মাতৃভাষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা কতটা তা সবাই মন থেকে উপলব্ধি করতে পারে। প্রত্যেকের কাছে আপন আপন মাতৃভাষা ভীষণ প্রিয়। এই ভাষাতে প্রাণ খুলে মনের ভাব প্রকাশ করা যায়, গান গাওয়া যায়, কবিতা রচনা করা যায় আরও কত কি! আজ তাই মাতৃভাষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা কতটা তা রচনার মাধ্যমে শিখবো।
মাতৃভাষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা
ভূমিকা
বাংলাদেশের মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। এদেশের সকলেই বাংলা ভাষায় কথা বলে। এদেশের রাষ্ট্রভাষাও বাংলা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠার জন্য ভাষা আন্দোলনে অনেক রক্ত দিতে হয়েছে, জীবন দিতে হয়েছে ১৯৫২ সালে। সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলেও অফিস-আদালতে এখনো তা পূর্ণাঙ্গভাবে প্রচলিত হয় নি। কেবল একুশে ফেব্রুয়ারি এলেই আমরা প্রতিবছর একবার করে ভাষার জন্য কান্নাকাটি করি, কিন্তু পরে আর সারা বছর ভাষার কথা মনে থাকে না। বাংলা ভাষার ব্যাপক প্রচলন ও যথার্থ মূল্যায়নের জন্য সরকারিভাবে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।
বিদেশি শাসকের কবলে আমাদের মাতৃভাষা
মুসলিম শাসনামলে এদেশের সরকারি ভাষা ছিল ফারসি। ইংরেজ শাসনামলে প্রায় দু’শ বছর ইংরেজি ছিল এদেশের সরকারি ভাষা। সেই সাথে কিছুকাল ফারসিও ছিল। পঞ্চাশের দশকের শেষপর্যন্ত বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ইংরেজিই ছিল। এরপর ছাত্র আন্দোলনের ফলে বি.এ পাস পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম হয় বাংলা। ছাত্রদের আন্দোলনের ফলে অফিস, দোকান, গাড়ি সবকিছুর নাম ও নম্বর বাংলায় শুরু হয়েছে। স্বভাবতই আশা করা হয়েছিল যে, ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের ফলে বাংলা ভাষার মর্যাদা বাড়বে, কিন্তু তা হয় নি। বরং পাকিস্তানি শাসকরা সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের ভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিয়েছিল একমাত্র উর্দুকে। ফলে ভাষা আন্দোলন হয়েছে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে বাঙালিদের জীবন দেওয়ার মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলা ভাষার মর্যাদা। তারপর ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ। এবার নিশ্চিত মনে হয়েছিল স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে জীবনের সকল পর্যায়ে মাতৃভামার দ্রুত প্রচলনের মাধ্যমে আমাদের জাতীয় মেধা ও প্রতিভার বিকাশ ত্বরান্বিত হবে। কিন্তু তেমন কিছু যে ঘটে নি তা অস্বীকার করার উপায় নেই। অফিস-আদালতে, শিক্ষায়তনে, প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানে এখনো ইংরেজির আধিপত্য। কেবল প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারির প্রাক্কালে যেমন শহিদ মিনারের ঘষামাজায় নিয়োজিত হয় কিছু শ্রমিক, তেমনি বাংলার সর্বাত্মক প্রচলনে ব্যর্থতার দায়ভার একে অপরের ঘাড়ে চাপিয়ে উৎসারিত হয় বিলাপ। শহিদ দিবস অতিক্রান্ত হওয়ার পর যথারীতি ইংরেজিতেই প্রায় সকল আনুষ্ঠানিক ও প্রশাসনিক কাজকর্ম পরিচালিত হয়। শুধু তাই নয়, আমরা ভাষাশহিদের স্মরণে যে দিবসটি পালন করি, তাও ইংরেজি মাসের নাম এবং তারিখ অনুসারে ২১ ফেব্রুয়ারি। বাংলায় সে দিনটি ছিল ‘৮ ফাল্গুন’, কিন্তু আমরা তা ব্যবহার করি না-এই হলো আমাদের মানসিকতা। অবশ্যই এই মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস রচনা (৭০০ শব্দ)
সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহার না করার ফল
সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের ক্ষেত্রে যে অতরায়গুলোর কথা সাধারণত উল্লিখিত হয়ে থাকে, তার একটি হলো পরিভাষার অভাব। বিশেষ করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক বাংলা বই নেই বলে উচ্চতর শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলার প্রবর্তন প্রায় অসম্ভব মনে করেন অনেকেই। যেকোনো বিদেশি ভাষায় বিধৃত জ্ঞান শিক্ষার্থীর মস্তিষ্কে তার মাতৃভাষায় অনূদিত হয়েই প্রবেশাধিকার পায়। এ প্রক্রিয়া বিড়ম্বিত হলে ভিন্ন ভাষায় রচিত যেকোনো প্রশ্ন, তা যত মূল্যবান তত্ত্ব বা তথ্য সমৃদ্ধ হোক, একজন পাঠকের কাছে অর্থহীন হতে বাধ্য। অর্থাৎ শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীকে মাতৃভাষার সাহায্য নিতেই হয়। তাহলে ইংরেজি শিক্ষিত শিক্ষক কেন তাঁর সংগৃহীত জ্ঞান ছাত্রদের কাছে সরাসরি বাংলায় প্রকাশ করতে পারবেন না? অনেক প্রবীণ পদস্থ ব্যক্তি মনে করেন যে, প্রশাসনিক কাজকর্মে ইংরেজিতে সে স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করেন, বাংলায় সে সুবিধা বোধ করেন না। এটি সম্পূর্ণ মানসিকতার ব্যাপার। দৈনন্দিন জীবনের অন্যান্য পর্যায়ে বাংলা ভাষাকে যারা ভাব বিনিময়ের বাহন হিসেবে অবলীলায় ব্যবহার করেন। কেবল প্রশাসনিক নথি রচনার সময়ে বাংলা ভাষা তাদের কাছে অকিঞ্চিৎকর প্রতিভাত হয় এ কারণেই যে, দীর্ঘদিনের অভ্যাসের ফলে প্রশাসন ও ইংরেজির সম্পর্ককে তারা অবিচ্ছেদ্য বলে জেনেছেন। ইংরেজ অথবা পাকিস্তানি শাসকের চোখে উত্তম ইংরেজি লিখতে পারা অবশ্যই একজন বাঙালি কর্মচারীর যোগ্যতার মাপকাঠি ধরা হতো। কিন্তু যে দেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা সেখানেও ইংরেজির উৎকর্ষই কি প্রশাসনিক দক্ষতার মূল্যায়নের প্রতিমান হিসেবে গণ্য? জনগণের ভাষা ও প্রশাসনের ভাষা আলাদা রেখে কী করে জাতীয় কর্মকাণ্ডে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব?
সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের অসুবিধা
বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার দুর্বল এ অজুহাতে বলতে শোনা যায় যে, বাংলা ভাষার মাধ্যমে উচ্চতর শিক্ষা সম্ভব নয়। কিন্তু কথাটা মোটেও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয় যে, অনুন্নত দেশগুলো উন্নত দেশসমূহের কিছু শব্দ ধার করে নিজেদের শব্দসম্ভারের দৈন্যদশা কাটায়, যে শব্দ যে ভাষায় নেই, অন্য ভাষ্য থেকে ধার করতে আপত্তি কোথায়? কোনো ভাষাই নিরঙ্কুশ নিজস্ব নয়। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষায় যথেষ্ট বইয়ের অভাব আছে সত্য, তবে চেষ্টা করলে যোগ্যতাসম্পন্ন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিরা উদ্যোগ নিলে এ অসুবিধা দূরীকরণ সম্ভব। কাজেই বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা এবং উচ্চশিক্ষা সম্ভব নয় একথা যুক্তির মাপকাঠিতে টেকে না।
মাতৃভাষার মাধ্যমে জ্ঞানচর্চার ফলশ্রুতি
পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, উন্নত জাতিসমূহ নিজ নিজ ভাষায় জ্ঞানচর্চা করেই নিজেদেরকে সমৃদ্ধশালী করতে সক্ষম হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে প্রাচীন গ্রিস ও বর্তমান চীনের কথা উল্লেখ করা যায়। মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করে কখনোই নিজেদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে উন্নত করা সম্ভব নয়। মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষাতেই মানুষের নিজস্ব মনোভাব ও চিন্তা-কল্পনা প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে না। জাতীয় ভাষাতেই জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা মূর্ত হয়ে উঠতে পারে। ফরাসি বিপ্লবের প্রেরণাশক্তি ছিল সেদেশের সাহিত্য, যে সাহিত্য তাদের মাতৃভাষার মাধ্যমেই সকলের ভাবধারাকে ফুটিয়ে তুলেছিল।
