সামাজিক স্তরবিন্যাসের বৈশিষ্ট্য
ইতিহাস পর্যালোচনার মাধ্যমে জানা যায় যে, সামাজিক স্তরবিন্যাসের বৈশিষ্ট্য এক নয়। বিভিন্ন সমাজের মধ্যে বিভিন্নতা এবং পার্থক্য লক্ষ করা যায়। কারণ বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন শ্রেণি বা স্তরের উৎপত্তি ভিন্ন ভিন্ন কারণে হয়েছে। সমাজের বিভিন্ন কাজকর্মে নিযুক্ত ব্যক্তিবর্গের শ্রেণিবিন্যাসের পরিপ্রেক্ষিতে এন. এন. টিউমিন সামাজিক স্তরবিন্যাসের কতকগুলো বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন নিম্নে টিউমিনের সামাজিক স্তরবিন্যাসের বৈশিষ্ট্য গুলো আলোচনা করা হলো:
১. স্তরবিন্যাস হলো সামাজিক
সামাজিক স্তরবিন্যাস হলো মানবিক সম্পর্কের স্ত অবিন্যাস, এর কোন তাৎপর্য নেই। এ স্তরবিন্যাস সামাজিক মান ও রীতির নিয়ামক। গামাজিক মান বা রীতি সামাজিক স্তরবিন্যাসের মাধ্যমে পুরুষানুক্রমে সঞ্চারিত হয়। এটি সত্য যে, শক্তি, বুদ্ধিমত্তা, বয়স এবং লিঙ্গ অনেক সময় মর্যাদা ও সামাজিক অসমতার বা ব্যবধান নির্ণয়ের কারণ হয়। কিন্তু এ সকল ক্ষেত্রে সামাজিক মান বা ভেদাভেদ নির্ণয়ে – যথেষ্ট নয়। জৈবিক প্রলক্ষণগুলো দ্বারা সমাজস্থ মানুষের পদমর্যাদার গুরুত্ব তখনই নির্ণীত হয় যখন সামাজিকভাবে সমাজের সদস্যবৃন্দের বিচারে তা গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার তাঁর মর্যাদায় আসীন হন – তাঁর বিশেষ বুদ্ধিমত্তা, শিক্ষা ও উপযুক্ততা যাচাইয়ের মাধ্যমে, শারীরিক শক্তি বা বয়সের – মাধ্যমে নয়। তাঁর শিক্ষা, দক্ষতা, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ব্যক্তিত্ব তাকে সমাজের বিশেষ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। অতএব সামাজিক স্তরবিন্যাসের ক্ষেত্রে সমাজস্থ মানুষের মূল্যবোধ – ক্রিয়াশীল। অর্থাৎ সমাজস্থ মানুষের মনোভাব, অনুমোদন বা মূল্যায়নই স্তরবিন্যাসের ভিত্তি। সেজন্য এর অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সামাজিক।
সামাজিক স্তরবিন্যাস কি | সামাজিক স্তরবিন্যাস কাকে বলে |
২. সামাজিক স্তরবিন্যাস সর্বজনীন
সর্বযুগে সর্বকালে সর্বজনীন সামাজিক কাঠামোরই স্বাভাবিক রূপ হচ্ছে সমাজের স্তরবিন্যাস। সমাজবিজ্ঞানী সরোকিন তাঁর ‘Social Mobility’ নামক গ্রন্থে বলেছেন যে, সকল স্থায়ী সমাজেই মানুষের বিভিন্ন সামাজিক স্তর রয়েছে। সুদূর অতীতে সমাজ যেমন গড়ে উঠেছিল আত্মরক্ষার তাগিদে, পরস্পর সহযোগিতা, নিয়মকানুন ও শৃঙ্খলা প্রভৃতির প্রয়োজনে, তেমনি সমাজের স্ত রবিন্যাসের সৃষ্টি হয়েছিল- সম্পদ, ক্ষমতা, পেশা, ব্যক্তিগত গুণাবলি প্রভৃতিকে আশ্রয় করে সংগঠনের ভিত্তিতে সমাজের বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিদের টিকে থাকার প্রয়োজনে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, প্রাচীন রোমান সমাজে রাজা, অভিজাত, দার্শনিক, বড় ব্যবসায়ী, বৃহৎ জমির মালিক, প্রজাগণ এবং সৈনিক পুরুষরা ছিল উচ্চ শ্রেণিভুক্ত। ছোট ব্যবসায়ী, কারিগর ও অল্প জমির মালিকেরা ছিল মধ্যম শ্রেণি, আর কৃষক ও দাসেরা ছিল নিম্ন শ্রেণির। ভারতবর্ষে বৈদিক যুগের শেষভাগে চার বর্ণের উৎপত্তি ও পেশাগত কার্যের ভিত্তিতে সমাজে স্তরবিন্যাসের একটি ব্যাপক দৃষ্টান্ত। মধ্যযুগে ইউরোপে সামন্ত বাদী সমাজে রাজা, পুরোহিত এবং বৃহৎ ভূস্বামী ছিল সমাজের সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি। আধুনিককালে সম্পদ ও শিক্ষার ভিত্তিতে সমাজে শ্রেণি গড়ে উঠেছে।
