ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক এবং শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বিশেষ স্থান দখল করে আছে। বিশেষ করে ভারতবর্ষের শাসনতান্ত্রিক ক্রমবিবর্তনে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ভারতীয় জনগণের জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ, রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি সর্বোপরি ১৯১৯ সালের আইনের ব্যর্থতার ফলে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন প্রবর্তিত হয়। এ আইনে ভারতীয়গণ কিছুটা হলেও সন্তুষ্ট হয়েছিল।
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন এর প্রেক্ষাপট
কংগ্রেস কর্তৃক ১৯১৯ সালের সংস্কার আইন প্রত্যাখ্যান, ১৯২০ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসের অনুপস্থিতি এবং পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবির প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সরকার ১৯২৭ সালে স্যার সাইমনের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করে। কমিশন ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের কার্যকারিতা পরীক্ষাপূর্বক যে রিপোর্ট তৈরি করেন তাতেও ভারতীয়দের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। অতঃপর ১৯৩০-৩২ সাল পর্যন্ত (লন্ডনে) পর্যায়ক্রমে তিনটি গোল টেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়। এ বৈঠকসমূহে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে ব্যাপক আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের যুক্ত কমিটি কতকগুলো প্রস্তাব গ্রহণ করে। পরে প্রস্তাবগুলোর ভিত্তিতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন গৃহীত হয়।
দ্বৈত শাসন বলতে কি বুঝায় | দ্বৈত শাসন কি |
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের বৈশিষ্ট্য সমূহ
ভারতীয়দের বহু প্রতীক্ষিত ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ। নিচে উক্ত আইনের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হলো-
১. সর্বভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো একটি সর্বভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র (All India Federation) গঠনের উদ্যোগ। ব্রিটিশ ভারতের সকল প্রদেশ। ও ফেডারেশনে যোগদানে ইচ্ছুক দেশীয় রাজ্যগুলোকে নিয়ে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার (Federal Government) গঠনের পরিকল্পনা করা হয়।।
২. শাসন সংক্রান্ত বিষয়ের বিভক্তিকরণ
এ আইনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য শাসনসংক্রান্ত বিষয়সমূহকে তিনটি বিভাগে ভাগ করা হয়। যথা-(ⅰ) কেন্দ্রীয় তালিকা (Federal List), (ii) প্রাদেশিক তালিকা (Provincial List) এবং (iii) যুগ্ম তালিকা (Concurrent List)। কেন্দ্রীয় তালিকার মধ্যে ছিল দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র সংক্রান্ত বিষয়, মুদ্রা, যোগাযোগ, ডাক ও তার ইত্যাদি। আর এসব বিষয় কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক পরিচালিত হবে। প্রাদেশিক তালিকায় ছিল আইনশৃঙ্খলা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, বিচার, পুলিশ ইত্যাদি- যা প্রাদেশিক সরকার কর্তৃক পরিচালিত হবে। আর যুগ্ম বিষয়ের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক সরকার যৌথভাবে পালন করবে। ফৌজদারি আইন, ফৌজদারি বিচার প্রণালি, বিবাহ, উইল ইত্যাদি যুগ্ম তালিকার অন্তর্ভুক্ত।
৩. প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন
এ আইনের একটি আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন। সংবিধান অনুযায়ী প্রাদেশিক তালিকাভুক্ত বিষয়গুলোর ওপর প্রাদেশিক সরকারের কর্তৃত্ব থাকবে। তবে বাস্তবে কেন্দ্রীয় সরকার প্রাদেশিক সরকারের কাজে হস্তক্ষেপ করত।
৪. যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত গঠন
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত (Federal Court) প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করা হয়। একজন বিচারপতি এবং কয়েকজন বিচারক নিয়ে এ আদালত গঠিত হবে- যার দায়িত্ব হবে সংবিধানের ব্যাখ্যা প্রদান এবং কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে বিরোধের মীমাংসা করা।
৫. কেন্দ্রে দ্বৈতশাসন
