামো এবং হত্যাকাণ্ড, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও বিক্ষোভ প্রদর্শনের মতো ঘটনাবলি যেমন অন্তর্ভুক্ত, তেমনি রাজনৈতিক দল, স্বার্থগোষ্ঠী ও যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমের মতো আনুষ্ঠানিক সংগঠনগুলোও এর অন্তর্ভুক্ত। তাদের ভাষায়-“It (Political system) directs attention to the entire scope of political activities within a society, regardless of where in the society such activities maybe located.” এই দুই আধুনিক চিন্তাবিদ রাজনীতিক ব্যবস্থা প্রসঙ্গে আরো বলেছেন- “When we speak of political system we include all the interactions which affect the use or threat of use of legitimate physical coercion. The political system includes not only governmental institutions such as legislatures, courts and administrative agencies, but all structures in their political aspects. Among these are traditional structures such as kinship des and caste groupings; and anomic phenomena such as assassinations, riots and demonstrations; as well as formal organizations like parties, interest groups, and media communications.”
রাজনৈতিক আধুনিকীকরণ কি? রাজনৈতিক আধুনিকীকরণের বৈশিষ্ট্য |
G.A. Almond তাঁর ‘Comparative Political Systems’ শীর্ষক গ্রন্থে রাজনৈতিক ব্যবস্থার চারটি ধরনের কথা বলেছেন, এগুলো হলো: (1) Anglo American System. (2) Continental European System (3) Pre Industrial System and (4) Totalitarian System.
অ্যালমন্ড রাজনৈতিক ব্যবস্থার পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের কথাও উল্লেখ করেছেন। এগুলো হলো, রাজনৈতিক ব্যবস্থার সার্বজনীনতা, রাজনৈতিক কাঠামোর সার্বজনীনতা, রাজনৈতিক কার্যাবলির সার্বজনীনতা। সকল রাজনৈতিক কাঠামোর বহুমুখী কার্যাবলি এবং পরিশেষে রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে “মিশ্র সংস্কৃতির” উপস্থিতি।
মার্কসবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফিওদোর বুরলাটস্কি (Fyodor Burlatsky) তাঁর ‘The Modern State and Politics’ নামক গ্রন্থে মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ থেকে রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংজ্ঞা নির্দেশ করেছেন। তাঁর মতে, রাজনৈতিক ব্যবস্থা বলতে এমন একটি জটিল বিন্যাস (A complex formation) কে বুঝায়, যা একটি অভিন্ন সত্তা হিসেবে (As a single organism) সমাজের অস্তিত্ব রক্ষা করে এবং যা একটি রাজনৈতিক কর্তৃত্বের দ্বারা কেন্দ্রীয়ভাবে শাসিত হয়। তবে তিনি রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে অর্থনৈতিক ও বুদ্ধিভিত্তিক উপব্যবস্থা (The economic and intellectual sub-system) এর পাশাপাশি অবস্থিত সমাজের একটি উপব্যবস্থা বলে বর্ণনা করেছেন।
রিচার্ড টি. শেফার (Richard T. Schaefer) রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, “Political system sociologists mean the social institution that is founded on a recognized set of procedures for implementing and achieving society’s goals.” অর্থাৎ “রাজনৈতিক ব্যবস্থা, দ্বারা সমাজবিজ্ঞানীরা ঐসব সামাজিক প্রতিষ্ঠানকে বুঝিয়েছেন সমাজ গঠনের লক্ষ্যে যে প্রক্রিয়াকে স্বীকৃতি জানানো হয়।” শেফার যে কোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ক্ষমতার মৌল উৎস হিসেবে ব্যক্তির, প্রভাব ও কর্তৃত্বের কথা বলেন।
রাজনৈতিক ব্যবস্থা আধুনিক মানুষের রাজনৈতিক জীবনের সকল দিককে কম-বেশি অন্তর্ভুক্ত করে প্রভাবিত করে। এজন্য সম্ভবত উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাই বেশির ভাগ আধুনিক মানুষের কাম্য বা কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা।