Home » মাধ্যমিক শূন্যবাদ কি? প্রতীত্যসমুৎপাদকে শূন্যবাদ বলা যায় কিনা? যুক্তি সহকারে বিশ্লেষণ কর
মাধ্যমিক শূন্যবাদ কি প্রতীত্যসমুৎপাদকে শূন্যবাদ বলা যায় কিনা

মাধ্যমিক শূন্যবাদ কি? প্রতীত্যসমুৎপাদকে শূন্যবাদ বলা যায় কিনা? যুক্তি সহকারে বিশ্লেষণ কর

by Susmi
0 comment

আজকে জানবো মাধ্যমিক শূন্যবাদ কি এবং প্রতীত্যসমুৎপাদকে শূন্যবাদ বলা যায় কিনা সে সম্পর্কে। আশাকরি আর্টিকেলটি আপনাদের অনেক উপকারে আসবে।

ভূমিকা

গৌতম বুদ্ধের বানী ও উপদেশের উপর ভিত্তি করে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে যে মতবাদ গড়ে উঠেছে সেই মতবাদই বৌদ্ধ ধর্ম বা বৌদ্ধ দর্শন। দর্শনের প্রধান সমস্যাগুলো হল সমাধানের জন্য বুদ্ধদেব মোটেও আগ্রহী ছিলেন না। তাঁর নিকট প্রধান সমস্যা ছিল মানুষ জগতে দুঃখ কষ্ট ভোগ করে কেন এবং এই দুঃখ কষ্ট হতে পরিত্রানের উপায় কি? বুদ্ধদেব আজীবন এই দুটি সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছেন। বুদ্ধদেব নির্বিচারে কোন মত গ্রহণ বা কোন পথ অবলম্বন করতেন না। সব কিছুই বিচারপূর্বক তিনি গ্রহন করতেন। প্রত্যক্ষভাবে বুদ্ধদেব কোন দার্শনিক মতবাদ প্রচার করেন নি, কিন্তু তার নৈতিক উপদেশের মধ্যে দার্শনিক মতবাদের বীজ সুপ্ত ছিল। তেমনি একটি দার্শনিক মতবাদ ছিল মাধ্যমিক সম্প্রদায়ের শূন্যবাদ।

মাধ্যমিক শূন্যবাদ

মাধ্যমিক সম্প্রদায়ের দার্শনিক মতবাদের নাম হল শূন্যবাদ। শুন্যবাদ অনুসারে সবকিছুই শূন্য, মন বা বাহ্য বস্তু বা জড় বস্তু বলে কোন কিছুর সত্ত্বা নেই। জড় জগত এবং মন জগত সবই মিথ্যা। এটাকে বলা হয় মাধ্যমিক শূন্যবাদ । মাধ্যমিক শূন্যবাদ অনুসারে যুক্তি হচ্ছে জ্ঞাতা, জ্ঞেয়, জ্ঞান। পরস্পর এরা নির্ভরশীল। যেকোন দুটি মিথ্যা প্রমানিত হলে অপরটিও মিথ্যা বলে ধরে নিতে হবে।

জ্ঞাতা- The knower of the subject
জ্ঞেয়- The knower of the object
জ্ঞান- The knower of the knowledge

কোন ব্যক্তি তার সন্তানের পিতৃত্ব অস্বীকার করলে তার অস্তিত্বও স্বীকার্য নয়। অন্ধকারে যদি কোন রজ্জুকে সর্প বলে জানি তখন সেখানে আমাদের জ্ঞান মিথ্যা। যেহেতু বাস্তবে কোন সর্প নেই । সর্পের জ্ঞান যেখানে মিথ্যা সেখানে জ্ঞানকৃত মনই মিথ্যা। সুতরাং মাধ্যমিকগণ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, জীব ও জড় জগৎ উভয়ই মিথ্যা।

প্রতীত্যসমুৎপাদ শূন্যবাদ কিনা?

