বাংলাদেশের সামাজিক উৎসব
ভূমিকা
বিশেষ উপলক্ষ্যকে কেন্দ্র করে আনন্দময় কোনো অনুষ্ঠান পালন করাকেই মূলত উৎসব বলে। বাংলাদেশের কিংবা বাঙালির রয়েছে বৈচিত্র্যময় বিভিন্ন ধরনের উৎসব। এগুলো বাংলার তথা বাঙালির সামাজিক উৎসব, প্রাণের উৎসব। এসব উৎসব প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্য বহন করে। মানুষকে দৈনন্দিন জীবনের সংকীর্ণ গণ্ডি থেকে মিলনের বৃহত্তর আসরে মিলিত করে এসব উৎসব। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল যথার্থই বলেছেন, “মানুষ স্বভাবতই আসঙ্গলিপ্স।” সুতরাং মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করবে এটাই নিয়ম। আর এই সমাজবদ্ধ মানুষের কর্মব্যস্ততা তাদের জীবনকে কুক্ষিগত করে রাখে। কর্মব্যস্ততার মাঝে মানুষ কখনো কখনো স্বস্তি চায়। বিভিন্ন সামাজিক উৎসব মানুষের জীবনে সেই স্বস্তি এনে দেয়।
অন্যান্য রচনা:
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প রচনা | বাংলা রচনা পোশাক শিল্প
যুদ্ধ নয় শান্তি চাই রচনা | বাংলা রচনা
উৎসবের বিভিন্নতা
সমাজবদ্ধ মানুষ একত্রিত হয়ে সাড়ম্বরপূর্ণ উদ্যোগে যে অনুষ্ঠানটি পালন করে তাই উৎসব। এ উৎসবের রয়েছে বিভিন্নতা। বিভিন্নতার ভিত্তিতে উৎসবকে কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়।
১. ব্যক্তিগত উৎসব: ব্যক্তিকেন্দ্রিক উৎসব একান্তই ব্যক্তির নিজস্ব ব্যাপার হলেও এ ধরনের অনুষ্ঠানে সমাজের ক্ষুদ্রতম একটি অংশের অংশগ্রহণ থাকতে পারে। তবে এতে ব্যক্তির স্বতন্ত্র চিন্তা-চেতনা এবং রুচি প্রাধান্য পায়। এ ধরনের উৎসব সর্বজনীন নয়। জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী এবং যেকোনো ঘরোয়া অনুষ্ঠান এ উৎসবের অন্তর্ভুক্ত।
২. সামাজিক উৎসব: এ উৎসব মূলত সর্বজনীন। সমাজের সবাই একত্রে এ উৎসব পালন করে। সাধারণত যে উৎসব একটি জনগোষ্ঠী বা দেশের মানুষ সবাই মিলে একত্রে পালন করে তাকে সামাজিক উৎসব বলে। বিয়ে, নববর্ষের অনুষ্ঠান ও মেলা, বইমেলা, পৌষমেলা, বসন্ত উৎসব ইত্যাদি সামাজিক উৎসবের আওতাধীন।
৩. জাতীয় উৎসব: এ উৎসবও সর্বজনীন। এটি দেশের সর্বস্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালন করে। জাতীয় জীবনে সংঘটিত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা স্মরণ করে এ উৎসব পালন করা হয়। যেমন- ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবস এবং ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস আমাদের জাতীয় উৎসব। আবার নববর্ষেরও যেমন- সামাজিক দিক রয়েছে, তেমনি এটি জাতীয় উৎসব হিসেবেও পালন করা হয়।
৪. ধর্মীয় উৎসব: ধর্মীয় উৎসবগুলো সম্প্রদায়ভিত্তিক। পৃথিবীতে বিভিন্ন ধর্ম এবং ধর্মাবলম্বী মানুষ আছে। সকল ধর্মাবলম্বীই তাদের রীতি অনুযায়ী যার যার ধর্মীয় উৎসব পালন করে থাকে। যেমন- মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, ঈদে মিলাদুন্নবী, শবেবরাত, মহররম ইত্যাদি। হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব হচ্ছে দুর্গাপূজা, কালীপূজা, লক্ষ্মীপূজা, সরস্বতী পূজা, দোলপূর্ণিমা ইত্যাদি। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব বৌদ্ধপূর্ণিমা, মাঘী পূর্ণিমা, ভাদ্র পূর্ণিমা ও আশ্বিনী পূর্ণিমা। খ্রিস্টানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব হলো ক্রিসমাস ডে, ইস্টার সানডে ইত্যাদি। সকল সম্প্রদায়ের লোকই বেশ আনন্দের সাথে তাদের ধর্মীয় উৎসব পালন করে।
বাঙালির সামাজিক উৎসব
প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি জাতি আনন্দপ্রিয় এবং মনের দিক থেকে বাঙালি উৎসবপ্রিয়। সময় পেলেই বাংলার মানুষ নানারকম উৎসবে মেতে ওঠে। বাংলাদেশের অতীত ইতিহাস উৎসব সমৃদ্ধ। অতীতে মানুষ সুখে-শান্তিতে বাস করত, তাদের আর্থিক সচ্ছলতা ছিল। ছিল গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ, কিন্তু বাঙালির আর্থিক সচ্ছলতা এখন অনেকটাই স্তিমিত। তবুও বাঙালির উৎসব এখনো চলমান। মূলত বাংলাদেশের সামাজিক উৎসব গুলো হলো অফুরন্ত আনন্দের ঝরনাধারা। বলা বাহুল্য উৎসব মানেই উৎসাহ, উৎসাহ মানেই উদ্দীপনা। বাঙালির সামাজিক উৎসবের মাঝে সেই উদ্দীপনাই খুঁজে পাওয়া যায়। উৎসবগুলোতে আনন্দই মুখ্য এবং আনন্দই এর প্রাণ। গানবাজনা, হাসি-আনন্দ ছড়িয়ে দিয়ে সকল স্তরের মানুষ উৎসবের অনুষ্ঠানকে প্রাণবন্ত করে তোলে। তাই বাংলার সামাজিক উৎসবগুলো বাঙালির প্রাণের কথা বলে, বাঙালির প্রাণোচ্ছ্বাসে অনুরণিত হয়।
বাংলা নববর্ষ
বাঙালির সবচেয়ে বড়ো ও বৈচিত্র্যময় সামাজিক উৎসব হলো বাংলা নববর্ষের উৎসব। নববর্ষকে বরণ করে নিতে গোটা দেশেই সাজসাজ রব পড়ে যায়। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে বাংলা নববর্ষের উৎসব পালনে মেতে ওঠে এবং নববর্ষ বাঙালির প্রাণের উৎসব। বাংলার আবহমান সাংস্কৃতিক চেতনার ধারক ও বাহক এ দিনটি। পূর্বে গ্রামীণ বাংলায় পুণ্যাহ, বৈশাখী মেলা, হালখাতা ইত্যাদি নানা আয়োজনের ব্যবস্থা থাকত। বর্তমানে কালের বিবর্তনে এর অনেকগুলো হারিয়ে গেলেও হালখাতা, মেলা ইত্যাদি এখনো এ উৎসবের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। গ্রামীণ সংস্কৃতির আদলে শহরেও উদ্যাপিত হয় এই দিনটি। এসবের বাইরে শহরের অন্যান্য আয়োজনের মধ্যে থাকে বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা, সংগীতের বা আবৃত্তির আসর, আলোচনা সভা ইত্যাদি। সব মিলিয়ে বাঙালির বৃহত্তম মিলনমেলা রচনা করে পহেলা বৈশাখের উৎসবটি।
একুশের বইমেলা
একুশে ফেব্রুয়ারির সংগ্রামী চেতনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য পুরো ফেব্রুয়ারি জুড়েই আয়োজন করা হয় নানা অনুষ্ঠানের। একুশের বইমেলা তারই অন্যতম একটি আয়োজন। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে পুরো মাস জুড়ে চলে এ মহা আয়োজন। এ মেলা বইপ্রেমী মানুষ, প্রকাশক, লেখকসহ বরেণ্য ব্যক্তিবর্গের মিলনমেলায় পরিণত হয়। এই মেলা আমাদের মাঝে সাহিত্য-সংস্কৃতিবোধ জাগ্রত করে এবং জাতীয় চেতনাকে শাণিত করে।
জাতীয় দিবসসমূহ উদযাপন
নানা জাতীয় দিবসে আনন্দ আয়োজনে ভরে ওঠে দেশ। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস ইত্যাদিতে জাতীয় স্মৃতিসৌধসহ স্থানীয় স্মৃতি স্থাপনাগুলোতে মানুষের ঢল নামে। সশস্ত্র বাহিনী আয়োজন করে কুচকাওয়াজ প্রদর্শনীর। বিভিন্ন স্থানে মেলা বসে, বের হয় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। এ দিবসগুলোয় গোটা জাতির সম্মিলন দেশের সংগ্রামী ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের সচেতন করে তোলে এবং দেশপ্রেমের ভিত্তিকে মজবুত করে।