১৯৩৫ সালের আইনের মাধ্যমে কেন্দ্রে দ্বৈতশাসন প্রবর্তিত হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের বিষয়সমূহকে সংরক্ষিত (Reserved) এবং হস্তান্তরিত (Transfered) এ দু ভাগে ভাগ করা হয়। দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র, ধর্মীয় ইত্যাদি বিষয় সংরক্ষিত ছিল; গভর্নর জেনারেল তাঁর ইচ্ছাধীন ক্ষমতা বলে এসব বিষয় পরিচালনা করতেন। তাঁকে পরামর্শ প্রদান ও সাহায্য করার জন্য তিনজন উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়। পাশাপাশি হস্তান্তরিত বিষয়ের মধ্যে ছিল শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইনশৃঙ্খলা ইত্যাদি যা গভর্নর জেনারেল মন্ত্রিসভার পরামর্শ অনুযায়ী পরিচালনা করতেন।
৬. দ্বিকক্ষবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় আইনসভা
এ আইনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় আইনসভাকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করা হয়। প্রথম কক্ষ ব্যবস্থাপক সভা (Federal Assembly), দ্বিতীয় কক্ষ রাষ্ট্রীয় সভা (Council of States)। তবে উভয় কক্ষকেই সমক্ষমতাসম্পন্ন করা হয়।
৭. পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা
১৯০৯ সালের মর্লে-মিন্টো সংস্কার আইনে সর্বপ্রথম মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয় এবং কেন্দ্রীয় আইনসভায় অংশ মুসলমান প্রতিনিধি প্রেরণের ব্যবস্থা স্বীকৃত হয়।
৮. শাসন বিভাগের প্রাধান্য
এ আইনে শাসন বিভাগের প্রাধান্য রক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। যেমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ভারতের আইন সভাগুলোকে ক্ষমতা দেওয়া হয়নি এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে গভর্নর জেনারেল ও গভর্নর মন্ত্রী এবং আইনসভার সিদ্ধান্তকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা লাভ করে।
৯. সংবিধান সংশোধন
১৯৩৫ সালের আইনে সংবিধান সংশোধনের ব্যবস্থা রাখা হলেও সংশোধনের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভার পরিবর্তে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ওপর ন্যস্ত হয়।
১০. দ্বিকক্ষবিশিষ্ট প্রাদেশিক আইনসভা
এ আইনে কয়েকটি প্রদেশে যেমন বোম্বাই, মাদ্রাজ, বাংলা, যুক্ত প্রদেশ, বিহার ও আসামে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার ব্যবস্থা রাখা হয়। আর বাকি প্রদেশগুলোতে এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা রাখা হয়।
১১. প্রাদেশিক গভর্নরের পদ সৃষ্টি
কেন্দ্রীয় শাসনভার গভর্নর জেনারেলের ওপর ন্যস্ত করা হলেও তিনি একই সাথে কেন্দ্র ও প্রদেশের শাসন দেখাশুনা করতেন। পাশাপাশি প্রদেশে গভর্নরের পদ সৃষ্টির মাধ্যমে তাকে প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার পরামর্শ অনুযায়ী শাসন পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন ও এ আইনের বৈশিষ্ট্য সমূহ |
১২. নতুন প্রদেশ সৃষ্টি
ভারত শাসন আইনে ব্রহ্মদেশকে (বার্মা) পৃথক করে উড়িষ্যা ও সিন্ধু নামে দুটি নতুন প্রদেশের সৃষ্টি করা হয়। সীমান্ত প্রদেশসহ নতুন দুটি প্রদেশকে অন্যান্য প্রদেশের সমমর্যাদা প্রদান করা হয়।
১৩. রাজপ্রতিনিধির পদ সৃষ্টি
১৯৩৫ সালের আইনে রাজপ্রতিনিধির পদ সৃষ্টি করা হয়। মূলত ব্রিটিশ রাজার সার্বভৌম ক্ষমতা ব্যবহারের জন্যই এ নতুন পদের সৃষ্টি।
১৪. উপদেষ্টা সংস্থা
এ আইনের মাধ্যমে ঐতিহাসিক ভারতীয় উপদেষ্টামণ্ডলী বা ভারত সচিবের পদ রহিত করা হয় এবং তদস্থলে অধিকতর কার্যকর ও স্বল্প ক্ষমতাসম্পন্ন উপদেষ্টা সংস্থা গঠন করা হয়।
১৫. দায়িত্বশীলতা
প্রাদেশিক সরকারের প্রধান ছিলেন একজন গভর্নর। গভর্নরকে পরামর্শদানের জন্য একটি মন্ত্রিসভা ছিল। মন্ত্রিসভা তাদের কার্যাবলির জন্য আইনসভার কাছে দায়ী থাকতেন। কিন্তু গভর্নরের হাতে প্রচুর স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা থাকায় তিনি মন্ত্রীদের পরামর্শকে উপেক্ষা করে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন।
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে ভারতীয়দের দাবি-দাওয়া অন্তর্ভুক্ত হলেও তা মূলত কাগজপত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল। বাস্তবে তার প্রতিফলন ঘটেনি। তবে একথা সত্য যে, এ আইন পরবর্তীকালে ভারতের রাজনৈতিক অগ্রগতি এবং ১৯৪৭ সালের ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের মূলভিত্তি রচনা করেছিল।