তথাগত বুদ্ধ বুদ্ধত্ব লাভের পর বারাণসীর উপকন্ঠে ঋষিপতন মৃগদাবে ধর্মচক্র প্রবর্তনের সময় তিনি শিষ্যদেরকে মধ্যপন্থা অবলম্বনের উপদেশ দিয়েছিলেন। আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রেও তিনি সর্বপ্রকার অতিবাদিতা- স্ৎ, অসৎ, আত্মা ,অনাত্মা, নিত্য, অনিত্য, শাশ্বত, উচ্ছেদ আদি স্থাপনাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। পরবর্তীকালে আচার্য নাগার্জুন এর উপর ভিত্তি করে মাধ্যমিক শূন্যবাদ দর্শনের বিকাশ সাধন করেছেন। তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ মাধ্যমিক কারিকাতে তিনি স্বীকার করেছেন যে, বুদ্ধ নির্দেশিত প্রতীত্যসমুৎপাদ তথা মধ্যমমার্গই মাধ্যমিক শূন্যবাদ দর্শন। সুতরাং সংসারের প্রতীত্যাত্মক স্বরূপ সম্বন্ধে মাধ্যমিকের সিদ্ধান্ত প্রতীত্য সমুৎপাদ হতে নির্গত।

আরও পড়ুন:   প্রতীত্য সমুৎপাদ নীতি বা কার্যকারণ তত্ত্ব কি?

নাগার্জুন প্রতীত্যসমুৎপাদ দর্শনের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, “প্রতীত্যসমুৎপাদ অশ্বাশত অনুচ্ছেদবাদ উপস্থিত করে।” প্রতীত্যসমুৎপাদ শাস্ত্রের আধার শিলাতেই সমস্ত বৌদ্ধ দার্শনিক প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠিত। অধিকন্তু মাধ্যমিক শূন্যবাদের আধার শিলাই প্রতীত্যসমুৎপাদ। মাধ্যমিক মান্যতানুসারে প্রতীত্য সমুৎপাদের দুই অর্থ ‘প্রতীত্য’ আর ‘সমুৎপাদ” অর্থাৎ প্রথম অর্থ বস্তু স্বীয় উৎপত্তির জন্য অন্য হেতুর উপর উৎপন্ন হয়ে নষ্ট হয়ে যায়। সুতরাং এতে সিদ্ধ হতেছে যে বস্তু সমূহের প্রবাহ বিচ্ছিন্ন, যদিও অবিচ্ছিন্ন মনে হয়। উভয় অর্থই বুদ্ধ মন্তব্যের অনুকূল।

মাধ্যমিক শূন্যবাদীরা বস্তুর কোন প্রকার পারমার্থিক সত্ত্বা স্বীকার করতেন না, অধিকন্তু সদ, অসদ, শ্বাশত, উচ্ছেদ, এই উভয় অন্তের পরিহার করে মধ্যম মার্গের উপদেশ করতেন। সুতরাং মাধ্যমিক “ভাব” এবং ‘অভাব’ এর স্থিতিব নিরাকরণ করে মধ্যমমার্গ অর্থাৎ সাপেক্ষ সত্যতার অবলম্বন করেন৷ তাই বলা হয় “আছে” বললে শাশ্বতবাদে পতিত হতে হয়, ‘নাই’ বললে উচ্ছেদবাদে পতিত হতে হয়, তাই সংসার বিষয়ে যথার্থদর্শী বিচক্ষন পণ্ডিত ব্যক্তিগণ ”অস্তি – নস্তি” এই দুই অন্ত গ্রহণ না করে মধ্যমমার্গ অবলম্বন করেন। মাধ্যমিক শূন্যবাদের এই দ্বন্দাত্মক অনুভূতির মূলরূপ পালি সূত্রগুলো থেকে এসেছে।

