Home » খাদ্যে ভেজালের কারণ ও খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে করণীয়
খাদ্যে ভেজালের কারণ, খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে করণীয়,

খাদ্যে ভেজালের কারণ ও খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে করণীয়

by Susmi
0 comment

খাদ্যে ভেজালের কারণ

দৈনিক পত্রপত্রিকা এবং টিভি চ্যালেনগুলোর মাধ্যমে আমরা খাদ্যে ভেজালের ওপর ভয়ঙ্কর সব প্রতিবেদন দেখতে পাই। সম্প্রতি একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে ঢাকায় ৭০% এবং সারা দেশে ৫০% খাদ্যদ্রব্য, ভেজাল। ঢাকা সিটি করপোরেশন সূত্র থেকেও এরূপ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। অন্যদিকে, ‘ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথ’ এর সূত্র মতে, দেশের পঞ্চাশ শতাংশ খাদ্যদ্রব্যই ভেজাল মিশ্রিত করে বিক্রি করা হয়।

কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর হিসেবেও অনুরূপ তথ্য পাওয়া গেছে। বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা খাদ্যে ভেজালের যেসব কারণ উল্লেখ করেছেন তা নিচে উল্লেখ করা হলো-

১. অতিরিক্ত মুনাফার লোভ

খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল মেশানোর প্রধান কারণ হলো এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীর দ্রুত ও স্বল্প সময়ে অতিরিক্ত মুনাফার লোভ। ভেজাল মেশানোর প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থসহ ইট, বালি, কাঠের গুঁড়া ইত্যাদি ব্যবহার করা হয় যাতে ওজন বৃদ্ধি পায় এবং সংরক্ষণের জন্য ফরমালিন ব্যবহার করা হয়।

খাদ্যে ভেজাল বলতে কি বুঝায় | খাদ্যে ভেজালের প্রকৃতি ও প্রভাব আলোচনা

২. নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়

খাদ্যে ভেজাল মেশানো, পচা খাদ্যদ্রব্য চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে বাজারজাত করা, খাদ্যদ্রব্য অবৈধভাবে মজুত করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা ইত্যাদি অনৈতিক ক্রিয়াকলাপ নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের অভাবেই হয়ে থাকে।

৩. স্বাদ, ঘ্রাণ পরিবর্তন করা

ভেজালকারকরা খাদ্যের স্বাদ বা ফ্লেভার বাড়াতে এবং খাদ্যকে দৃষ্টিনন্দন করতে ভেজাল মেশায়। এতে খাদ্যের প্রকৃত স্বাদ ও গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়।

৪. ভোগবাদীপ্রবণতা

ভোগবাদীপ্রবণতা এবং রাতারাতি ধনী হওয়ার প্রবণতা থেকেও খাদ্যে ভেজাল মেশানো হয়। কারণ একশ্রেণির ব্যবসায়ীর ধারণা সঠিক এবং বিশুদ্ধ দ্রব্যে কাঙ্ক্ষিত মুনাফা অর্জন করা সম্ভব নয়। ফলে তারা অবৈধ পন্থায় ভেজাল মিশ্রিত খাদ্য বাজারজাত করে।

৫. প্রশাসনিক দুর্বলতা

কঠোর আইন এবং আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকার কারণে একশ্রেণির অতি মুনাফালোভী অসাধু ব্যবসায়ী অবাধে খাদ্যে ভেজাল মেশানোর মতো নিন্দনীয় কাজটি করে চলেছে। খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে সুনির্দিষ্ট এবং কার্যকর পদক্ষেপের অভাবেই এমনটি হচ্ছে।

খাদ্যে ভেজাল রোধে করণীয়

ভেজাল খাদ্য মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। পিওর ফুড আইন ১৯৫৯, ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন, বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ২৭২ ও ২৭৩ ধারা, বিশুদ্ধ খাদ্য আইন ২০০৫, জাতীয় খাদ্যনীতি ২০০৬, ২০০৯ সালের ২০ জুন মহামান্য হাইকোর্টের যুগান্তকারী রায় ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য খাদ্যে ভেজাল রোধ এবং বিশুদ্ধ খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের কথা উল্লেখ রয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “জনগণের পুষ্টির স্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন রাষ্ট্রের অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলে গণ্য করবে।” ভেজাল ও নিম্নমানের খাদ্যদ্রব্যে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। জনগণের পুষ্টির স্তর উন্নয়ন ও স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য নিশ্চিত করার জন্য সর্বাগ্রে রাষ্ট্রকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। খাদ্যে ভেজাল মেশানো ও তা প্রতিরোধের জন্য নিম্নোক্ত করণীয় গুলো আশু প্রয়োজন-

  • বাংলাদেশে খাদ্য বিষয়ক প্রায় সতেরটি আইন বিদ্যমান রয়েছে। এসব আইনের কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করা। বিশেষ করে নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩-এ খাদ্যে ভেজাল বা ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মেশানোর অভিযোগে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড এবং ১০ লক্ষ টাকা জরিমানার যে বিধান এবং একই অপরাধ দ্বিতীয় বার করলে দ্বিগুণ শাস্তির যে ব্যবস্থা রয়েছে তা কঠোরভাবে প্রয়োগ করা।
  • খাদ্যে ভেজাল রোধকল্পে যেসব আইনে ভেজালকারীর জরিমানা ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান রয়েছে তা যথাযথভাবে কার্যকর করা।
  • ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন, ২০০৯-এর মাধ্যমে সারাদেশে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে প্রতিদিনই ফরমালিন শনাক্ত করে জরিমানা ও বিষাক্ত ফল ধ্বংস করা হচ্ছে। এ কার্যক্রম অব্যাহত রাখা।
  • ‘বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য প্রতিষ্ঠান’ এবং খাদ্যনমুনা পরীক্ষা করার জন্য জেলা, উপজেলা এবং বড় বড় বাজারে ‘খাদ্য পরীক্ষাগার’ স্থাপন করে খাদ্যদ্রব্যের গুণগতমান নিশ্চিত করা এবং সেই সাথে নিম্নমানের পণ্য বিক্রি বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া।
  • খাদ্যের মান বজায় রাখাসহ জনসাধারণের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে মহামান্য হাইকোর্ট ২০ জুন ২০০৯ যে যুগান্তকারী রায় প্রদান করেছে তা কার্যকর করা।
  • প্রচলিত আইন ও অধ্যাদেশগুলোতে ভেজালকারীদের জন্য যে জরিমানা ও শাস্তির বিধান রয়েছে তা আরও বাড়িয়ে আরও কঠোর করা।
  • বর্তমানে খাদ্যে ভেজাল একটি গুরুতর সামাজিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। তাই ভেজালের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
  • ভেজাল খাদ্য পরিহার করে অসৎ ব্যবসায়ী তথা ভেজালকারীদের সামাজিকভাবে ঘৃণা ও বয়কট করতে হবে।
  • ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯-এর যথাযথ প্রয়োগ এবং বিএসটিআই (বাংলাদেশ স্টান্ডার্ড এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট) কে অধিকতর কার্যকর ভূমিকা পালন করা।
  • খাদ্যদ্রব্য ক্রয়ের সময় অধিক সতর্কতা অবলম্বন করা এবং একটি নমুনা থেকে খাদ্যের মান পরীক্ষা করে নেওয়া। সেই সাথে ফলমূল খাওয়ার পূর্বে ভালো করে ধুয়ে নেওয়া। ফল কাটার সময় কোনো ধরনের ত্রুটি ধরা পড়লে এবং ধোয়ার সময় পানির রং পরিবর্তন হলে সেসব ফল না খাওয়া।

পরিশেষে বলা যায়, খাদ্যে ভেজাল মেশানো একটি অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ, গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ। যিনি খাদ্যে ভেজাল মেশাচ্ছেন তিনিও এর ক্ষতিকর প্রভাবের শিকার হচ্ছেন। সুতরাং শুধু আইন প্রণয়ন নয়, প্রয়োজন আইনের কঠোর প্রয়োগ, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং মানসিকতার পরিবর্তন।

বাংলাদেশে দুর্নীতির কারণ ও প্রতিকার আলোচনা কর

Related Posts