বাংলাদেশের পোশাক শিল্প বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে বেশ সমাদৃত। বিদেশী অনেক কোম্পানিই বর্তমানে বাংলাদেশে পোশাক খাতে বিনিয়োগ করেছে। আজকে এই সম্পর্কে রচনা আকারে জানবো।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প
অথবা, পোশাক শিল্প: সমস্যা ও সম্ভাবনা
ভূমিকা
শিল্পে অনুন্নত বাংলাদেশে দ্রুত বিকাশমান ও সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী যেসব শিল্প খাত রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো পোশাক শিল্প। বাংলাদেশের পোশাক শিল্প শতকরা একশ ভাগই রপ্তানিমুখী। প্রতিবছর বাংলাদেশের মোট প্রবৃদ্ধির সিংহভাগই আসে এই খাত থেকে। এই খাত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার জোগান দিচ্ছে।
পোশাক শিল্পে বাংলাদেশের অবস্থান
বাংলাদেশে তৈরি পোশাক দেশে-বিদেশে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে নিয়েছে। পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে বাংলাদেশের স্থান বর্তমানে দ্বিতীয়। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বাজার ছড়িয়ে রয়েছে বিশ্বের প্রায় ৩০টির মতো দেশে। আর এর সবচেয়ে বড়ো ক্রেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়া ফ্রান্স, কানাডা, বেলজিয়াম, জার্মানি, জাপান ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানি করে। অস্ট্রেলিয়া ও রাশিয়াতেও সম্প্রসারিত হচ্ছে বাংলাদেশের পোশাকের বাজার। পোশাক শিল্প কারখানাগুলো প্রায় ৫৪ লক্ষেরও বেশি শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি করেছে এই পোশাক শিল্প। এই শিল্পের মোট শ্রমিকের মধ্যে ৫৪ ভাগই নারী শ্রমিক। দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের পাশাপাশি জনগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশের বেকারত্ব নিরসন সম্ভব হচ্ছে এই সম্ভাবনাময় শিল্প খাতটির মাধ্যমে। কিন্তু তার পরও পোশাক শিল্পের কতিপয় অভ্যন্তরীণ সমস্যা ও মুক্ত বাজার অর্থনীতির প্রবল চাপের মুখে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ এ শিল্প খাতটির ভবিষ্যৎ অনেকটা নাজুক হয়ে উঠেছে। তাই দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজার থেকে আমদের ছিটকে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
অন্যান্য রচনা:
যুদ্ধ নয় শান্তি চাই রচনা | বাংলা রচনা
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পোশাক শিল্পের ভূমিকা
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিশেষ করে রপ্তানি খাতে প্রবৃদ্ধি বাড়াতে তৈরি পোশাক শিল্পের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ খাতের সম্ভাবনা ও অবদানের প্রধান দিকগুলো হচ্ছে:
ক. জাতীয় আয় বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন: প্রতিবছর জাতীয় আয়ের এক বিরাট অংশ আসে পোশাক শিল্প থেকে। অর্জিত হয় প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গতিশীল রাখতে সাহায্য করে। ২০২১-২২ অর্থবছরে এই খাত থেকে আয় হয়েছে প্রায় ৩০.৮৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন ভবিষ্যতে এই আয় আরও বৃদ্ধি পাবে।
খ. রপ্তানি বৃদ্ধি: ৭০০০ এর মতো কারখানা বর্তমানে তৈরি পোশাক শিল্পের অগ্রযাত্রার সঙ্গে জড়িত। দেশের অভ্যন্তরে প্রতিযোগিতার কারণে এই খাতে পণ্যের গুণগত মান বাড়ছে, রপ্তানি বাড়ছে, বাড়ছে রপ্তানি আয়ও।
গ. বেকার সমস্যা নিরসন: দেশের পোশাক শিল্প কারখানাগুলোতে প্রায় চল্লিশ লাখ শ্রমিক কাজ করে। এদের অধিকাংশই নারী। আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে এসব শ্রমিকর পাচ্ছে স্বাবলম্বী জীবন ও অর্থনৈতিক মর্যাদা।
ঘ. শিল্পের প্রসার: পোশাক শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে আরও অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান পোশাক তৈরির প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করে থাকে। যার ফলে দ্রুত শিল্পায়ন সম্ভব হচ্ছে। ঙ. পরিবহণ শিল্পের অগ্রগতিঃ পোশাক শিল্পসামগ্রী আমদানি ও রপ্তানির জন্য দেশের পরিবহণ খাতেও আয় বাড়ছে। নিত্যনতুন প্রযুক্তির সাথে বাংলাদেশ সম্পৃক্ত হতে পারছে।