অন্যান্য উৎসব
এই উৎসবগুলোর বাইরেও ছোটো-বড়ো নানা উৎসবে সারা বছর মুখরিত থাকে এ দেশ। এর মধ্যে গ্রামভিত্তিক নবান্ন উৎসব, চৈত্রসংক্রান্তি উৎসব, ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। শহরে উদ্যাপিত আরও উৎসবের মধ্যে রয়েছে শরৎ উৎসব, পৌষ মেলা, পিঠা উৎসব, কবিতা বা নাট্য উৎসব, বিশিষ্ট শিল্পীদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন উপলক্ষ্যে উৎসব, ঘুড়ি উড়ানো উৎসবসহ নানা ধরনের বৈচিত্র্যপূর্ণ আয়োজন। সব মিলিয়ে গোটা বাংলাদেশ যেন আনন্দ- উৎসবের তীর্থভূমি।
উৎসবের প্রয়োজনীয়তা ও জাতীয় জীবনে এর প্রভাব
মানুষের চিত্তাকর্ষের জন্য প্রয়োজন বিনোদন। কাজের মাঝেই মানুষ বেঁচে থাকে। আর এই বেঁচে থাকার জন্যই মানুষের জীবনে আনন্দ-উৎসবের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সেই সনাতনকাল থেকেই বিভিন্ন ধরনের উৎসব বাঙালির সমাজজীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গরূপে পরিগণিত হয়ে আসছে। সবুজ-শ্যামল আমাদের এই বাংলাদেশ গানের দেশ, প্রাণের দেশ, উৎসবের দেশ। এখানে বারো মাসে তেরো পার্বণ হয়। বিচিত্র উৎসবে ভরে ওঠে মানুষের জীবন। আর এই উৎসবের প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়ে ক্লান্তিময় নাগরিক জীবন অনাবিল এক শান্তির পরশ পায়। মানুষের ব্যস্তময় জীবন, নিষ্প্রাণ ও হতাশাগ্রস্ত জীবনের গতিতে যেন হঠাৎ প্রাণের সঞ্চার ঘটে উৎসবগুলোর মধ্য দিয়ে। সামাজিক উৎসব মানুষের মনে প্রসন্নতা আনে, ক্লান্তির, অবসান ঘটায় এবং মানুষকে পৌছে দেয় উদার মানসলোকের উন্মুক্ত দ্বারপ্রান্তে। বছরান্তে চক্রাকারে ফিরে আসা একেকটি উৎসব বাঙালি জাতিকে সহমর্মিতায় ঐক্যবদ্ধ করে, অতীত ঐতিহ্যকে ধারণ করে গর্বিত হতে শেখায়, স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে আত্মসচেতন করে তোলে, পৃথিবীর বুকে স্বাধীন, সার্বভৌম জাতি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে উদ্দীপ্ত করে এবং আত্মপ্রত্যয়ে প্রত্যয়ী করে তোলে। সুতরাং চিত্তের বিকাশে এবং প্রসন্নতার জন্য মানুষের ব্যক্তিজীবনে ও জাতীয় জীবনে উৎসবের গুরুত্ব অত্যাবশ্যকীয়।
উপসংহার
উৎসবের আনন্দ মানুষের সহজাত। কারণ এটা মানুষের অন্তরে স্থিত। তাই শত কর্মব্যস্ততার মাঝে মানুষ উৎসবের দিনগুলোতে এক অনাবিল সুখানুভূতির মধ্য দিয়ে নিজেকে বিলীন করে নতুনভাবে কর্মপ্রেরণা লাভ করে থাকে। আধুনিক সময়ে বাংলাদেশের সামাজিক উৎসব গুলোর ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয় কিছু নেতিবাচক দিক। অনেক আয়োজনেই মুখ্য হয়ে ওঠে বাণিজ্যিক স্বার্থসিদ্ধির বিষয়টি। অপসংস্কৃতির প্রভাবে অনেক উৎসবই হারিয়েছে তার চিরচেনা রং। এতে মানুষের স্বাভাবিক আনন্দের অনুভূতিতে বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। তারপরও বাংলাদেশের সামাজিক উৎসব গুলো একাধারে যেমন বাঙালির চিন্তা-চেতনার স্রোতকে অব্যাহত রেখেছে, তেমনি এগুলো বাংলার মানুষের ঐতিহ্য, ধর্মবোধ ও সামাজিক একাত্মতাকে যুগ যুগ ধরে অটুট ও অক্ষুণ্ণ রেখেছে। তাই সামাজিক জীবনে সবাই যেন এসব উৎসবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়ে আনন্দ উপভোগ করতে পারে, সে বিষয়ে সকলের সহযোগিতাই কাম্য।