ভূমিকা
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রকাশ পায় এমন একটি গানের প্রথম ছয়টি লাইন হলো-
মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি
মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি।
যে মাটির চির মমতা আমার অঙ্গে মাখা
যার নদী জলে ফুলে ফলে মোর স্বপ্ন আঁকা
যে নদীর নীল অম্বরে মোর মেলছে পাখা
সারাটি জীবন সে মাটির গানে অস্ত্র ধরি।
——————– গোবিন্দ হালদার
বাঙালিদের জাতীয় জীবনে তথা বাংলাদেশের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্ব অপরিসীম। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা একটি বলিষ্ঠ চেতনা এবং আত্মপ্রত্যয়ের দৃঢ় অঙ্গীকার। প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী বলেছেন, “আলোক ব্যতীত যেমন পৃথিবী জাগে না, স্রোত ব্যতীত যেমন নদী টিকে না, স্বাধীনতা ব্যতীত তেমনি জাতি কখনো বাঁচিতে পারে না।” বাংলাদেশের মানুষও নদীর স্রোতের মতো চিরন্তন সত্যের পথ ধরে ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতার কাঙ্ক্ষিত সূর্যকে। তিরিশ লাখ প্রাণের বিনিময়ে এদেশবাসী যে স্বাধীনতা অর্জন করেছেন তাকে চির সমুন্নত রাখতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আবহমানকাল ধরে প্রেরণা যোগাবে।
অন্যান্য রচনা:
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ রচনা ৫ম শ্রেণি (৭৫০ শব্দ) | SSC | HSC
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর রচনা | রচনা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র সমাজের ভূমিকা রচনা/প্রবন্ধ
মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি
স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা যে গৌরববোধ করি, এ গৌরব অর্জনের পেছনে এক ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ইতিহাস বিদ্যমান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পরিস্থিতি একদিনে সৃষ্টি হয় নি। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের কবল থেকে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পরও পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের মানুষ তাদের অধিকার ফিরে পায় নি। পরিবর্তন আসে নি বাঙালিদের জীবনে। ব্রিটিশের পর পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসকদের উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল বাংলাদেশ। তারা প্রথম আঘাত হানে বাঙালিদের মাতৃভাষার ওপর। সমগ্র পাকিস্তানে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার পরও বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু পশ্চিমা শাসকের একপেশে সিদ্ধান্ত আর বৈরী আচরণকে বাঙালিরা মেনে নিতে পারে নি। এর প্রতিবাদে তারা রাজপথে আসে। শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। ঢাকার রাজপথ প্রকম্পিত হয়। ক্রমে ক্রমে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন।
তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার পর নতুন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন খাজা নাজিমউদ্দীন। ১৯৫২ সালের ৩০ জানুয়ারি তিনি ঢাকায় এসে পূর্বসূরিদের অনুসরণে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর কথাই বললেন। ফলে ভাষা আন্দোলন আরও জোরদার হয়ে এক তুমুল গণআন্দোলনে রূপলাভ করে। ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে মিছিল, মিটিং, শোভাযাত্রা ইত্যাদি নিষিদ্ধ করে এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। ছাত্র- জনতা তাও মেনে নেয় নি। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বাঙালি ছাত্র-জনতা মিছিল নিয়ে রাজপথে নামে। মিছিলের ওপর পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে নিহত হন রফিক, জব্বার, সালাম, বরকতসহ আরও অনেকে। এ পথ ধরেই বাঙালিরা তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নামে। ১৯৬৯ সালে আবারও এক মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। এ পর্যায়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের পতনের পর ক্ষমতায় আসেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। ক্ষমতায় আসার অল্পকালের মধ্যেই সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করলেন তিনি।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বাঙালিদের বিজয় হলেও ক্ষমতা দেওয়া হলো না। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে শুরু হলো অসহযোগ আন্দোলন। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করতে থাকলে বাংলাদেশ এগিয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের দিকে। এদেশের মানুষের মনে দানা বেঁধে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। ২৫ মার্চ রাতে ঘুমন্ত বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড চলে এবং ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা হওয়ার পর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
পাকিস্তানি শাসনামলে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে বাঙালিদের ওপর শাসনের নামে শোষণ নির্যাতন চালায়। ফলে স্বৈরাচারী শাসকদের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ১৯৭১ সালে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম। মুক্তিযুদ্ধ ছিল সকল শ্রেণির বাংলাদেশী মানুষের আদর্শ এবং নতুন দিনের পথপ্রদর্শক। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আজও মিশে আছে আমাদের জীবনে, আমাদের সাহিত্যে, সংগীতে, শিল্পকলায়, স্থাপত্যে আর ভাস্কর্য শিল্পে। মিশে আছে আমাদের সংস্কৃতিতে। একে আমরা প্রতিবছর অনুভব করি স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবস ইত্যাদি স্মরণীয় দিবসের মধ্য দিয়ে। বহু আত্মত্যাগের বিনিময়ে ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয়েছে আমাদের বিজয়ের দিন। সফলতা পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলন
আমাদের নানা কর্মকাণ্ডে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিকাশ এবং প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবস ইত্যাদি পালনের মধ্যেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলন ঘটে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুজ্জ্বল রাখার জন্য গড়ে তোলা হয় নানা ভাস্কর্য। মুক্তিযুদ্ধ যাতে বাংলাদেশের মানুষের কাছে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকে, সেজন্য নানা ধরনের ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়।
সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ, মুজিবনগরের স্বাধীনতা ঘোষণার স্মৃতিস্তষ্ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে অপরাজয়ে বাংলা, রোকেয়া হলের পূর্ব পাশে অবস্থিত ভাস্কর্য, গাজীপুরের চৌরাস্তায় নির্মিত ভাস্কর্য ইত্যাদিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিফলিত হয়েছে। ঢাকার সেগুন বাগিচায় গড়ে তোলা হয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর’। এখানে সংগৃহীত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য স্মৃতি এবং উপকরণ। এসব স্মৃতি উপকরণ পরবর্তী প্রজন্মের মনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলন ঘটাবে।
বাংলা সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
বাংলাদেশের সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিফলিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। মুক্তিযুদ্ধের করুণ কাহিনী আর বীরত্বগাথা দিয়ে রচিত হয়েছে গল্প, উপন্যাস, নাটক, সঙ্গীত, প্রবন্ধ এবং অসংখ্য কবিতা-ছড়া। মাহবুবুল আলমের ভাষায়, “যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের উপন্যানে মুক্তিযুদ্ধের যথেষ্ট প্রতিফলন লক্ষণীয়। স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিতে এখানকার জীবনে যে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল তা প্রত্যক্ষদর্শী ঔপন্যাসিকগণ উপেক্ষা করতে পারেন নি। তাই এখানকার উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের চিত্রাঙ্কনের সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধোত্তর কালের জীবনের রূপায়ণেরও নিদর্শন প্রকাশিত হচ্ছে।” শওকত ওসমানের ‘দুই সৈনিক’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘নীলা দংশন’, রাবেয়া খাতুনের ‘মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী’, আনোয়ার পাশার ‘রাইফেল রোটি আওরাত’, রিজিয়া রাহমানের ‘রস্তের অক্ষর’, সেলিনা হোসেনের ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’, ইমদাদুল হক মিলনের ‘মহাযুদ্ধ’, শিরীন মজিদের ‘অপু বিজয় দেখেনি’ প্রভৃতি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস। শওকত ওসমানের ‘জন্য যদি তব বঙ্গে’ গ্রন্থের সবগুলো গল্পই রচিত হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিত গল্প’ সংকলন। কল্যাণ মিত্রের ‘জল্লাদের দরবার’ নাটক মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। বাংলাদেশের প্রবীণ এবং নবীন প্রায় সকল কবির হাতেই সৃষ্টি হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের কবিতা। জন্ম হয়েছে সাহিত্যের নতুন স্রোতধারা। এদিক থেকে যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তাঁদের মধ্যে পল্লিকবি জসীমউদ্দীন, সুফিয়া কামাল, আহসান হাবীব, সিকান্দার আবু জাফর, শামসুর রাহমান, জাহানারা আরজু, হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আল মাহমুদ, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, সৈয়দ শামসুল হক, ফজল শাহাবুদ্দীন, মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, আসাদ চৌধুরী, হুমায়ুন আজাদ, মুহম্মদ নূরুল হ্রদা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জসীমউদ্দীনের ‘সপ্তগ্রাম’ আহসান হাবীবের ‘মার্চ’, সিকান্দার আবু জাফরের বাঙলা ছাড়ো’, আলাউদ্দিন আল আজদের ‘মুক্তিযোদ্ধা’, ফজল শাহাবুদ্দীনের ‘বাংলাদেশ একাত্তরে’, মহাদেব সাহার ‘একজন মুক্তিযোদ্ধার ডায়রী’, আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘মুক্তিযুদ্ধ’, হুমায়ুন আজাদের ‘মুক্তিবাহিনীর জন্যে’ প্রভৃতি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে রচিত উল্লেখযোগ্য কবিতা।
সমাজ-বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
বাংলাদেশের মানুষের যে স্বপ্ন আর আকাঙ্ক্ষার মানসে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, প্রকৃতপক্ষে সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন হয় নি। স্বাধীনতার পর বারবার সরকার বদল, হত্যা আর রক্তপাতের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখল, দেশি ও বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী তৎপরতা, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য, খুবসমাজে সৃষ্ট হতাশা, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, ঘুষ, দুর্নীতি ইত্যাদি কারণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমাজে বাস্তবায়িত হতে দেয় নি। সত্যিকার অর্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রয়োজন দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে আন্তরিক পদক্ষেপ। এ লক্ষ্যে দুর্নীতিমুক্ত কল্যাণকর শাসনব্যবস্থা যেমন প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত গৌরবগাথা আর আত্মত্যাগের সঠিক ইতিহাস ভবিষ্যৎ প্রজন্যের কাছে তুলে ধরা। যে আদর্শ, উদ্দেশ্য ও চেতনা নিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ তাদের তাজা প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছে, ইজ্জত দিয়েছে হাজার হাজার মা-বোন, আমাদের সমাজ এবং জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের সেই আদর্শ ও চেতনাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে-এটিই আমাদের অঙ্গীকার হওয়া উচিত।
উপসংহার
মুক্তিকামী বিপ্লবী বাঙালি জনমানসে শৃঙ্খল ভাঙার চেতনা জাগ্রত হয়। আর তারই পথ ধরে বাঙালি ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতার সোনালি সূর্য। তবে এ স্বাধীনতা পূর্ণাঙ্গ নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে আমাদেরকে অর্জন করতে হবে অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা। তবেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা হবে গৌরবময়।