পোশাক শিল্পে বিরাজমান সমস্যা
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা ও সুবিধা পেয়ে আসছে। কিন্তু তারপরও এ শিল্প খাতটিতে নানা ধরনের সমস্যা বিরাজমান। যেমন:
১. রাজনৈতিক অস্থিরতা: বিভিন্ন সময়ে দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে চাহিদা অনুযায়ী পোশাক সরবরাহ ব্যাহত হয়। ফলে সঠিক সময়ে মাল ডেলিভারি দিতে না পারায় অনেক অর্ডার বাতিল হয়ে যায়।
২. কাঁচামালের অভাব: দেশে পর্যাপ্ত কাঁচামাল না পাওয়া গেলে বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। ফলে রপ্তানি আয়ের একটা বড়ো অংশ খরচ হয়ে যায়। অন্যদিকে, উন্নত কাঁচামালের অভাবে তৈরি পোশাকের সুনাম নষ্ট হয়।
৩. বিভিন্ন ধরনের পোশাক তৈরিতে সীমাবদ্ধতা: বিশ্ববাজারে প্রায় ১১৫ ধরনের পোশাকের চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশ। সরবরাহ করতে পারে ৫ থেকে ১০ রকমের পোশাক। ফলে প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে।
৪. দক্ষ শ্রমিকের সংকট: পোশাক শিল্পে দক্ষ শ্রমিকদের সংকট একটি বড়ো সমস্যা। এই শিল্পের সিংহভাগই নারী। নারীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় এই শিল্পে বাধ্য হয়েই অদক্ষ নারী শ্রমিক নিয়োগ দিতে হয়। দক্ষ পুরুষ শ্রমিকেরও যথেষ্ট অভাব রয়েছে।
৫. শ্রমিকদের পেশাগত নিরাপত্তার অভাব: শ্রমিকরা প্রায়ই নানা ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। অগ্নিকাণ্ড, পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর মতো ঘটনা ঘটছে প্রায়ই।
৬. শ্রমিকদের মজুরি বৈষম্য: অন্যান্য শিল্পের তুলনায় পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের মজুরি অনেক কম। রয়েছে নারী শ্রমিকদের বেতন বৈষম্য। দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, অনিয়মিত বেতন শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে।
৭. অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ: নিরাপদ পানি, পরিবেশ ও পেশাগত ঝুঁকির কারণে অনেক শ্রমিক অসুস্থ হয়ে পড়ে। মজুরি কম হওয়ায় তাদের কোনো সঞ্চয় থাকে না। তার ওপর কোনো কারণে কাজে অনুপস্থিত থাকলে বেতন কেটে নেওয়া হয়।
এছাড়াও রয়েছে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাব, বিদ্যুৎ সমস্যা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা প্রভৃতি।
সমস্যা সমাধানের উপায়
যেহেতু পোশাক শিল্প অত্যন্ত লাভজনক একটি খাত, সে কারণে বিরাজমান সমস্যা সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। এ লক্ষ্যে প্রয়োজন:
১. আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা অনুযায়ী নতুন নতুন পোশাক তৈরি করা;
২. দেশেই প্রয়োজনীয় কাঁচামাল উৎপাদনের পদক্ষেপ নেওয়া;
৩. শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি ও কাজের সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করা;
৪. নিয়মিত বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা;
৫. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা ইত্যাদি।
উপসংহার
বিশ্বায়নের এ যুগে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে পোশাক শিল্পে বিরাজমান সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নিতে হবে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকার শ্রমিক ও তাদের পরিবারের কল্যাণের লক্ষ্যে শ্রম আইন ও শ্রম কল্যাণ আইন-২০০৬ প্রবর্তন করেছে। ২০১৩ সালে প্রণীত শ্রম আইনে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কাজের পরিবেশ ও নিরাপত্তার ব্যাপারটিও বিবেচনাধীন। এখন প্রয়োজন সরকার, মালিকপক্ষ ও শ্রমিকদের মধ্যে সমঝোতা। তাহলেই সম্ভানাময় এই শিল্প খাতটি আরও সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে।