জলবায়ু পরিবর্তন কি
জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান বিশ্বের অন্যতম আলোচিত বিষয়। ক্রমবর্ধমান নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হওয়ায় পৃথিবীর জলবায়ু অস্বাভাবিকভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে। জলবায়ুর এ পরিবর্তন বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে।
জলবায়ু বলতে সাধারণত আবহাওয়ার দীর্ঘদিনের গড়কে বোঝায়। এ প্রসঙ্গে প্রফেসর মোঃ মোজাফফর হোসেন বলেন, “পরিবর্তনশীল আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে কোনো স্থানের বায়ুর তাপ, বায়ুর চাপ, বায়ুপ্রবাহ, বায়ুর অর্দ্রতা, বারিপাত ইত্যাদির ৩০ থেকে ৪০ বছরের গড় অবস্থাকে সে স্থানের জলবায়ু বলে।” আর জলবায়ু পরিবর্তন বলতে ৩০ থেকে ৪০ বছর সময়ে কোনো স্থানের জলবায়ুর উপাদান যেমন তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, বায়ুর চাপ, বায়ুর আর্দ্রতা ও শুদ্ধতা এবং বায়ুর গতি ইত্যাদির উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনকে বোঝায়।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীর জলবায়ুর স্বাভাবিক আচরণ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। অতি সম্প্রতি সময়ের বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে প্রতিনিয়ত কুমেরু ও হিমালয়ের বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, জলবায়ুর সাম্যাবস্থা ভেঙে যাওয়ায় বন্যা, খরা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ভূমিকম্প, সুনামি ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়েই চলেছে।
আরও পড়ুন
ইভটিজিং কি? ইভটিজিং এর কারণ ও প্রতিকার বর্ণনা কর |
অনেক গবেষক মনে করেন ১৯০০ সাল থেকে পৃথিবীর জলবায়ু উষ্ণ হচ্ছে। তবে এ উষ্ণতা পৃথিবীর সর্বত্র সমানভাবে ঘটেনি। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় এ পরিবর্তন দৃষ্ট হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বায়ুমণ্ডলে গ্রিন হাউজ গ্যাসের মাত্রা বৃদ্ধি এবং সূর্যরশ্মি থেকে নির্গত শক্তির পরিবর্তনের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়েছে। আবার বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি এসে মানুষের কর্মকাণ্ডেই গ্রিন হাউজ গ্যাসের ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে।
শিল্পকারখানাতে নিঃসরিত সালফেট কণা সৌর বিকিরণকে প্রতিফলিত করে এবং এর ফলে এটি বায়ুকে শীতল রাখে। এ সালফেট কণা ১৯৪০ সাল থেকে বেশ কয়েক দশক পর্যন্ত উষ্ণতাকে আড়াল করে রেখেছিল, কিন্তু এই বিষাক্ত পদার্থগুলো কমে যাওয়ার ফলে এবং গ্রিন হাউজ গ্যাসের ঘনত্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় সত্তর দশক থেকে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির নতুন মাত্রা যোগ করে। ১৯৮০’র দশক থেকে গ্রিন হাউজ (Green House) গ্যাসের প্রভাবে প্রতিবছর পৃথিবীর তাপমাত্রা গড়ে বৃদ্ধি পেয়েছে ০.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। প্রতিনিয়ত বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সুমেরু অঞ্চলের বরফ গলার পরিমাণ আগের চেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এভাবে পৃথিবীর জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরিবর্তন প্রাণিকুলের জন্য হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ
জলবায়ু পরিবর্তনের পেছনে অনেক কারণ নিহিত রয়েছে। যদিও জলবায়ুর স্বাভাবিক আচরণ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার পেছনে মূলত মানুষই দায়ী। নিচে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ গুলো তুলে ধরা হলো-
১. ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা
