শীতের সকাল
ভূমিকা
ঋতুরঙ্গময়ী রূপসী বাংলাদেশ। বঙ্গ প্রকৃতির ঋতুরঙ্গশালায় তার কী ছন্দোময়, সংগীতময় অনুপম রূপবিস্তার। ঋতু পরিবর্তনের বর্ণবিচিত্র ধারাপথে নিয়ত উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তার অন্তহীন রূপের খেলা, রঙের খেলা, সুরের খেলা। ষড়ঋতুর এই খেলায় হেমন্তের প্রৌঢ়ত্বের পর আসে জড়াগ্রস্ত শীতের ধূসর বার্ধক্য। শুষ্ককাঠিন্য, পরিপূর্ণ রিক্ততা ও দিগন্তব্যাপী সুদূর বিষাদের প্রতিমূর্তি সে। শীত আসে উত্তরে বাতাসে প্রলয়ের পরোয়ানা নিয়ে। বনভূমিতে শুরু হয় হাহাকার। মালতীলতা পত্রশূন্য, ঝুমকোলতার রং ফুরায়, পাতায় পাতায় ঘাসে পাড়ুরতা। তবু শীতের সকাল নতুন আমেজ নিয়ে হাজির হয় গ্রামবাংলায়।
শীতের সকালের ভাবরূপ
শীতের রিক্ততা নতুন জীবন আগমনের ভূমিকা রচনা করে। ধীরে ধীরে কুয়াশার আস্তরণ ভেদ করে সূর্যিমামা আলো ছড়াতে থাকে। উত্তরের হিমশীতল হাওয়া বইতে থাকে ধীরে ধীরে। বনের গাছপালা থেকে টুপটুপ করে ঝরে পড়ে শিশির। শিশির ভেজা দুর্বাঘাসে কিংবা টিনের চালে সূর্যালোক পড়লে মনে হয় মুক্তা ঝলমল করছে। মানুষ আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে ঘরে বসে থাকে, কিংবা আগুন জ্বালিয়ে চারদিকে কুন্ডলি পাকিয়ে ঝিমুতে থাকে। আস্তে আস্তে কর্মের মুখরতায় শীতের সকাল কর্মব্যস্ত হয়ে ওঠে। মৌমাছিরা গুণ গুণ শব্দে ছুটে যায় সর্ষে ফুলের দিকে মধু সংগ্রহের উদ্দেশে।
আরও পড়ুন: হেমন্তকাল রচনা
শীতের সকালের কৃষাণ-কৃষাণী
শীতের সময় কৃষকেরা মৌসুমি শস্য তোলার ব্যাপারে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। অন্যদিকে শাকসবজি ক্ষেতের তদারক করতে হয়। সকাল বেলাতেই দেখে আসতে হয় একবার কি অবস্থা সবজি বাগানের। কৃষকবধূও ব্যস্ত থাকে এ সময়। বিভিন্ন রকম পিঠা তৈরি করে পরিবারের সবাইকে উপহার দিতে। কখনো কখনো খেজুর রসের পায়েস তৈরি করে পরিবেশন করে সবাইকে। শীতের পিঠার সাথে খেজুরের গুড় মিশিয়ে খেতে কতই না মজা। তাই তো কবি সুফিয়া কামাল মনের নিকুঞ্জ বনে আজও ধরে রেখেছেন সে আনন্দঘন পরিবেশকে তাঁর কবিতায়-
“পৌষ মাসে পিঠা খেতে বসে
খুশিতে বিষম খেয়ে
আরও উল্লাস বেড়েছে মনে
মায়ের বকুনি খেয়ে।”
নগরে শীতের সকাল
শহরে তুলনামূলকভাবে গ্রামের চেয়ে শীতের প্রকোপ একটু কম। কলকারখানা ও গাড়ির ইঞ্জিন, কখনো বা বৈদ্যুতিক আলোর প্রভাবে তাপমাত্রা বাড়ে। তবে শহরেও শীতের সকালের আগমন ভিন্ন ধরনের হয়। সকালে অফিসমুখী মানুষের ছুটাছুটি শুরু হয়। যতই কুয়াশা পড়ক আর ঠান্ডা পড়ুক না কেন, সময়মত পৌছতে হবে অফিসে। তবে ছুটির দিনে অনেকেই শীতের সকালে বিছানা ত্যাগ করে না। লেপ মুড়ি দিয়ে আমেজ করে ঘুমায়। যান্ত্রিক সভ্যতায় শহরবাসী লোকেরা অভ্যস্ত। প্রকৃতির রূপ সুষমা ইট বালির দেয়ালের মধ্যে বসে উপভোগ করার সময় কোথাও নেই। অনেক সময় ঘন কুয়াশায় শহর আচ্ছন্ন হলে গাড়ির হেড লাইট জ্বালিয়ে চলাচল করতে হয়। তবে শহরের বস্তি জীবনে শীতের সকাল মোটেও সুখকর নয়। তারাও গ্রামের দরিদ্র মানুষের মতো শীতের দাপটে মুহ্যমান থাকে।
আরও পড়ুন: একটি শীতের সকাল রচনা
শীতের সকালের প্রকৃতি
শীতের সকাল আসে ধীর লয়ে। যেন তার কোনো ব্যস্ততা নেই। শীতকালে বাংলাদেশে প্রচুর শাকসবজি জন্মে। মাঠে মাঠে সেই শাকসবজি সবুজ শাখা বিস্তার করে প্রকৃতিকে কোমল করে তোলে। ঘাসের ডগায় ও সবজি পাতায় রাতের শিশির কণা সকালের সূর্যালোকে ঝলমল করে হাসতে থাকে। শীতকালে নদীনালা, খালবিল, পুকুরডোবা শুকিয়ে যায়। শীতের সকালে নদীকে দেখে মনে হয় যেন শীতের ভয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে এক শান্ত সুবোধ বালিকার মতো। গাছপালা পত্রশূন্য বলে প্রকৃতির সর্বত্রই বৈরাগ্যের ভাব ফুটে ওঠে। শীতের সকালে কুয়াশা থাকায় নদীর বুকে নৌকা চলাচল কম থাকে। চরে আটকে যাওয়ার ভয়ে লঞ্চ, স্টীমার ও ফেরিগুলো চলাচল বন্ধ রাখে।
শীতের সকালে গরিব লোকের অবস্থা
শীত যেমন আনন্দের ঋতু তেমনি কষ্টেরও। গরিব লোকেরা গরম কাপড় কিনতে পারে না বলে শীতের সকালে তাদের দুঃখকষ্টের সীমা থাকে না। আবার এমনও অনেক লোক আছে যাদের ঘরবাড়ি নেই, শহরে ফুট ফরমাস খাটে আর রাতে ঘুমায় রাস্তার ফুটপাতে। তাদের জন্যে শীত এক অভিশাপ। কবি শামসুর রাহমান তাই লিখেছেন-
“শীত সকালে লোকটা কাঁপে
কাঁদে সবার পা ধরে।
একটা শুধু ছিল জামা
তা-ও ছিঁড়েছে ভাদরে।
হি-হি শীতে থাকে পড়ে
ডাকে না কেউ আদরে।”
উপসংহার
শীতের সকালে একটা চিরন্তন সৌন্দর্য ও মাধুর্য আছে। শীতের সকালের সে বিচিত্র বৈশিষ্ট্যের সন্ধান পেতে হলে সুদূর গ্রামে যেতে হবে। গ্রামেই শীতের সকাল তার অনবদ্য সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে বসে আছে। শহরের ইট পাথরের কৃত্রিম কাঠিন্যের মধ্যে গ্রামীণ শীতের সকালের স্নিগ্ধ মধুর রূপটির সম্মান পাওয়া ভার। শীতের পিঠায় কামড় দিতে দিতে কিংবা কোচড় ভরা মুড়ি নিয়ে শীতের সকালের রোদকে বরণ করে নেওয়ার পরিচিত দৃশ্য পল্লিগ্রামের সবখানে দেখা যায়।
2 comments
[…] আরও পড়ুন: শীতের সকাল রচনা […]
[…] শীতের সকাল রচনা […]
Comments are closed.