৩. সামাজিক স্তরবিন্যাসের প্রকৃতি অভিন্ন নয়
সামাজিক স্তরবিন্যাসের বৈশিষ্ট্য সকল সমাজে এক নয়। কারণ বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন শ্রেণি বা স্তরের উৎপত্তি ভিন্ন ভিন্ন কারণে হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, শিল্পোন্নত বা উন্নতিশীল দেশের সামাজিক স্তর ও অনুন্নত দেশের সামাজিক স্তরবিন্যাসের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য দেখা যায়। আবার বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তিবর্গের প্রতি যে মর্যাদা দেয়া হয় তা সকল সমাজে এক রকম নয়। বহু বিচিত্র কারণে মানমর্যাদার ক্ষেত্রে তারতম্যের সৃষ্টি হয়ে থাকে। এ সমস্ত কারণের মধ্যে সামাজিক জীবনের মননশীলতা, বাস্তবতা, ধর্মীয় কারণ, কুসংস্কার বা রাজনৈতিক কারণও নিহিত থাকে।
৪. সামাজিক স্তরবিন্যাস সামাজিক মিথস্ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে
স্তরের একটি অন্তর্মুখী বা ব্যক্তির মনোভাব সম্পৃক্ত দিক আছে। বিশেষ ধরনের কিছু মিথস্ক্রিয়া কেবল একই স্তরভুক্ত ব্যক্তিবর্গের মধ্যেই সংগঠিত হয়। বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তিদের মধ্যে হয় না।
বৈবাহিক সম্পর্ক, বৃত্তি নির্বাচন, বন্ধুত্ব স্থাপন প্রভৃতি সাধারণত সমস্তর ও সমমর্যাদার ব্যক্তিদের মধ্যেই হয়ে থাকে। এ ধরনের মিথস্ক্রিয়ার ক্ষেত্রে সামাজিক স্তরবিন্যাসের নিয়ন্ত্রণ অধিকতর কঠোর ও কার্যকরী। কিন্তু যানবাহন, সভাসমিতি, খেলার মাঠ প্রভৃতি ক্ষেত্রে মিথস্ক্রিয়ার ব্যাপারে সামাজিক স্তরবিন্যাসের তেমন কোন প্রভাব দেখা যায় না।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কি বা কাকে বলে ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলাফল |
৫. সামাজিক স্তরবিন্যাসের ধারণা আনুষঙ্গিক বা ফলস্বরূপ
সমাজবিজ্ঞানিগণের মতে স্তরবিন্যাসের ফলশ্রুতি হলো যে, তা মানুষের জীবনের সম্ভাবনা বা Life- Chances বা জীবনযাত্রার নানাপ্রকার সুযোগ সৃষ্টি করে। দ্বিতীয়ত, এটি জীবনধারণের প্রণালি বা ধরন (Life-Styles) নির্ধারিত করে। প্রথম ক্ষেত্রে এটি মানুষের জীবনধারণের সম্ভাবনা দৃঢ়তর কিংবা দুর্বল করে, শিশু জন্ম-মৃত্যু হারের হ্রাসবৃদ্ধির কারণ হয়; স্বাস্থ্য, সন্ত ানহীনতা, স্বামী-স্ত্রীর বিরূপ ও বিচ্ছেদ- এদের উপরও বিভিন্ন সামাজিক স্তরের পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে। জীবনযাত্রা প্রণালির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার মধ্যে আছে বাসস্থান, পল্লি বা আঞ্চলিক সুযোগ সুবিধা, শান্তি, বিনোদনের বাঞ্ছিত ব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক উন্নতির পন্থা, যানবাহন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা ইত্যাদি।
অতএব বলা যায় যে, সামাজিক স্তরবিন্যাসের সঙ্গে সামাজিক মর্যাদা ও সামাজিক ভূমিকা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সেজন্য ম্যাকাইভার ও পেজ এর মতে, “সামাজিক স্তরবিন্যাস হলো মর্যাদাভিত্তিক গোষ্ঠীসমূহের ঊর্ধ্বে বিন্যাস।”