মাতৃভাষার গুরুত্ব
মাতৃভাষা প্রতিটি আতির মূল্যবান সম্পদ। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইংরেজির প্রয়োজনীয়তা থাকলেও মাতৃভাষা ছাড়া পরিপূর্ণভাবে মনোভাব প্রকাশ করা যায় না। তাই স্থানীয় পর্যায়ে মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। যে ভাষা জনসাধারণের বোধগম্য নয়, যে ভাষায় অন্যের সঙ্গে প্রাণ খুলে ভাব বিনিময় করা যায় না, সেসব লোকের পক্ষে মাতৃভাষায় কথা বলা বা লেখাই একমাত্র পন্থা। বিশিষ্ট ভাষা-পন্ডিত ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর ভাষায় বলা যায়, “আমরা বঙ্গদেশবাসী। আমাদের কথাবার্তার, ভয়-ভালবাসার, চিন্তা-কল্পনার ভাষা বাংলা। তাই আমাদের মাতৃভাষা বাংলা।” মাতৃভাষার গুরুত্ব প্রকাশ করতে গিয়ে মধ্যযুগের অন্যতম শক্তিশালী কবি আবদুল হাকিম বলেছেন-
“যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়।
নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায়ঃ
মাতা পিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি।
দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতিঃ”
বাংলা কাব্যে মাতৃভাষার গুরুত্ব
মাতৃভাষার গুরুত্ব প্রকাশ করতে গিয়ে অনেক কবি কবিতা রচনা করেছেন। মধ্যযুগের অন্যতম শক্তিশালী কবি আবদুল হাকিমের ‘বঙ্গবাণী’, রামনিধি গুপ্তের ‘স্বদেশী ভাষা’, আধুনিক যুগের প্রথম সার্থক কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘বঙ্গভাষা’, দুদ্দু শাহর ‘মাতৃভাষা’, কায়কোবাদের ‘বঙ্গভাষার কাব্যকুঞ্জ’, ‘বঙ্গভূমি ও বঙ্গভাষা’, ‘দেশের বাণী’, রবীন্দ্রনাথের ‘বাংলা ভাষা’, কাজী নজরুল ইসলামের ‘মধুর বাঙলা ভাষা’, আহসান হাবীবের ‘বাংলা ভাষা’, ফররুখ আহমদের ‘ভাষার গান’, সূফী মোতাহার হোসেনের ‘বাংলা ভাষা’ প্রভৃতি কবিতায় মাতৃভাষার গুরুত্ব প্রকাশ পেয়েছে। আবদুল হাকিম বলেছেন “নানান দেশের নানা ভাষা/বিনে স্বদেশী ভাষা পুরে কি আশা।” অতুলপ্রসাদ সেন ‘আমরি বাংলা ভাষা’ কবিতায় বলেছেন, “মোদের গরব মোদের আশা/আমরি বাংলা ভাষা!” কায়কোবাদের কবিতায় আছে-
“বাঙলা যোদের মাতৃভাষা
কি আছে আর তাহার মত।
শব্দে শব্দে মুক্তা ঝরে
জাগায় প্রাণে স্বপ্ন কত।”
মাতৃভাষা নিয়ে আরও অনেক কবিতা রচিত হয়েছে বাংলা সাহিত্যে। তার মধ্যে সানাউল হকের ‘মাতৃভাষা’, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের ‘মুখের ভাষা’, শামসুর রাহমানের ‘বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে’, মহাদেব সাহার ‘আমার বাংলা ভাষা’, আবুল হাসানের ‘মাতৃভাষা’, মুহাম্মদ নূরুল হুদার ‘মাতৃভাষা’, আ.শ.ম. বাবর আলীর ‘আমার ভাষা’, কলিমদাদ খানের ‘আমার ভাষা’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর ‘আমাদের ভাষা সমস্যা’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “মাতৃভাষা ব্যতীত আর কোন ভাষা কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিয়া পরাঠ আকুল করে?” এমনিভাবে বাংলা সাহিত্যে মাতৃভাষার গুরুত্ব প্রকাশ পেয়েছে।
উপসংহার
মাতৃভাষা ছাড়া মন উজাড় করে ভাব প্রকাশ করা যায় না। তাই সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। নিরর্থক ইংরেজি প্রবণতা এবং মাতৃভাষার প্রতি অবহেলা হীনম্মন্যতার পরিচয় ছাড়া আর কিছু নয়। যে জাতির ভাষ্য যত সমৃদ্ধ, সে জাতি তত উন্নত-এ কথা স্মরণে রেখে, মাতৃভাষার উন্নয়ন এবং তাকে সর্বস্তরে ব্যবহার প্রচলনের সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এর জন্য সরকারিভাবে জারি করতে হবে কঠোর নির্দেশ। তাহলেই সর্বস্তরে মাতৃভাষার প্রচলন গুরুত্ব লাভ করবে।