বুদ্ধের মতে কোন কিছু শাশ্বত নয়, উচ্ছেদ ও নয়, প্রত্যেক বস্তু স্বীয় কারণ হতে উৎপন্ন হয়। পরন্তু কারন হতে অন্যও নয়, অনন্য ও নয়, কারন হতে হলে উচ্ছেদ মানতে হয়, আর যদি অনন্য অর্থাৎ কারন রূপ মানা হয়, তবে সেটিকে শাশ্বত মানতে হয়। উভয়ই বৌদ্ধ চিন্তার পরিপন্থী, তাই কোনও বস্তু শাশ্বত হতে পারে না, আর উচ্ছেদ হতে ও পারে না। সুতরাং কার্যকারণের এই “নতৎ, নান্যৎ” অর্থাৎ অশাশ্বতানুচ্ছেদবাদ বৌদ্ধ ধর্মের মৌলিক সিদ্ধান্ত। এই নিয়মই প্রতীত্যসমুৎপাদ। এই প্রতীত্যসমুৎপাদ বাদীকেই মাধ্যমিক বলা হয়েছে।

মাধ্যমিক আচার্যদের মতে প্রতীত্যসমুৎপাদ শব্দের যেই অর্থ, শূন্য শব্দেরও সেই অর্থ। ভারতীয় দর্শনগগনের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক আচার্য নাগার্জুন যদিও মাধ্যমিক শূন্যবাদ দর্শনের প্রথম প্রবক্তারূপে সর্বজন স্বীকৃত, কিন্তু এটি সত্য যে, মৌলিক বৌদ্ধ সিদ্ধান্তের মাধ্যমিক প্রতিপদা তথা প্রতীত্যসমুৎপাদ তত্ত্বই নাগার্জুনের শূন্যবাদ দর্শনের মূল ভিত্তি।

নাগার্জুন প্রতীত্য সমুৎপাদ দর্শনের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন- প্রতী্ত্যসমুৎপাদ অশাশ্বত অনুচ্ছেদবাদ উপস্থিত করে। আচার্য নাগার্জুন একে দুই ভাগ করে দেখিয়েছেন- ১. উপাদায় প্রজ্ঞপ্তি, ২. মধ্যমা প্রতিপদা। উপাদায় প্রজ্ঞপ্তিকে অন্য কোন প্রতিশব্দ দ্বারা ব্যক্ত করা যায় না, এর অভিপ্রায় এই যে, প্রত্যেক প্রজ্ঞপ্তি স্বয়ং একক হয় না। রথ এক প্রজ্ঞপ্তি বিশেষ, পরন্তু ঈষা, অক্ষ, চক্র, যুগ প্রভৃতির সংযোগেই হয়। অন্যান্য প্রজ্ঞপ্তিও একা হয় না, বহু পদার্থের মিলনেই হয়। প্রজ্ঞপ্তি স্বয়ং স্বতন্ত্র, অর্থাৎ নিরপেক্ষ না হয়ে সাপেক্ষেই হয়ে থাকে। এরই নাম উপাদেয় প্রজ্ঞপ্তি। ভাব, অভাব, শাশ্বত, উচ্ছেদ এই উভয়ের মধ্যবিন্দুর নামই মধ্যমা প্রতিপদা।

মাধ্যমিক সমস্ত ধর্ম এবং এর সংগ্রহকে অযথার্থ ঘোষনা করেন এবং স্বীকার করেন যে, ধর্ম সমূহ সর্বদা অব্যাখ্যেয় তথা সেটির কোন স্বভাব জানা যায় না, সুতরাং এটি নিঃস্বভাব। এই নিঃস্বভাব তাই শূন্যতা, এই শূন্যতাই সর্বধর্মের স্বভাব, যা প্রতীত্যসমুৎপাদ শব্দের সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত, যা বুদ্ধের মধ্যম মার্গেরই তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ।

