Home » সামাজিক স্তরবিন্যাস কি | সামাজিক স্তরবিন্যাস কাকে বলে
সামাজিক স্তরবিন্যাস কি, সামাজিক স্তরবিন্যাস কাকে বলে,

সামাজিক স্তরবিন্যাস কি | সামাজিক স্তরবিন্যাস কাকে বলে

by Susmi
0 comment

সামাজিক স্তরবিন্যাস

সমাজে সব মানুষই সমান- এ চিন্তা প্রাচীন যুগ থেকে আরম্ভ করে বর্তমান যুগ পর্যন্ত রাজনৈতিক এবং সামাজিক চিন্তাবিদদের চিন্তাধারাকে আলোড়িত করেছে। তাই সমতার প্রশ্ন সমাজবিদদের চিন্তাভাবনাকে আলোড়িত করেছে, এমনকি সমাজ সম্পর্কে চিন্তাশীল লেখক, নাট্যকার, দার্শনিক সকলেই এ প্রশ্নের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। সমাজে সমতার নীতি প্রচারে যারা উৎসাহী ছিলেন তাঁদের চিন্তা রাজনৈতিক জগতকেও কম আন্দোলিত করে নি।

অবশ্য একথা বলা সমীচীন যে, রাজনৈতিক চিন্তাবিদগণ সাধারণত রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেই সাম্যনীতির জয়গান করেছেন; কিন্তু মানুষ নিয়েই সমাজ, আবার মানুষ নিয়েই রাষ্ট্র। ফলে সমাজ শ্রেণিগত বৈষম্যের অন্তরালে যে মনোভাব ক্রিয়া করে তার কারণ কেবল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকই নয়, সাংস্কৃতিক মূল্যের চেতনার অভাবও তার মূলে ক্রিয়াশীল। সেজন্য সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে অনেকেই এ মত পোষণ করেন যে, যতই সমাজে সাম্যবাদের জয়গান করা হোক না কেন, শ্রেণিবৈষম্য সামাজিক জীবনে অবশ্যাম্ভাবী; কারণ সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে যে বৈষম্য তার ভিত্তি হলো ক্ষমতাগত, মর্যাদাগত, জাতিগত এবং অর্থনীতিগত।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কি বা কাকে বলে ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলাফল

পৃথিবীর সমগ্র ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, “কোন সমাজই শ্রেণিহীন বা স্তরবিন্যাস ব্যতীত নেই” (No society is classless or unstratified)। আধুনিক যুগের লেখকগণ সকলেই এ মত পোষণ করেছেন। আধুনিক যুগে সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস নিয়ে সর্বপ্রথম আলোচনা করেন জন মিলার। তিনি ১৭৯৩ সালে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ ‘The Origin of the Distinctions of Rank or an Enquiry into the Circumstances’- এ সামাজিক স্তরবিন্যাস নিয়ে বিশেষভাবে আলোচনা করেন। এ গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেন যে, শ্রেণি, পদমর্যাদা, সামাজিক উঁচুনিচু ভেদাভেদ সর্বজনীন। ক্রমান্বয়ে সামাজিক আবর্তন, বিবর্তন ও পরিবর্তনের ফলে তা সম্পত্তির মালিকানা ও পদমর্যাদার উপর নির্ভর করবে।

সামাজিক স্তরবিন্যাসের সংজ্ঞা

সমাজবিজ্ঞানী জিন্সবার্টের মতে স্তরবিন্যাস হলো, “প্রাধান্য ও বশ্যতার সূত্রে পরস্পর সম্পর্কিত স্থায়ী গোষ্ঠী বা শ্রেণিতে সমাজের মধ্যে স্তরবিন্যাস।” এ সংজ্ঞা অনুযায়ী সামাজিক স্তরবিন্যাস বলতে আমরা বুঝে থাকি সমাজের কতিপয় স্থায়ী গোষ্ঠী বা বর্ণে বিভক্ত হওয়া, যারা কর্তৃত্ব ও বশ্যতার সম্পর্কে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত।

