১৯৪৭ সালে পাকিস্তান একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলে তৎকালীন পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের একটি প্রদেশ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিতি পায়। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে এবং ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবেও প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের উল্লেখ থাকলেও শুরু থেকেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের ওপর উপনিবেশিক শাসন চালাতে থাকে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানিদের একাধিপত্যের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হলে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাঙালিরা নিরাপত্তাহীনতা অনুভব করে। এ প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ৫-৬ ফেব্রুয়ারি সাহোরে এক বিরোধী দলীয় সম্মেলনে বাঙালিদের স্বায়ত্তশাসনের দাবি সংবলিত হয় দফা কর্মসূচি পেশ করেন।
১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন জারির কারণ আলোচনা কর |
১৯৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলনের পটভূমি
আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক ৬ দফা কর্মসূচি ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে এবং পরবর্তীতে স্বাধীনতা আন্দোলনের পথকে সুগমকরণের এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। ৬ দফা ছিল পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে বাঙালিদের ওপর দীর্ঘদিনের শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগঠিত পদক্ষেপ। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষমার চিত্র নিচে তুলে ধরা হলো-
১. অর্থনৈতিক বৈষম্য
পাকিস্তান সৃষ্টির পর প্রথমদিকে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য কম থাকলেও আইয়ুবী দশকে এ বৈষম্য চরম আকার ধারণ করে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বিপদ ডেকে আনে। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের উন্নয়ন ব্যয় ছিল ২০% থেকে ৩৬%-এর মধ্যে সীমিত। বাকি অংশ পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ ছিল। অনুরূপভাবে পূর্ব পাকিস্তানের উৎপাদিত দ্রব্য রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হতো ৫০% থেকে ৭০%। কিন্তু বৈদেশিক আমদানি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ছিল ২৫% থেকে ৩০% ভাগে সীমিত। এভাবে উদ্বৃত্ত অর্থ পশ্চিম পাকিস্তানে হস্তান্তরের ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের মোট রাজস্ব আয়ের ৬০% পূর্ব পাকিস্তান থেকে অর্জিত হতো। তারপরও পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ১৯৪৯-৫০ সালে ছিল ৩৩৮ টাকা আর পূর্ব পাকিস্তানে ২৮৭ টাকা। আবার ১৯৫৯-৬০ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৩৬৭ টাকা। পূর্ব পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ২৭৭ টাকা। এভাবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উভয় অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্যের পাহাড় গড়ে ওঠে।
২. চাকরি ক্ষেত্রে বৈষম্য
সরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও পূর্ব পাকিস্তান উল্লেখযোগ্যভাবে পিছিয়ে ছিল। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থায় বাঙালিদের সংখ্যা:
পদ | মোট সংখ্যা | পূর্ব পাকিস্তান | শতকরা হার |
প্রথম শ্রেণি | ২৮১৬ | ৭৩২ জন | ২৩% |
দ্বিতীয় শ্রেণি | ৫৯১৬ | ১২৪০ জন | ২৬% |
তৃতীয় শ্রেণি | ৭০,০০০ | ১৯,৩০০ জন | ২৭% |
চতুর্থ শ্রেণি | ২৬,০০০ | ৮০০০ জন | ৩০% |
৩. উন্নয়ন ব্যয়ে বৈষম্য
পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬% লোকের বসবাস পূর্ব পাকিস্তানে হওয়া সত্ত্বেও এ অঞ্চলের জন্য উন্নয়ন ব্যয় ছিল মাত্র ৩০% অর্থ। ১৯৪৭-৪৮ থেকে ১৯৫৯-৬০ সালে এ ব্যয়ের পরিমাণ হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ২১% থেকে ২৩%। ১৯৬০-৬১ থেকে ১৯৬৯-৭০ এ ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩২% থেকে ৩৬%। আর বাকি বিপুল পরিমাণ অর্থ পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে ব্যয় করা হতো।
১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন জারির কারণ আলোচনা কর |
৪. প্রতিরক্ষা ব্যয়ে বৈষম্য
১৯৫০-৫১ থেকে ১৯৬৯-৭০ সালের এক সারণিতে দেখা যায় যে, ১৬ বছরে কেন্দ্রীয় সরকারের মোট ব্যয়ের ৩৭৯৫.৫৮ কোটি টাকার মধ্যে ২১১৭.১৮ কোটি টাকা ছিল প্রতিরক্ষা ব্যয় যার শতকরা হার ছিল ৫৬%। অথচ পূর্ব পাকিস্তানের জন্য প্রতিরক্ষা ব্যয় বরাদ্দ ছিল মাত্র ১০%। এছাড়া বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণের ক্ষেত্রেও ব্যাপক বৈষম্য বিরাজমান ছিল। রাজনৈতিক শোষণ, নিপীড়ন, অর্থনৈতিক বৈষম্য, সামাজিক বঞ্চনা এবং ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের সামরিক অসহায়ত্বের কারণে তারা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে স্বায়ত্তশাসন অর্জনের পথ খুঁজছিল। এমনি প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ৫-৬ ফেব্রুয়ারি ৬ দফা দাবি পেশ করেন।
আশাকরি, উপরোক্ত আলোচনার তথ্য-উপাত্ত থেকে ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলনের পটভূমি সম্পর্কে বুঝতে পেরেছেন।