Home » ইভটিজিং কি? ইভটিজিং এর কারণ ও প্রতিকার বর্ণনা কর
ইভটিজিং কি, ইভটিজিং কাকে বলে, ইভটিজিং এর কারণ ও প্রতিকার,

ইভটিজিং কি? ইভটিজিং এর কারণ ও প্রতিকার বর্ণনা কর

by Susmi
0 comment

ইভটিজিং

সৃষ্টির বিবরণে ‘ইভ’ হলেন বাইবেল ও কুরআন বর্ণিত পৃথিবীর প্রথম নারী বিবি হাওয়া। বর্তমানে ইভ বলতে সমগ্র নারীজাতিকে বোঝায়। আর টিজিং অর্থ হলো উত্ত্যক্ত বা হয়রানি করা। সুতরাং ইভটিজিং -এর আক্ষরিক অর্থ নারীকে উক্ত্যক্ত করা, ঠাট্টা করা, বিরক্ত করা, বিব্রত করা। অর্থাৎ পুরুষ কর্তৃক নারীকে উক্ত্যক্ত করা, লাঞ্ছিত করা এবং যৌন নিপীড়ন করা। যারা এ ক্রিয়াকলাপে লিপ্ত হয় তাদেরকে বলে ইভটিজার।

১৯৬০ সালের দিকে প্রথম মিডিয়ার মাধ্যমে ইভটিজিং শব্দটি আলোচনায় আসে। কারণ ঐ সময় থেকেই অধিকসংখ্যক মেয়েরা স্কুলগামী হয় এবং এ ধরনের আচরণের শিকার হয়। অন্যকথায় ইভটিজিংকে নারীর প্রতি সহিংসতা বা বিদ্বেষপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবেও গণ্য করা হয়। বাংলাদেশে এই শব্দটির প্রচলন হয় মূলত স্যাটেলাইট চ্যানেল আকাশ সংস্কৃতির মাধ্যমে। বর্তমানে মেয়েরা রাস্তাঘাটে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, উন্মুক্ত স্থানে এমনকি পাবলিক যানবাহনে মেয়েরা টিজিং-এর শিকার হচ্ছে।

আরও পড়ুন

খাদ্যে ভেজালের কারণ ও খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে করণীয়

একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ইভটিজারদের শতকরা ৩২ ভাগ ছাত্র, ৩৫ ভাগ অসামাজিক বখাটে বা লম্পট এবং ৩৩ ভাগ মধ্যবয়সী লোক। তরুণ বয়সী এমনকি মধ্যবয়সী পুরুষরা যেভাবে মেয়েদেরকে উত্যক্ত বা হয়রানি করে তা হলো-

  • বাজে অঙ্গভঙ্গি কিংবা অশ্লীল মন্তব্যের মাধ্যমে মেয়েদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করা।
  • শিষ বাজানো, হাততালি, অশ্লীল গান এবং স্পর্শ করা।
  • অশ্লীল ছবি ও পর্ণোগ্রাফি, দেয়াল লিখন, কোনো নারীকে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও যেকোনোভাবে চাপ প্রয়োগ করা।
  • মোবাইলে মিসড কল বা অশ্লীল, কুরুচিপূর্ণ মেমেজ আদান-প্রদান।
  • যানবাহনে এবং চলার পথে মেয়েদের গা ঘেঁষে দাঁড়ানো বা ধাক্কা দেওয়া।
  • অস্বস্তিকর, অপলক দৃষ্টি, পিছু নেওয়া বা চলার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা।
  • ব্ল‍্যাকমেইল বা চরিত্র হননের উদ্দেশ্যে স্থির চিত্র ধারণ করা।
  • ইন্টারনেট বা ফেসবুকে মেয়েদের সৌন্দর্য বা শরীর সম্পর্কে অশালীন মন্তব্য করা।

সুতরাং উপরিউক্ত আচরণ বা ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে পুরুষ কর্তৃক নারীকে উত্ত্যক্ত করাকেই ইভ্টিজিং বলে। নারীরা তাদের প্রয়োজনে বাইরে বের হয়ে স্কুল-কলেজ, কর্মস্থল তথা গন্তব্যে পৌঁছার পথে বা ঐসব স্থানে প্রতিনিয়ত ইভটিজিংয়ের শিকার হচ্ছে।

ইভটিজিং-এর কারণ

আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এক অত্যাধুনিক বিড়ম্বনা ইভটিজিং-এর কারণ সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, গবেষক্ষ তথা বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের ভিন্ন ভিন্ন মত লক্ষ করা যায়। কারও মতে, ইভটিজিংয়ের কারণ শুধু মেয়েরা। অর্থাৎ মেয়েদের উগ্রতা বা প্ররোচনার কারণেই ইভটিজিং হয়। আবার অনেকে সমাজের উঠতি বয়সী তরুণ, বখাটে এবং মাদকাসক্ততাকে দায়ী করছেন। কেউ কেউ এটাকে ‘উঠতি বয়সের চপলতা’ হিসেবে দেখছেন। সর্বোপরি আমাদের সমাজে মেয়েরা যেসব কারণে ইভটিজিংয়ের শিকার হচ্ছে সেগুলো হলো-

১. আকাশ সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাব।

২. নৈতিক চরিত্র ও মূল্যবোধের অবক্ষয়।

৩. মেয়েদের অশালীন পোশাক, চলন-বলন।

৪. অশ্লীল ছবি, ভিডিও চিত্র ও অশ্লীল গানের সহজলভ্যতা।

৫ . সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের অসচেতনতা।

৬. অসৎ সঙ্গের প্ররোচনা।

৭. উচ্ছৃঙ্খল ও বখাটে যুবকদের বিকৃত মানসিকতা এবং মাদকাসক্ততা।

৮. নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল দৃষ্টিভঙ্গির অভাব।

৯. ধর্মীয় রীতিনীতি ও সুস্থ সংস্কৃতির যথাযথ চর্চার অভাব।

১০. আইনের সঠিক প্রয়োগের অভাব।

১১. অপরাধীদের আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসার সুযোগ।

ইভটিজিং-এর প্রভাব

সমাজ জীবনে ইভটিজিং-এর প্রভাব ভয়াবহ এবং সুদূরপ্রসারী। প্রতিনিয়ত ইভটিজিংয়ের বিষাক্ত ছোবলে অনেক তরুণীকে অকালে প্রাণ দিতে হচ্ছে। ইভটিজিং-এর কারণে নির্মম প্রাণহানি এবং আত্মহননের ঘটনা বেড়েই চলেছে। ইভটিজিংয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে বাবা-মা, ভাই, আত্মীয়স্বজনকে লাঞ্ছিত হতে হচ্ছে এমনকি তাদেরকে প্রাণও দিতে হয়েছে। সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ঘটনা হলো ইভটিজিং-এর প্রতিবাদ করায় মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষককেও প্রাণ দিতে হয়েছে।

আরও পড়ুন

খাদ্যে ভেজাল বলতে কি বুঝায় | খাদ্যে ভেজালের প্রকৃতি ও প্রভাব আলোচনা

তরুণ হয়সী ছেলেদের বেপরোয়া উত্ত্যক্ততার শিকার হয়ে অনেক মেয়ের স্কুল-কলেজে যাওয়া বন্ধ হয়ে হছে। লজ্জায় কিংবা লোকনিন্দার ভয়ে মেয়েরা নীরবে সহ্য করে যাচ্ছে, এমনকি পরিবারও বিষয়টি খারাপ চোখে দেখে উপরন্ত মেয়েকেই দায়ী করছে। এ কারণে তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে। অসহায়ত্ব, ক্রোধ, হতাশা এবং অন্যের প্রতি অবিশ্বাসের কারণে কোমলমতি মেয়েরা এক পর্যায়ে আত্মহত্যার দিকে পা বাড়াচ্ছে।

ইভটিজিংয়ের আরেক ক্ষতিকর প্রভাব হলো বাল্যবিবাহের প্রবণতা বাড়ছে। অর্থাৎ বাবা-মা মেয়েকে ভাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে এ ধরনের অপঘাতের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করছে। ইভটিজিং-এর ভয়াল এবায় কোমলমতি মেয়েদের স্বপ্নসাধ অঙ্কুরেই ঝরে পড়ছে এবং তারা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে।

ইভটিজিং এর প্রতিকার

ইভটিজিং একটি ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এটি একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ইভটিজিং বন্ধ করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। শুধু আইন প্রণয়ন করে ইভটিজিং বন্ধ করা যাবে না। ইভটিজারদের শাস্তি বিধানের জন্য আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি নিম্নোক্ত প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

  • ইভটিজিং সম্পর্কে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে এর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলা।
  • ইভটিজিং একটি ঘৃণিত, গর্হিত এবং নিম্নমানের খারাপ কাজ। এ বিষয়ে পারিবারিকভাবেই শিশুদেরকে অবহিত করা এবং ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার আলোকে তাদেরকে গড়ে তোলা।
  • তরুণীদেরকে মার্জিত পোশাক পরিধান করা এবং শালীনতার সাথে রাস্তাঘাটে চলাফেরা করা।
  • ছেলেমেয়েরা যাতে খারাপ সঙ্গের সংস্পর্শে না যায় সেদিকে অভিভাবকদের দৃষ্টি দেওয়া।
  • ইভটিজিংয়ের বিরুদ্ধে সচেতনতামূলক কর্মসূচি বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে তুলে ধরা।
  • শিশু ও নারী নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এ ইভটিজিং-এর সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছরের কারাদণ্ডের যে বিধান রয়েছে তা কঠোরভাবে কার্যকর করা।।
  • ইভটিজিং রোধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান অব্যাহত রাখা এবং এ আদালতের ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করা। শ্রেণিকক্ষে ছাত্রছাত্রীদের মাঝে ইভটিজিং-এর ভয়াবহতা, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ইত্যাদি তুলে ধরা।
  • ইভটিজারদের কোনোভাবেই আশ্রয়-প্রশয় না দিয়ে তাদেরকে সামাজিকভাবে বয়কট করা এবং আইনের হাতে সোপর্দ করা।
  • বখাটে, উচ্ছৃঙ্খল ছেলেদের সুপথে আনতে কাউন্সিলিং করা।
  • ইভটিজিংয়ের শিকার হয়েছে এমন মেয়ের পাশে দাঁড়ানো যাতে সে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে।
  • শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও সমাজের বিভিন্নস্তরের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে
  • ইভটিজিং প্রতিরোধ কমিটি গঠনের যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তা কার্যকর রাখা।
  • নারীর প্রতি পুরুষের বিদ্বেষমূলক দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করা।
  • সর্বোপরি ইভটিজিং প্রতিরোধে আরও যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন করে অপরাধীদের কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা।

Related Posts