বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র সমাজের ভূমিকা অপরিসীম। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৬২ ও ৬৪ সালের শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ৬৬ সালের ৬ দফা, ৬৮ সালের ১১ দফা, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর নির্বাচন এবং সবশেষ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশের ছাত্র সমাজ যে ভূমিকা পালন করেছেন এক কথায় তা অসাধারণ। আজকের আর্টিকেলে মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র সমাজের গৌরবময় ভূমিকার কথা রচনা বা প্রবন্ধ আকারে তুলে ধরা হবে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র সমাজের ভূমিকা
সূচনা
১৯৭১ সাল। বাঙালির জীবনে নেমে এসেছিল এক দীর্ঘ অন্ধকার। পাকিস্তানী শোষক বাহিনীর হাতে বাংলা-মা তখন আক্রান্ত। আর বাঙালি তাকে মুক্ত করার মরণপণ সংগ্রামে নিয়োজিত। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে, তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আর দুই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন সার্বোভৌম দেশ হিসেবে নিজের আসন প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়। পাকিস্তানী অপশক্তির শোচনীয় পরাজয় ঘটে বাংলার দামাল ছেলেদের কাছে; বিজয়ের গর্বে বাঙালি বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়।
মুক্তিযুদ্ধের বিবরণ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কতিপয় দেশদ্রোহী রাজাকার ছাড়া তাতে অংশ গ্রহণ করেছিল এ-দেশের আপামর জনগণ। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ছিল সেনাবাহিনীর সদস্য, পুলিশ বাহিনীর সদস্য, কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষ আর এ-দেশের সদাজাগ্রত ছাত্রসমাজ। ছাত্র-সমাজের সর্বাত্মক অংশগ্রহণের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ পেয়েছিল নতুন মাত্রা। তারা দেশের ভেতরে এবং দেশের বাইরে থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে পরাশক্তির হাত থেকে বাংলা মায়ের মুক্তিকে ত্বরান্বিত ও সুনিশ্চিত করেছিল। তাই আমাদের মুক্তি সংগ্রামে ছাত্র-সমাজের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে তা সর্বজনবিদিত ও সর্বস্বীকৃত।
মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রদের অংশগ্রহণ
স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়েই কেবল বাঙালি তার স্বাধীন জাতিসত্ত্বাকে খুঁজে পায়নি। তার মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস সুদীর্ঘকালের। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ দেশের ছাত্র সমাজই প্রথম সত্যিকারভাবে অনুধাবন করে যে পাকিস্তানিরা ভিন্ন জাতিসত্তার অধিকারী হবার কারণে তাদের সঙ্গে সহাবস্থান অসম্ভব। ছাত্রসমাজ তাদের মেধা, প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা দিয়ে সত্যকে অনুধাবন করেছিল, বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগ্রাম ও আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ-দেশের বৃহত্তর জনসাধারণের মধ্যে তা সঞ্চারিত করেছিল। তাদের নিরন্তর প্রচেষ্টার মাধ্যমেই এ-দেশের মানুষ তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া নানা প্রকার পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ-আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হয়। আর বাঙালি তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ক্রমাগত সংঘবদ্ধ হতে থাকে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এ-জাতির বিভিন্ন দুঃসময়ে যে একত্র ও সংঘবদ্ধ হতে পেরেছিল তার মূল প্রেরণাই ছিল এ-দেশের ছাত্র-সমাজ। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোল, আইয়ুবী শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, ১৯৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি পর্যায়েই ছাত্র সমাজ পালন করেছে গুরুত্বপূর্ণ ও গৌরবজনক ভূমিকা। বস্তুতপক্ষে বাঙালি জাতির প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে ছাত্র সমাজের যে অগ্রণী ভূমিকা ছিল তার থেকেই অনুমান করা যায় মুক্তিযুদ্ধের মত একটি মহান সংগ্রামে এ-দেশের ছাত্রসমাজ কতটা শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেছিল।
আরও পড়ুন: সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রচনা
মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র সমাজের প্রত্যক্ষ ভূমিকা
এ দেশের ছাত্র-সমাজ মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি নির্মাণে ও দেশবাসীকে একত্র করার কাজেই বিভিন্ন সময় নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করেনি বরং মুক্তি সংগ্রামেও অস্ত্রহাতে নিয়ে, জীবনের মায়াকে তুচ্ছ করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ছাত্র-সমাজের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণই বাংলাদেশের বিজয়কে সুনিশ্চিত করেছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পাকিস্তানি নরপশুরা যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল তার প্রথম শিকার হয়েছিল এ-দেশের ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী। পাকিস্তানিরা বুঝতে পেরেছিল বাঙালি জাতির মূল শক্তির উৎস হচ্ছে এ-দেশের ছাত্র সমাজ, ফলে তাদের প্রথম টার্গেট হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরি বিভিন্ন ছাত্রাবাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলোতে সশস্ত্র হামলা চালিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল তা মনে পড়লে এ-দেশের প্রতিটি মানুষই ভয়ে আতঙ্কে শিউরে ওঠে।
মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র সমাজের অবদান
বাংলাদেশের সচেতন ছাত্র সমাজ পাকিস্তানি নরপশুদের এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ মেনে নেয়নি কোন ভাবেই। তারা হতের কলম ফেলে জাতির বৃহত্তর প্রয়োজনে তুলে নেয় অস্ত্র। ছড়িয়ে পড়ে এদেশের গ্রামেগঞ্জে। বিপুল সংখ্যক ছাত্র মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের জন্যে চলে যায় প্রতিবেশী রাষ্ট্রে। প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মুক্তিবাহিনী হিসেবে ছাত্ররা পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরদ্ধে নিজেদের সংঘবদ্ধ করে গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে থাকে। অসংখ্য ছাত্র মুক্তিসেনা দেশের বিভিন্ন অংশে হামলা চালিয়ে বিস্তীর্ণ এলাকা শত্রুমুক্ত করে। এভাবে সামনা-সামনি ও গেরিলা যুদ্ধের তীব্রতায় পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। অবশেষে তারা সম্মিলিত মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। ছাত্র-সমাজের অংশ গ্রহণ না হলে এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সাফল্য মন্ডিত হতে পারতো না। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত গঠনেও ছাত্র সমাজের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে স্বীকার করতে হবে। বস্তুতপক্ষে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে ছাত্র সমাজের যে অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে তার কোন তুলনা নেই।
উপসংহার
আমাদের দেশের সব আন্দোলনে ছাত্র সমাজই অগ্রণী, সচেতন ও প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা অসীম সাহসিকতা ও দৃঢ়তা নিয়ে দেশের মুক্তি সংগ্রামের ডাকে সাড়া দিয়েছে। তাদের ত্যাগের কোন তুলনা নেই। ছাত্র সমাজের তারণ্যমাখা অদম্য শক্তিই ছিল বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের বড় ভরসা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র সমাজের ভূমিকা যে সদর্থক চেতনার স্বাক্ষর রেখেছিল তার প্রেরণা নিয়েই তাদের ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। তবেই মুক্তিযুদ্ধের প্রতি প্রকৃত সম্মান দেখানো হবে।