পৃথিবীর জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে জলবায়ু বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। বাড়তি জনসংখ্যার বসবাসের স্থান, কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি, খাদ্য চাহিদাসহ মৌল মানবিক চাহিদা পূরণের জন্য দিন দিন জলবায়ুর ব্যবহার মাত্রাতিরিক্ত হচ্ছে। বিধায় ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা জলবায়ুর পরিবর্তনে অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
২. অপরিকল্পিত নগরায়ণ
জলবায়ু পরিবর্তনের একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হলো অপরিকল্পিতভাবে নগর গড়ে ওঠা। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের গতিকে ত্বরান্বিত করছে।
৩. অপরিকল্পিত শিল্পায়ন
দ্রুত অপরিকল্পিতভাবে শিল্পকারখানা গড়ে ওঠার ফলে জলবায়ুর ওপর বৈরী প্রভাব পড়ছে। অপরিকল্পিত শিল্পায়ন মাটি দূষণ, ভূমিধস, পানি দূষণ ইত্যাদির মাধ্যমে জলবায়ুর পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করছে।
৪. গ্রিন হাউজ ইফেক্ট
জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান কারণ হলো বায়ুমণ্ডলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি। আর বায়ুমণ্ডলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ গ্রিন হাউজ গ্যাস। গ্রিন হাউজ ইফেক্ট বলতে পৃথিবীর অভ্যন্তরে সার্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাওয়াকে বোঝায়। সূর্য থেকে যে তাপশক্তি পাওয়া যায় পৃথিবী থেকে তা বিকিরণের মাধ্যমে আবার মহাশূন্যে ফিরে যায়। কিন্তু বায়ুমণ্ডলে গ্রিন হাউজ ইফেক্টের জন্য প্রচুর পরিমাণ সিএসফি, মিথেন ইত্যাদি গ্যাস জমে থাকার ফলে ভূপৃষ্ঠের তাপ বিকিরণ বাধাপ্রাপ্ত হয়ে আবার ভূপৃষ্ঠে ফিরে আসায় ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্রিন হাউজ গ্যাসের মধ্যে রয়েছে কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন, সিএফসি, নাইট্রোজেন, সালফার অক্সাইডসমূহ। বায়ুমণ্ডলে এসব গ্যাসের উপস্থিতি পূর্বে লক্ষ করা গেলেও বর্তমানে ব্যাপক জীবাশ্ম জ্বালানি দহন, বন উজাড় এবং বিশেষ ধরনের কৃষি ব্যবস্থা গ্রিন হাউজ ইফেক্টের মাত্রাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে পূর্বের তুলনায় পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় পাঁচগুণ। আর অতিরিক্ত তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলেই দেখা দিয়েছে পরিবেশগত বিপর্যয়।
৫. ওজোনস্তর ক্ষয়
বায়ুমণ্ডলের ওজোনস্তরের ক্ষয়ের মাধ্যমে বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাচ্ছে এবং বায়ুমণ্ডলে অতি বেগুনি রশ্মির প্রভাবে নানা ধরনের মারাত্মক রোগব্যাধি দেখা দিচ্ছে।
৬. রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার
বিশ্বব্যাপী রাসায়নিক পদার্থ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক ইত্যাদির ব্যাপক ব্যবহারের ফলে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে। বিশেষ করে এসব দ্রব্য ব্যবহারের মাধ্যমে দ্রুত কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির চেষ্টা পরিবেশের ওপর বৈরী প্রভাব ফেলছে।
৭. বিলাসদ্রব্যের উৎপাদন ও ব্যবহার
বিলাসদ্রব্যের উৎপাদন ও ব্যাপক ব্যবহারে বায়ুমণ্ডলে সিএফসি, মিথেন, ওজন, নাইট্রাস অক্সাইড প্রভৃতি গ্যাস বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং বিশ্ব জলবায়ু দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে।
৮. পারমাণবিক অস্ত্র উৎপাদন ও ব্যবহার
ক্ষতিকর পারমাণবিক পদার্থের ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদিত মরণাস্ত্রের ব্যবহার বিশ্ব জলবায়ুকে প্রতিনিয়ত বিষিয়ে তুলছে। এসব মরণাস্ত্রের ব্যবহার মানবজীবন ও জীববৈচিত্র্যকেও হুমকির মুখে ঢেলে দিচ্ছে।
৯. বৃক্ষ নিধন ও বনভূমি উজাড়
অবাধে বৃক্ষ নিধনের মাধ্যমে বনভূমি উজাড় হওয়ার ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। যে পরিমাণ বৃক্ষ তথা গাছপালা প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে নিধন করা হয় পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য সে পরিমাণ বনায়ন হচ্ছে না। ফলে জলবায়ু দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে।