সমাজবিজ্ঞানী সরোকিন বলেন, “সামাজিক স্তরবিন্যাস বলতে জনসংখ্যাকে পর্যায়ক্রমে বিভক্তিকরণ বুঝায়।” এ স্তরবিন্যাসের একপ্রান্তে উচ্চশ্রেণি ও অপরপ্রান্তে নিম্নশ্রেণি অবস্থিত। সমাজবিজ্ঞানী সরোকিন তাঁর ‘Social Mobility’ গ্রন্থে সামাজিক স্তরবিন্যাসের দুটি কারণ উল্লেখ করেন।

প্রথমত, তিনি উল্লেখ করেন যে, প্রত্যেকটি শ্রেণির সহঅবস্থান করার মধ্যেই তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং এ পারস্পরিক সম্পর্ক থেকেই শাসক এবং শাসিত শ্রেণির অস্তিত্ব গড়ে উঠে।

দ্বিতীয়ত, তিনি এ পার্থক্যের জন্য পরিবেশগত কারণের উল্লেখ করেন।

সমাজবিজ্ঞানী মেরিল (Merill) সামাজিক স্তরবিন্যাসের সংজ্ঞায় বলেন, “Social stratification means that some groups receive more of the goods, services, power, emotional and gratification of the society than others.”* অর্থাৎ, কোন গোষ্ঠী যদি অন্যদের তুলনায় ভালো সুযোগ সুবিধা, চাকরি, ক্ষমতা ইত্যাদি বেশি মাত্রায় ভোগ করে তাই সামাজিক স্তরবিন্যাস।

Ogburn এবং Nimkoff এর মতে, “Social stratification is the process by which individuals and groups are ranked in more or less enduring hierarchy of status.”” অর্থাৎ, সামাজিক স্তরবিন্যাস হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে মানের ক্রমানুসারে সাজানো যায়।

অধ্যাপক মেলভিন টিউমিন সামাজিক স্তরবিন্যাসের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন,

“সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস বলতে আমরা এমন একটি সামাজিক ব্যবস্থাকে বুঝি যাতে একটি সামাজিক গোষ্ঠী, শক্তি, সম্পত্তি, সামাজিক মূল্য এবং মানসিক তুষ্টির তারতম্যের ভিত্তিতে ঊর্ধ্বার্ধ রীতিতে শ্রেণিবদ্ধ হয়।”

জন. এফ. কিউবার এবং উইলিয়াম এফ. কেনফেল তাঁদের ‘Social Stratification’ গ্রন্থে বলেন যে, “একের উপর অন্যের অধিকার স্থাপন করাকেই সামাজিক স্তরবিন্যাস বলে।”

টি. বি. মেয়রের মতে, “সামাজিক স্তরবিন্যাস হলো পরস্পরকে পৃথকীকরণের একটি পদ্ধতি। তিনি সে কালের পুরোহিতগণের সামাজিক মর্যাদা লক্ষ করে এক শ্রেণির সাথে অন্য শ্রেণির পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয় নিয়ে সামাজিক স্তরবিন্যাস আলোচনা করেন।”

সমাজবিজ্ঞানীদের উপর্যুক্ত সংজ্ঞার আলোচনা থেকে এ ধারণাই প্রতীয়মান হয় যে, সমাজস্থ ব্যক্তিগণ বিভিন্ন পর্যায়ে বিভক্ত। সাধারণত সমাজস্থ মানুষের এ পর্যায়ক্রম তিনটি ভাগে লক্ষ করা যায়; যথা:

প্রথমত, অর্থনৈতিক দিক থেকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, কার্ল মার্কস সমাজের স্তরবিন্যাসের ক্ষেত্রে এ দিকটির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

