বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামোর সর্বনিম্নস্তর হলো স্থানীয় শাসন। স্থানীয় শাসন দু ধরনের; যথা- ১. স্থানীয় শাসন ও ২. স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন স্বশাসিত সংস্থা। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন সংস্থায় জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে বলে স্থানীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়।
স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনে কি?
স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন বলতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এলাকাভিত্তিক জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত শাসনকে বোঝায়। কেন্দ্রীয় শাসনের নিম্নস্তরে গ্রাম ও শহর এলাকায় নানাবিধ সমস্যা ও জনগণের প্রয়োজন মেটানোর জন্যই স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলো প্রতিষ্ঠিত। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান আইনের মাধ্যমে ক্ষমতাপ্রাপ্ত এবং স্ব-স্ব এলাকার জনগণের নিকট দায়িত্বশীল। আমাদের দেশে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন ইত্যাদি স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা। স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনকে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকারও বলে।
জন ক্লার্ক-এর মতে, “স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার একটি জাতীয় সরকারের সেই অংশ যা রাধানত নির্দিষ্ট এলাকার অধিবাসীদের সাথে সম্পর্কিত বিষয়াদির সাথে জড়িত এবং কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার দ্বারা পরিচালিত হতে ইচ্ছুক।”
ইংরেজ লেখক ই. এল. হাসলাক (E. L. Hasluck) বলেন, “যদি কোনো স্থানীয় সংস্থা অন্যান্য সংস্থা হতে ভিন্নভাবে শাসন করার ক্ষমতা ভোগ করে তাহলে সে শাসনব্যবস্থাকে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন বলে।”
স্থানীয় শাসন কাকে বলে ও স্থানীয় শাসনের গুরুত্ব |
Indian Statutory Service Commission-এর ৩৩৩নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সরকার একটি স্থানীয় প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থা যা স্থানীয় জনগণের নিকট দায়ী, যে শাসনব্যবস্থা পরিচালনায় আইন প্রণয়ন, শাসন, বিচার এমনকি নিজস্ব তহবিল সৃষ্টির জন্য এলাকার জনগণের ওপর কর আরোপ করতে পারে।” বস্তুত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এলাকার প্রয়োজন মেটানোর জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত শাসনই স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন।
স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের বৈশিষ্ট্য
স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের ধারণা ও প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
১. আইনগত ভিত্তি: স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলো আইনের মাধ্যমে ক্ষমতাপ্রাপ্ত এবং কিছুটা স্বাধীয়ভাবে এ ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকে।
২. নির্বাচিত সংস্থা: স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলো স্থানীয় জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হয় একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য।
৩. কর আরোপের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ: স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলো স্ব-স্ব এলাকার জনগণের ওপর কর ধার্য করে তহবিল সংগ্রহ করে।
৪. স্বশাসন: স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থায় স্থানীয় কর্তৃপক্ষ আইনের আওতাধীনে সর্বাধিক স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে।
৫. সরকারি নিয়ন্ত্রণযুক্ত: স্থানীয় এলাকার সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধানের জন্য নীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এ সংস্থাগুলো সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত থাকে।
৬. সিদ্ধান্ত গ্রহণে জনগণের অংশগ্রহণ: এ সংস্থাগুলোতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে।
স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের গুরুত্ব
এলাকাভিত্তিক সমস্যা, জনগণের প্রয়োজন, স্থানীয় উন্নয়ন ইত্যাদি স্থানীয়ভাবে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার মাধ্যমে করা গেলে একদিকে যেমন সুষ্ঠুভাবে শাসনকার্য পরিচালনা সম্ভব হবে, জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ ঘটবে, সর্বোপরি সুশাসন প্রতিষ্ঠা পাবে। এহেন অবস্থায় বাংলাদেশে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের গুরুত্ব অপরিসীম। এতে-
১. স্ব-স্ব এলাকার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা এবং সম্ভাব্য সমাধান নির্দেশ করা সম্ভব। কারণ কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে এলাকাভিত্তিক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয় না।
২. জনগণের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায় এবং রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত হয়।
৩. স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের হাতে সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা থাকায় স্বল্প সময়ে এবং কম ব্যয়ে সমস্যার সঠিক সমাধান সম্ভব হয়।
৪. স্থানীয় পর্যায়ে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে যা পরবর্তীতে জাতীয় রাজনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারে।
৫. এলাকাভিত্তিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়।
৬. সুষ্ঠু জনমত গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে সহায়ক।
৭. বৃহদায়তন ও বিপুল জনসংখ্যা অধ্যুষিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা খুবই উপযোগী।
স্থানীয় শাসন ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের পার্থক্য
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য) স্থানীয় শাসন এবং স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনকে এক করে দেখা হয়। গ্রাম ও শহর অঞ্চলের স্থানীয় সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের শাসনকে তারা স্থানীয় শাসন বলে। কিন্তু আমাদের দেশে এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করা হয় নিম্নোক্তভাবে-
স্থানীয় শাসন | স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন |
১. স্থানীয় শাসনব্যবস্থা সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন। | ১. স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন কিছুটা স্বাধীনভাবে নীতি নির্ধারণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে। |
২. স্থানীয় শাসনব্যবস্থায় সরকার কর্তৃক নিযুক্ত কর্মচারীবৃন্দ থাকেন। | ২. স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থায় জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি থাকেন। |
৩. স্থানীয় সরকারের মূল লক্ষ্য সরকারি নীতিসমূহ বাস্তবায়নের মাধ্যমে জনকল্যাণ ও সুশাসন নিশ্চিত করা। | ৩. স্ব-শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এলাকার সার্বিক উন্নয়নের মাধ্যমে সর্বাধিক কল্যাণ নিশ্চিত করা স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের মূল লক্ষ্য। |
৪. স্থানীয় শাসনের কার্যাবলিতে জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি প্রাধান্য পায়। | ৪. স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনে স্থানীয় দৃষ্টিভঙ্গি প্রাধান্য পায়। |