এই মধ্যম মার্গানুসারী সিদ্ধান্তে বস্তুর অস্তিত্ব স্বীকৃত হলেও নিত্য নহে, বস্তুর উৎপত্তি অন্যের উপর নির্ভরশীল। এই সিদ্ধান্তে বস্তুর পূর্ণ বিনাশও মান্য নয়, যেহেতু এর অস্তিত্ব প্রবাহরূপে বিদ্যমান। এ জন্য বস্তু পূর্ণরূপে না নিত্য, না অনিত্য, কিন্তু প্রতীত্যসমুৎপন্ন, যা প্রতীত্যসমুৎপন্ন তারই নাম শূন্যতা, শূন্যতা নিরপেক্ষ সত্তার সিদ্ধি প্রত্যাখ্যান করে। বুদ্ধ শূন্যতাকে সমস্ত দৃষ্টিজালের ভাবাভিনিবেশ নিরসনের প্রক্রিয়া বলেছেন।

আরও পড়ুন:   ন্যায় দর্শনে পদার্থ কত প্রকার ও কি কি? বিস্তারিত আলোচনা কর।

মাধ্যমিক শূন্যবাদীরা প্রবল যুক্তি দিয়ে দেখিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, সমস্ত দৃষ্টি জালই অবিদ্যা বা অজ্ঞানতা সম্ভূত, এই অবিদ্যা বা অজ্ঞান হতে নিঃসরণই শূন্যতা। এই শূন্যতা জ্ঞানই সমস্ত দৃষ্টিজাল ছেদনের মহান অস্ত্র, যা বিধান ও নিষেধের অতীত পরম তত্ত্ব। যদি শূন্যতা সিদ্ধান্তকে নিষেধ করা যায়, তা হলে কার্যকারণ ভাবের নিষেধ হয়ে যায়। যদি শূন্যতা না হত, তা হলে যা আজ পর্যন্ত প্রাপ্ত হয় নি, তারও প্রাপ্তি হত না এবং দুঃখেরও বিনাশ সম্ভব হত না আর বাসনা সমূহের পূর্ণ বিনাশ সম্ভব হত না।

মাধ্যমিক শূন্যবাদ এবং প্রতীত্যসমুৎপাদকে তুলনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, মাধ্যমিক শূন্যবাদ “শূন্যতা” নিয়ে আলোচনা করেছেন। তবে এই শূন্যতা অবিদ্যা বা অজ্ঞান হতে নিঃসৃত। অপরদিকে প্রতীত্য সমুৎপাদ বা কার্যকারণতত্ত্বের নিয়ম শৃঙ্খলা অবিদ্যা মূলে সংঘটিত হয়। এতে দেখা যায় যে, মাধ্যমিক শূন্যবাদ ও প্রতীত্য সমুৎপাদ উভয়ের মূলে অবিদ্যা সম্পর্কিত। আবার যেহেতু প্রতীত্য সমুৎপাদ হতে মাধ্যমিক শূন্যবাদ নিঃসৃত সেহেতু প্রতীত্যসমুৎপাদকে শূন্যবাদ বলা যৌক্তিক।

উপসংহার

মাধ্যমিক শূন্যবাদ দর্শন এতই জটিল, এতই রহস্যময় যে, এর সম্যক মূল্যায়ন করা বড়ই দুষ্কর, বড়ই দুৰ্জ্জেয়। তাই বলা হয়েছে প্রপঞ্চাতীতের প্রতিপাদন বাক্ বিজ্ঞপ্তি দ্বারা সম্ভব নয়। যেহেতু্ এটি বাক বিজ্ঞপ্তির বিষয় নয়। কারণ এ নিরোধও নয়, উৎপন্নও নয়, উচ্ছেদও নয়, শাশ্বতও নয়, একার্থও নয়, আগতও নয় । এ সর্বোপধিবর্জিত, প্রপঞ্চোপশমসুখ, শিবলক্ষণ সম্প্রযুক্ত অনির্বচনীয়।

Related Posts