দ্বিতীয়ত, মর্যাদার দিক থেকে। কারণ কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, অর্থনৈতিক দিক ছাড়াও কোন কোন শ্রেণি যে বিশেষ মর্যাদা ভোগ করে অন্য শ্রেণিভুক্ত লোকের পক্ষে তা সম্ভব নয়।

তৃতীয়ত, ক্ষমতার দ্বারা শ্রেণি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা।

সামাজিক স্তরবিন্যাসের প্রকারভেদ

সামাজিক স্তরবিন্যাস নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। আমরা সংক্ষেপে বলতে পারি যে, সামাজিক স্তরবিন্যাস মানে সমাজের মধ্যে পরস্পর পরস্পরের ব্যবধান; যা বিশেষভাবে আভিজাত্য, যশ ও ক্ষমতার দ্বারা নিরূপণ করা হয়।

সমাজের মধ্যে শ্রেণি বা স্তর যা আভিজাত্য, যশ ও ক্ষমতার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত তা সর্বজনীন সমাজকাঠামোতে পরিলক্ষিত হয়। এটা বিভিন্ন সমাজব্যবস্থায় বিভিন্নভাবে ক্রিয়াশীল। সেজন্য আমরা বলতে পারি যে, সামাজিক স্তরবিন্যাস প্রকৃতপক্ষে ন্যায়- অন্যায় ও বিচার দ্বারা নিরূপণ করা যায় না। কারণ সকল সমাজব্যবস্থায় সামাজিক মূল্যবোধ সর্বক্ষেত্রে একই রকম দেখা যায় না। আবার অর্থনৈতিক দিক থেকেও সকল সমাজ সমপর্যায়ে নেই।

সংক্ষেপে বলা যায় যে, সামাজিক স্তরবিন্যাসের বৈশিষ্ট্য সকল সমাজে সমান নয়। বিভিন্ন দেশে এর তারতম্য লক্ষণীয়; যেমন- শিল্পোন্নত বা উন্নয়নশীল দেশে সামাজিক অবস্থা অনুন্নত দেশের সামাজিক অবস্থার সাথে সমতুল্য নয়। সেহেতু সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের মূল্য অনুসন্ধান কষ্টসাপেক্ষ। কারণ বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন শ্রেণির উৎপত্তি বিভিন্ন কারণে হয়েছে; যেমন- আদিম সমাজে দেখা যায় যে, যে ব্যক্তি যাদুবিদ্যায় পারদর্শী বা যে অধিক শক্তিশালী, বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী, সে ব্যক্তি সমাজে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। আবার কোন কোন সমাজে পুরোহিতগণকে সর্বাপেক্ষা উচ্চ শ্রেণির লোক বলে মর্যাদা দেয়া হতো। কিন্তু আধুনিক উন্নত সমাজব্যবস্থায় এসব মূল্যায়নের পরিবর্তন ঘটেছে।

বর্তমান যুগে দেখা যায় যে, ব্যক্তি কর্তৃক অর্জিত গুণাবলি, অর্থনৈতিক অবস্থা এবং ক্ষমতার দ্বারা শ্রেণি কর্তৃত্ব লাভ করা যায়। সামাজিক অবস্থার এরূপ তারতম্যের পরিপ্রেক্ষিতে কার্ল মার্কস স্তরবিন্যাসকে অর্থনৈতিক, ম্যাক্স ওয়েবার স্তরবিন্যাসকে শ্রেণি মর্যাদা ও ফল, ফার্ডিনান্ড টনিস শ্রেণিভেদকে শ্রেণি ও ঐতিহ্য, থর্মটেইন ভেবলীন শ্রেণিভেদকে শ্রেণি অবকাশ এবং ভেলফ্রেডো পেরেটো শ্রেণিভেদকে উচ্চমানের ব্যক্তি প্রবাহ বা ‘Circulation of Elite’ এর উপর গুরুত্ব আরোপ করে সামাজিক স্তরবিন্যাসের সংজ্ঞা নির্ণয় করেছেন।

Related Posts