আজকের লেখায় লাহোর প্রস্তাবের পটভূমি বা প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হবে।
লাহোর প্রস্তাব
ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক অগ্রগতিতে ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব একটি যুগান্তকারী ঘটনা। মূলত ভারতের উপেক্ষিত মুসলমান সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষার্থে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়েই লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। প্রস্তাবে ব্রিটিশ ভারতের যেসব অঞ্চলে মুসলমানগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ সেসব অঞ্চলসমূহ নিয়ে পৃথক রাষ্ট্রসমূহ গঠনের কথা বলা হয়। তদানীন্তন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে এ প্রস্তাব উত্থাপন করেন।
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন ও এ আইনের বৈশিষ্ট্য |
লাহোর প্রস্তাবের পটভূমি
যেসব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ “All India Muslim League” এর লাহোর অধিবেশনে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল তা নিচে তুলে ধরা হলো-
১. নেহেরু রিপোর্ট ১৯২৮
ব্রিটিশ ভারতের শাসনতান্ত্রিক অগ্রগতিতে নেহেরু রিপোর্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হলেও এ রিপোর্টে ভারতের মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণের কোনো উল্লেখ না থাকায় মুসলিম লীগ ও খিলাফত কমিটির দাবি বিবেচনার জন্য নেহেরু কমিটি পুনরায় একটি সাব কমিটি গঠন করে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে উক্ত সাব কমিটিতেও মুসলমানদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো অত্যন্ত সতর্কতার সাথে অগ্রাহ্য করা হয়। ফলে ভারতের মুসলমান নেতৃবৃন্দ হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের পথ পরিহার করে মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য স্বতন্ত্র চিন্তাভাবনা শুরু করে।
২. ১৯৩৫ সালের আইনের কার্যকারিতা
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন ভারতীয়দের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ কোনো দলই এটিকে সানন্দে গ্রহণ করতে পারেনি। অপরদিকে, এ আইনের অধীনে ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ উল্লেখযোগ্য আসন লাভ করলেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভে ব্যর্থ হয়। ফলে কংগ্রেসের সাথে যুক্তভাবে মন্ত্রিসভা গঠনের প্রস্তাব করলে কংগ্রেস তা প্রত্যাখ্যান করে। তবে বাংলা ও পাঞ্জাব প্রদেশে মুসলিম লীগের নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। কংগ্রেসের নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা গঠনের ফলে বিভিন্ন সরকারি অফিস-আদালতে কংগ্রেসের পতাকা উড়ানো হয়’ এবং বন্দেমাতরম সংগীত পরিবেশনের ব্যবস্থা করা হয়। কংগ্রেসের এরূপ কার্যক্রমে মুসলমানগণ হতাশ হয়ে পড়ে এবং কোনো কোনো স্থানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখা দেয়।
৩. দ্বিজাতি তত্ত্ব
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বই (Two Nation Theory) ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব উত্থাপনের ভিত্তি তৈরি করেছিল। কংগ্রেস সভাপতি পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু ঘোষণা করেন যে, ভারতীয় উপমহাদেশে কেবল দুটি দলের অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। একটি হলো কংগ্রেস এবং অপরটি হলো সরকার এবং বাকি দলগুলো কংগ্রেসের অন্তর্ভুক্ত। এতে মুসলমান নেতৃবৃন্দ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ হিন্দু-মুসলিম সমস্যা সমাধানের জন্য হিন্দু নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ-আলোচনা করেও ব্যর্থ হন। ফলে জিন্নাহ উপলব্ধি করেন যে হিন্দু সম্প্রদায়ের সাথে ঐক্যবদ্ধ থাকলে মুসলমানদের স্বার্থরক্ষা পাবে না। জিন্নাহ জোর দিয়ে বলেন, যেকোনো আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী মুসলমানরা একটি জাতি। তাই তাদের জন্য একটি পৃথক আবাসভূমি প্রয়োজন। প্রয়োজন একটি ভূখণ্ডের, একটি রাষ্ট্রের। তিনি তেজোদীপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন ভারতীয় উপমহাদেশে ভারতীয় মুসলমানগণ তৃতীয় দল এবং তারা একটি স্বতন্ত্র জাতি।
অতএব, উপরের আলোচনা থেকে আপনারা লাহোর প্রস্তাবের পটভূমি সম্পর্কে জানতে পারলেন।