১০. আগ্নেয়গিরির উদগিরণ
আগ্নেয়গিরির উদগিরণও বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য কম দায়ী নয়। আগ্নেয়গিরির প্রবল উদগিরণ থেকে নির্গত পদার্থকণা মেঘমালার সবচেয়ে উচ্চস্তরে পৌঁছতে পারে যেখানে এগুলো সূর্য থেকে আগত সৌরশক্তির প্রতিফলনের পরিমাণকে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করে, যা বৈশ্বিক তাপমাত্রাকে ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হ্রাস করতে পারে।
আরও পড়ুন
জলবায়ু পরিবর্তন অনুচ্ছেদ |
বস্তুত মানুষের কর্মকাণ্ডের ফলশ্রুতিতেই বিশ্ব জলবায়ুতে পরিবর্তন ঘটছে, পরিবেশের বৈরী আচরণ আমাদের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে এবং প্রতিনিয়ত প্রাণিকুলের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে। এর প্রভাব পড়ছে সর্বত্র। জলবায়ু পরিবর্তনের সর্বগ্রাসী প্রভাব নিচে তুলে ধরা হলো-
১. প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে ঘরবাড়ি, গাছপালা, ফসলসহ প্রাণিকুলের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে।
২. উপকূলীয় অঞ্চল তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রের পানি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এতে বিভিন্ন দেশের উপকূলীয় অঞ্চল পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
৩. লবণাক্ততা
জলবায়ুর ক্রমবর্ধমান পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি ভূঅভ্যন্তরে প্রবেশ করে ভূগর্ভস্থ পানির লবণাক্ততা বেড়ে যাচ্ছে। এতে খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিবে এবং জীববৈচিত্র্য নষ্ট হবে।
৪. হিমবাহ
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পার্বত্য অঞ্চলে হিমবাহের সৃষ্টি হচ্ছে। হিমবাহের ফলে বরফ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে বাতাসের সাথে মিশে অতি বৃষ্টির সৃষ্টি করছে।
৫. দাবানল
জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তনের ফলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, খনিজ সম্পদ আহরণ ইত্যাদির কারণে বনে অগ্নিকাণ্ড তথা দাবানলের সৃষ্টি হচ্ছে। এতে গাছপালা, পশুপাখির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। আবার লোকালয়ের কাছাকাছি বনে দাবানলের সৃষ্টি হলে মানুষেরও অনেক ক্ষতি হচ্ছে।
৬. বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি
জলবায়ুর ক্রমবর্ধমান পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং নানা রকম সমস্যা দেখা দিচ্ছে। সম্প্রতি বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বিশ্বের তাপমাত্রা ২-৪ ডিগ্রি পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে।
৭. নদনদীর প্রবাহ পরিবর্তন
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নদনদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। এতে নদনদীর গতিপথ পরিবর্তন হবে এবং প্রধান প্রধান নদীর পানি হ্রাস পেতে পারে।
৮. কৃষি উৎপাদন হ্রাস
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কৃষি উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাচ্ছে। এতে অপুষ্টি, দারিদ্র্য, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিবে।
৯. সংক্রামক ব্যাধির বিস্তার
জলবায়ু পরিবর্তন জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ডায়রিয়া, কলেরা, নিউমোনিয়া, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস বি, মেনিনজাইটিস, পোলিও ইত্যাদি রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটছে। সেই সাথে সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মির অনুপ্রবেশের ফলে স্কিন ক্যান্সার ও চোখের ছানি পড়ার মতো রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে।