Home » ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন জারির কারণ আলোচনা কর
১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন জারির কারণ, ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন,

১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন জারির কারণ আলোচনা কর

by Susmi
0 comment

সামরিক বাহিনী যখন আমলাদের সহায়তায় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে পশ্চাতে ফেলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তগত করে তখন তাকে সামরিক সরকার বলে। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আইয়ুব খানের সহযোগিতায় পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করেন। বিশ্বে এটাই ছিল প্রথম সামরিক শাসন। ইস্কান্দার মির্জা ১৯৫৬ সালের সংবিধান বাতিল ঘোষণা করেন এবং সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক (CMLA) নিযুক্ত করেন। কিন্তু মাত্র ২০ দিন পর ২৭ অক্টোবর জেনারেল আইয়ুব খান ইস্কান্দার মির্জাকে সরিয়ে দিয়ে নিজেকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন। এরপর থেকে শুরু হয় পাকিস্তানে জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসন। আজকের লেখায় ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন জারির কারণ সমূহ নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরবো।

১৯৫৬ সালের সংবিধানের বৈশিষ্ট্য গুলো আলোচনা কর

১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন জারির কারণ

পাকিস্তানে ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন জারির কারণ ছিল বহুবিধ। সামরিক শাসন জারির কারণগুলো নিচে আলোচনা করা হলো-

১. রাজনৈতিক স্থিতিহীনতা

১৯৫৬ সালের সংবিধান অনুসারে পাকিস্তানে সংসদীয় সরকার প্রবর্তিত হয়েছিল। কিন্তু সংসদীয় সরকারের সফলতার শর্তগুলো পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের মধ্যে যথার্থভাবে অনুশীলনের অভাব থাকায় রাজনৈতিক অঙ্গনে দ্বন্দ্ব ও হানাহানির পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের রাজনৈতিক আকাশে ক্ষমতা রদবদলের ঘনঘটায় রাজনৈতিক পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে ওঠে এবং এক ভয়াবহ নাজুক অবস্থার সৃষ্টি হয়। ফলে পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে ক্ষমতার এরূপ স্থিতিহীনতা সামরিক শাসন জারির অন্যতম কারণ হিসেবে প্রতিভাত হয়।

২. সুসংগঠিত রাজনৈতিক দলের অভাব

১৯৪৭ সাল থেকে পাকিস্তানে কোনো সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠেনি। মুসলিম লীগ পরিণত হয়েছিল কয়েকজন প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারী নেতার পকেট সংগঠনে। আওয়ামী লীগকে দমনপীড়ন করে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছিল। সুসংগঠিত রাজনৈতিক দলব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় আমলা ও সেনাবাহিনী রাজনীতিতে প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়াতে সক্ষম হয়। ১৯৫৮ সালে সেনাবাহিনী রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করলেও সাংগঠনিকভাবে কোনো প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে ওঠেনি।

৩. দলীয় শৃঙ্খলার অভাব

পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দলীয় শৃঙ্খলার অভাব, দলবদলের লজ্জাজনক খেলা, উপদলীয় কোন্দল প্রভৃতি কারণে জনসাধারণ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে। এ সুযোগে জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন।

৪. প্রশাসনিক দুর্নীতি

পাকিস্তানের সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতি অতীতের দুর্নীতিকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। বিশেষত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাবে প্রশাসনিক কর্মচারীবৃন্দ অতিমাত্রায় দুর্নীতিপ্রবণ হয়ে উঠেছিল। ফলে প্রশাসনিক দুর্নীতির হাত থেকে বিপন্ন জনগণকে মুক্তির অজুহাত হিসেবে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করা হয়।

৫. অর্থনৈতিক অসহায়ত্ব

রাজনৈতিক ডামাডোলের কারণে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ প্রায় ধ্বংসের মুখে পতিত হয়। এ অবস্থা বেশি দিন চলতে থাকলে পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে। তাই সামরিক শাসন জারি করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না।

৬. গভর্নর জেনারেলের অগণতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ

১৯৪৭ সালের পর থেকেই গভর্নর জেনারেলগণ অন্যায় ও অযাচিতভাবে মন্ত্রিসভার কাজে হস্তক্ষেপ করতেন। গোলাম মুহাম্মদ এবং ইস্কান্দার মির্জার ষড়যন্ত্রমূলক কার্যকলাপ, বিভিন্ন সময় মন্ত্রিসভা বাতিল, জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের কাজে অবৈধ হস্তক্ষেপ পাকিস্তানের সংসদীয় গণতন্ত্রের অপমৃত্যু ঘটায়। এ অবস্থার সুযোগে সেনানায়ক আইয়ুব খান ইস্কান্দার মির্জাকে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠায় উৎসাহ যোগায়।

৭. আওয়ামী লীগের নির্বাচনে বিজয়ের সম্ভাবনা

১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মালিক ফিরোজ খান নূন ঘোষণা করেন যে, সংবিধান অনুসারে ১৯৫৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ সময় আওয়ামী লীগের ব্যাপক জনমত সৃষ্টি হয়। আওয়ামী লীগের এ জনপ্রিয়তা ও বিজয়ের সম্ভাবনা লক্ষ করে এবং পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা আওয়ামী লীগের হাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কায় ভীত হয়ে নির্বাচনকে প্রতিহত করার জন্য সামরিক শাসন জারি করা হয়।

৮. জাতীয় নেতৃত্বের শূন্যতা

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যুর পর পাকিস্তানে নেতৃত্বের অভাব পরিলক্ষিত হয়। বিভিন্ন অঞ্চলে শক্তিমান নেতার উদ্ভব হলেও জাতীয় পর্যায়ে পাকিস্তানকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য কোনো নেতা ছিল না। ফলে জাতীয় জীবনে নেতৃত্বের শূন্যতা দেখা দেয়। এ সুযোগে কোনো প্রকার প্রতিরোধ ছাড়াই সামরিক বাহিনী ক্ষমতা হস্তগত করে।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনের ফলাফল আলোচনা কর

৯. নেতৃবৃন্দের সহনশীলতার অভাব

১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অনুদার মনোভাব বিশেষ করে সহনশীলতার অভাবও পাকিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে। বিশেষত ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী হত্যার বিষয়টি সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের পথকে প্রশস্ত করে।

১০. সামরিক কর্মকর্তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা

১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির মূল কারণ হিসেবে সামরিক কর্মকর্তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। সামরিক বাহিনীর জুনিয়র অফিসারদের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণকে সামরিক শাসন জারির ক্ষেত্রে উৎসাহিত করেছিল। তাছাড়া, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর হতেই সামরিক নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন পদমর্যাদায় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। যা পরবর্তীতে সামরিক শাসন জারি করে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের চূড়ান্ত পরিণতি ডেকে আনে।

১১. যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার ভাঙন

যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠন করার পর অল্পদিনের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। মোর্চার অভ্যন্তরে দলাদলি ও রেষারেষিতে মন্ত্রিদের মধ্যে সম্পর্ক বিনষ্ট হয়। যেমন- সিয়াটো চুক্তি ও বাগদাদ চুক্তি বাতিলের দাবিতে যুক্তফ্রন্টের আমেরিকা বিরোধিরা অসহযোগিতা শুরু করে। আরও অন্যান্য বিষয়ে মতপার্থক্যের কারণে যুক্তফ্রন্ট সরকার দুর্বল হয়ে পড়ে। এ সুযোগে সামরিক বাহিনী সামরিক শাসন জারি করে।

১২. আমেরিকার সমর্থন

পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির ক্ষেত্রে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পরোক্ষ সমর্থন ছিল বলে অনেকে মনে করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের আব্দুল কাইয়ুম খানের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী প্রকাশ্য ভূমিকা, এমনকি অনেকের মতে পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় আওয়ামী পার্টির ক্রমবর্ধমান ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য।

Related Posts